মো. আব্দুল মালিক :
জেনারেল মহম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর জন্ম ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলায়। ওসমানীর বাবা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক। তাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীর গ্রামে। শৈশবে ওসমানী ‘আতা’ নামেই পরিচিত ছিলেন। ১৯২৩ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মা ও গৃহ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়।
১৯২৯ সালে গৌহাটির কটন স্কুলে এবং ১৯৩২ সালে সিলেট পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি হন ও ঐ স্কুল থেকে ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে “প্রিটোরিয়া বৃত্তি” লাভ করেন। ১৯৩৪ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বিশ^বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করেন। তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের ইউ-ও-টি-সি এর সার্জেন্ট, স্যার সৈয়দ আহমদ হলের উপদেষ্টা ও পর পর দুই বার বিশ^বিদ্যালয়ের ‘প্রোক্টোরিয়েল মনিটর’ ও আসাম বেঙ্গল ছাত্র সংঘের সহ সভাপতি। ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রথম নিখিল ভারত ছাত্র সম্মেলনে ওসমানী আলীগড় বিশ^বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন এবং সম্মেলনের বিষয় নিয়ন্ত্রণ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
আলীগড় বিশ^বিদ্যালয় থেকে ওসমানী ১৯৩৬ সালে আইএ, ১৯৩৮ সালে বিএ পাসের পর তিনি ভূগোলে মাষ্টার্স প্রথম পর্ব পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং চূড়ান্ত পরীক্ষার পূর্বেই ১৯৩৯ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪০ সালের ৫ অক্টোবর তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারী একাডেমী দেরাদুন থেকে সামরিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কমিশন প্রাপ্ত হন। এর পর তিনি দ্রুত পদোন্নতি লাভ করে ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ২৩ বৎসর বয়সে তৎকালীন বৃটিশ সাম্্রাজ্যের সর্বকনিষ্ট মেজর হন। মাত্র ২৩ বৎসর বয়সে একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে তিনি রেকর্ড সৃষ্টি করেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে বার্মা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন এবং তিনি ছিলেন অল্প কয়েকজন কালো অধিনায়কদের অন্যতম। কিছুদিন তিনি একটি ফরমেশন হেডকোয়ার্টারে জেনারেল ষ্টাফ অফিসার গ্রেড-২ পদেও নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি লং কোর্স অধ্যয়নের জন্য মনোনীত হন। উল্লখ্য তিনি ১৯৪৬ সালে আই-সি-এস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্য ও মনোনীত হন। কিন্ত তিনি সৈনিক জীবন পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। ১৯৪৭ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে আগমনের দিনই তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে কোয়ার্টার মাষ্টার জেনারেল শাখায় ফাষ্ট গ্রেড ষ্টাফ অফিসার পদে যোগদান করন। এই পদে তিনি ষ্টাফ কলেজে শিক্ষা লাভ করার আগেই এবং মাত্র ৭ বৎসর চাকুরী জীবনের মধ্যে বহু সিনিয়র অফিসারকে ডিঙ্গিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে একটি নতুন রেকর্ড স্থাপন করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে কোয়েটা ষ্টাফ কলেজ থেকে পি,এস,সি, ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে সেনাবাহিনীর তদানীন্তন চীফ অফ দি জেনারেল ষ্টাফ মেজর জেনারেল রেজীনেন্ড হার্টন এর জেনারেল ষ্টাফ অফিসার গ্রেডÑ১ পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি এসিসষ্ট্যান্ট এ্যাডজুটেন্ট জেনারেল পদে, অফিসার পদ প্রাথী নির্বাচন বিষয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। এই পদে থাকাকালীন আই এস,এস,বি এ যাওয়ার আগে শিক্ষা সংক্রাস্ত যোগ্যতা নির্ধারণের জন্য তিনি তিনটি বিষয়ের লিখিত পরীক্ষার প্রচলন করেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল স্যার ডগলাস গ্রেসী কর্তৃক একটি কমিটির চেয়ারম্যানরূপে কমিশন প্রার্থীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক গুণাবলীর ন্যূনতম একটি বিশ্লেষণ তিনি প্রস্তুত করেন এবং একটি প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠান। এই বিশ্লেষণে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাডেট কলেজ স্থাপনের বিশেষ সুপারিশ ছিল। এই দায়িত্ব পালনের এক