কাজির বাজার ডেস্ক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাস চারেক। রাজনৈতিক দলগুলো মাঠের আন্দোলন-সমাবেশে পার করছে ব্যস্ত সময়। নির্বাচন কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কা সব সময় থেকেই যায়। অতীতেও সেটা দেখা গেছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাই বাড়ছে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ। পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায়ই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ অভিযানও শুরু করবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানে উদ্ধার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ অস্ত্র। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রæয়ারি ভারতীয় সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর এলাকা থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল ও আট রাউন্ড গুলিসহ আটক হন আব্দুর রাজ্জাক রাজু (২৬) নামে এক যুবক। সোনামসজিদ এলাকা থেকে অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করে তা গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর এলাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ২৬ মে ভারত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ সীমান্ত দিয়ে একটি আমেরিকান পিস্তল, ৭ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগাজিনসহ মো. কমল (৩৮) নামে একজনকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এছাড়া গত জুলাই মাসে একটি পিস্তল, একটি এয়ার পিস্তল, একটি গান, ৯৫ কেজি সালফার এবং ৪৩৯ রাউন্ড গুলিসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে বাহিনীটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্তের অরক্ষিত কিছু এলাকাসহ বিভিন্ন কৌশলে বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করানো হচ্ছে। নির্বাচনের সময়, নির্বাচনের আগে ও পরে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের কারণে খুনোখুনি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সারাদেশে বিশেষ অভিযানের পরিকল্পনাও করছেন নীতিনির্ধারকরা।
পুলিশ সদরদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে সারাদেশে নিয়মিত অভিযান চলমান। তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিশেষ অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করা হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে এবার মিয়ানমার থেকে অবৈধ অস্ত্রের জোগান বেশি দেওয়া হতে পারে। সে আশঙ্কা ও গোপন তথ্য থেকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সীমান্তের কিছু এলাকায় নিয়মিত অভিযান চলছে। এছাড়া বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের খবর দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমগুলোতে। পুলিশ, এপিবিএন ও র্যাবের অভিযান চলমান বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২২ সালে দেশে উদ্ধার করা অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার ৮৭৯টি। এই সময় অস্ত্র মামলা হয়েছে এক হাজার ৫৪০টি।
এলিট ফোর্স র্যাব ২০২২ সালে এক হাজার ৩৯৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। ২০২১ সালে উদ্ধার করে ৯৬৯টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। আগের বছর ২০২০ সালে উদ্ধার করে ৮৪৬টি। র্যাবের এ পরিসংখ্যান থেকেও অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা, ব্যবহার ও উদ্ধার বাড়ার চিত্র পাওয়া যায়। ২০২২ সালে উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে একে-৪৭ (এসএমজি), একে-২২, রকেট লাঞ্চারের মতো বিধ্বংসী অস্ত্রও রয়েছে। ওই বছর সংস্থাটি ২২১টি বিদেশি রিভলবার, পিস্তল, ৪৫টি দেশি রিভলবার ও পিস্তল উদ্ধার করে। গোলাবারুদ উদ্ধার করে সাত হাজার ১৩৬টি। বিস্ফোরক উদ্ধার করে ৫৫ কেজি এবং গ্রেনেড উদ্ধার করে ১৫টি। অস্ত্র কেনাবেচায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় ৫২১ জনকে। এছাড়া অস্ত্র রাখার অভিযোগে ১১ জন ও বিস্ফোরক সরবরাহ করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় ৮৬ জনকে।
বিজিবির ১০ বছরের অস্ত্র উদ্ধারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে বেড়েছে রাইফেল, রিভলবার, পিস্তল, বন্দুক ও গুলি চোরাচালান। এর মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ ৯টি এবং চলতি বছর এ পর্যন্ত দুটি রাইফেল জব্দ করা হয়েছে। গত বছর পাঁচটি রিভলবার জব্দ করা হয়, যা ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অবশ্য এবছর শুধু ফেব্রæয়ারিতে একটি রিভলবার ধরা পড়েছে। ক্ষুদ্রাস্ত্রের মধ্যে পিস্তল চোরাচালান হয় সবচেয়ে বেশি।
চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সীমান্ত থেকে ৬০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি সাব-মেশিনগানও (এসএমজি) রয়েছে। এর আগের ১০ বছরে মাত্র একটি এসএমজি উদ্ধার হয়েছিল। এবছর এখন পর্যন্ত ২৪০ রাউন্ড গোলাবারুদ ও ১৮টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করেছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।
যেসব রুট দিয়ে অস্ত্র আসে দেশে
যশোরের বেনাপোল ও চৌগাছা সীমান্ত, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, সাতক্ষীরার শাকরা ও ভোমরা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ ও ভোলাহাট, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, সিলেটের ডাউকি, কুমিল্লার সীমান্ত, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পিআর শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, গত ১৯ আগস্ট লালবাগ থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ছয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে তিনটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে ডিএমপির ৫০ থানাসহ ৮টি গোয়েন্দা ইউনিটের নিয়মিত অভিযান চলমান। জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে নির্দেশনা পেলে বিশেষ অভিযান শুরু হবে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নির্বাচনের আগে অস্ত্র চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যেতে পারে। বর্তমানে মাঠে যে নির্বাচনী উত্তাপ আছে তার চেয়ে সামনের দিনগুলো আরও কঠিন হতে পারে, তবে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর। এ বিষয়ে গোয়েন্দারা মাঠে কাজ করছেন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অভিযান চালিয়ে ৪৩৩টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র আটক করে র্যাব। এতে জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় ১৪৯ জনকে। এই অবৈধ অস্ত্রের ২৪২টি উদ্ধার হয়েছে শুধু মে মাসেই।
তিনি বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফের দুর্গম পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছিল অস্ত্রের কারখানা ও ডাকাতদলের আস্তানা। সেখান থেকে পরিচালনা করা হতো নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রম। শুক্রবার (১৮ আগস্ট) টেকনাফের রঙ্গীখালী পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে ফয়সাল বাহিনীর প্রধান ফয়সাল ও তার পাঁচ সহযোগীকে আটক করে র্যাব। এসময় দুটি একনলা বড় বন্দুক, চারটি এলজি, ৭ রাউন্ড শর্টগানের কার্তুজ, ১০ রাউন্ড রাইফেলের কার্তুজ, একটি ড্রিল মেশিন, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামসহ তিনটি স্মার্টফোন উদ্ধার করা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, সম্প্রতি অস্ত্রসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। আর কয়েক মাস পরে নির্বাচনের ডামাডোল বাজবে। রাজনৈতিকদলগুলো তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রাম করবে। সেই মুহ‚র্তে একটা গ্রæপ ১১টি অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। সবগুলো বিষয় বিবেচনা করে তদন্ত চলছে। নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্রধারী তারা যে দলই করুক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলমান। এছাড়া সবগুলো ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত পুলিশ সদরদপ্তর থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে। যারাই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশেষ অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার নিয়ে বিশেষ অভিযান পরবর্তীসময়ে শুরু হবে। নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে তখন বৈধ অস্ত্র কেমন আছে সে বিষয়েও হিসাব-কিনাশ নেওয়া হবে।