বৎসর পরে তিনি সৈন্যদলের সহিত সক্রিয় কার্যে প্রত্যাবর্তন করেন এবং স্বেচ্ছায় লেফটেন্যান্ট কর্নেলের পদ ত্যাগ করে মেজরের পদে রাইফেল কোম্পানীর পরিচালক রূপে যোগদান করেন। ব্যাটালিয়নের অধিনায়করূপে লেফটেন্যান্ট কর্নেলের পদে পুণ: উন্নীত হওয়ার পূর্বে তিনি ছয় মাস কোম্পানী কমান্ডার ও চার মাস সেকেন্ড ইন কমান্ড পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। পরবতী পর্যায়ে তিনি ১০৫ নম্বর ব্রিগেড ট্রেনিং টিমের ভারপ্রাপ্ত অফিসাররূপে একটি কোম্পানী হইতে ব্রিগেড গ্রুপ পর্যন্ত সেনাদলকে দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধক্ষেত্রের কৌশল শিক্ষাদানে ও পরিচালনায় বিখ্যাত হন। এই দায়িত্ব সম্পাদন করিয়া তিনি তাঁর ব্যাটালিয়ান ৯/১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়করূপে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পুণ: উন্নীত হন। ১৯৫১ সালে জরুরী অবস্থার সময় তাঁর অধিনায়কত্বে এই পাঞ্জাব রেজিমেন্ট পাঞ্জাব সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করে। সেই সময় তাঁর ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পরিদর্শিত ও প্রশংসিত হয়। পল্টনের অধিনায়কত্বে তাঁর দক্ষতা সম্বন্ধে অনুকুল রিপোর্টের পর ওসমানীকে প্রথমবারের মত পূর্ব পাকিস্তানে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। প্রথমে তিনি ফাষ্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের অধিনায়কত্ব করেন। পরে তিনি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের পরিচালনার ভার গ্রহণ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে রেজিমেন্ট স্থানান্তরিত করেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাস তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৩ সালে ১০৭ নম্বর ব্রিগেডে কমান্ডারের অনুপস্থিতিতে তিনি চার মাসকাল অস্থায়ী ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে তিনি খুলনা, যশোর, ঢাকা এবং চট্টগ্রামের ষ্টেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে তাঁকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এর অতিরিক্ত কমান্ড্যাণ্ট হিসেবে বদলি করা হয়। এই পদে থাকাকালে ১৯৫৫ সালে পুলিশ ধর্মঘটে ঢাকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি তা দক্ষতার সহিত মোকাবেলা করেন। এ সময় ই, পি, আর এ অবাঙ্গালিদের নিয়োগ তিনি বন্ধ করেন ও প্রথমবারের মত পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ই,পি,আর থেকে ফিরে তিনি জেনারেল ষ্টাফ অফিসার গ্রেড-১ পদে যোগদান করেন এবং অল্প দিন পরেই জেনারেল হেড কোয়াটার্স এর জেনারেল ষ্টাফে ১৯৫৬ সালে মিলেটারী অপারেশনের ডেপুটি ডাইরেক্টর এর দায়িত্বে নিযুক্ত হয়ে ১৯৫৭ সালে কর্নেল পদে উন্নীত হন। পরবর্তীতে সেণ্টো এবং সিয়াটোতে পাকিস্তানের দেশ রক্ষার পরিকল্পনায় নিয়োজিত হন এবং আন্তর্জাতিক সামরিক ও পরিকল্পনা বৈঠকে বিদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। পাকিস্তান এয়ার ডিফেন্স কমিটির সদস্য ও সেনাবাহিনীর দুটি কমিটির সভাপতিও ছিলেন। কিছুকালের জন্য তিনি অস্থায়ী ব্রিগেডিয়ারের পদে ডাইরেক্টর অফ মিলিটারী অপারেশন এর পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তাঁকে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক ব্যবস্থা সম্পর্কে অনুধাবন ও মূল্যায়ন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে ডেপুটি ডাইরেক্টর অফ মিলেটারী অপারেশন হিসেবে যুদ্ধরত বিভিন্ন সামরিক হেডকোয়াটার্সের সহিত সংযোগ রক্ষার্থে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাওয়া ছাড়াও যুদ্ধের প্রাক্কালে, যুদ্ধের সময় ও পরবর্তীকালে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুনাম ও উন্নতির প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।
কর্নেল পদে উন্নীত হওয়ার ঠিক দশ বছর পর ১৬ মে ১৯৬৬ সালে ওসমানী অবসর প্রস্তুতির ছুটি নেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনা বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ওসমানী ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর একান্ত উদ্যোগ ও উৎসাহে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্রীড়াক্ষেত্রে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালে ওসমানী যেসব বিষয়ে কৃতকার্য হন তা হচ্ছে- ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বৈশিষ্টপূর্ণ ঐতিহ্য এবং রেজিমেন্টের সর্বশ্রেণির অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সম্মিলিত জীবনী শক্তি গঠন, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শ্রেণীগঠন (বাঙালি সৈনিক দ্বারা) ভাঙ্গার উচ্চ পর্যায়ের পাঁচবারের অপচেষ্টার বলিষ্ঠ প্রতিরোধ করে মাত্র দু’টি ব্যাটালিয়ান থেকে ছয়টি ব্যাটালিয়ানে উন্নীত করা, সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা শতকরা ২ থেকে শতকরা ১০ ভাগের অধিক এবং বাঙালিদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যানুপাতে জুনিয়র কমিশন অফিসার পদ সহ সর্বস্তরে বাঙালি সৈনিকদের জন্য পদ সংরক্ষণ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত বাংলা গান “চল চল চল” মার্চ সঙ্গীতরূপে, পাকিস্তানের সামরিক বাদ্যযন্ত্রে “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা” ও “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ” সহ বাংলা গানের প্রচলন এবং ব্রতচারী নৃত্যের বাংলা গীতি ও বাদ্যযন্ত্রসহ বাঙালি সৈনিক দ্বারা ব্রতচারী নৃত্য পরিবেশনের সরকারী অনুমোদন আদায়। অবসর গ্রহণের সময় ওসমানী বাঙালি সামরিক বাহিনী ও তাদের পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা ও এসবের সমাধানের জন্য লিপিবদ্ধ সুপারিশ সেনাবাহিনীর তদানীন্তন সর্বাধিনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে দিয়ে আসেন। এতে স্বল্পতম সময়ে পাকিস্তানে লোকসংখ্যা অনুপাতে বাঙালিদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগের একটি বিস্তারিত পরিকল্পনাও ছিল। এর কপি ওসমানী সশস্ত্র বাহিনীর প্রবীনতম বাঙালি অফিসার লেফটেন্ট্যাট জেনারেল খাজা ওয়াসি উদ্দিনকে দেন, যাতে তিনি বিষয়গুলো সম্পর্কে সরকারকে তাগিদ দিতে পারেন।
১৯৭০ সালের জুলাই মাসে তিনি রাজনীতিতে যোগদেন এবং আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তানের বৃহত্তম নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানী কমান্ডোদের একটি কোম্পানী ওসমানীর বাড়িতে আক্রমণ করে এবং তাঁকে হত্যার জন্য খোঁজে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি রক্ষা পান। নিউ ইস্কাটনের এক বাড়িতে আক্রমণকারী পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক ও পদাতিক বাহিনীর নাকের ডগায় চার রাত ও তিন দিন একা থাকার পর ওসমানী ছদ্মবেশ ধারণ করে ঢাকা ত্যাগ করেন। নৌকাযোগে ও পায়ে হেঁটে তিনি কুমিল্লায় পৌঁছান এবং ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডারদের এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে ওসমানীকে নেতৃত্ব দানের জন্য সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর ওসমানীকে ১২ এপ্রিল হতে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। তিনি দ্রুতবেগে নিয়মিত বাহিনী পুনর্গঠন করেন ও বিরাট গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলেন। জাতির প্রতি তাঁর সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং ইহা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হতে কার্যকরী করেন। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল হতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ বিলুপ্ত হওয়ায় তিনি সামরিক বাহিনী থেকে ২য় বার অবসর গ্রহণ করেন।
জেনারেল ওসমানী ছিলেন প্রখর মেধাবী, তীক্ষè বুদ্ধি সম্পন্ন, দক্ষ সেনানায়ক। আমরা পাই বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বছরে মাত্র ৩০০ জন সেনা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হতো। তার মধ্যে উপমহাদেশ থেকে নিয়োগ পেতেন মাত্র ৩০ জন। ব্রিটিশরা বিভিন্ন কারণে মুসলমান এবং বাঙালিদেরকে সু-নজরে দেখত না। সেই বৈরী পরিবেশে একজন বাঙালি মুসলমান ওসমানী ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীতে নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে নিয়োগলাভ করেছিলেন। তদুপরি তিনি আই.সি.এস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েও মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি জওহরলাল নেহরু কর্তৃক সরাসরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদানের আহবান পান, যা ছিল তখনকার সময়ে একজন বাঙালি মুসলমানের জন্য দূর্লভ প্রাপ্তি। আর্মি ও সিভিল অফিসারের জন্য মনোনীত হয়ে সামরিক জীবন বেছে নিয়েছেন এমন জেনারেল পৃথিবীতে ২য় জন আছেন কী না জানি না। এছাড়া তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টে, ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন যা বিশ্বের অনেক নামজাদা জেনারেলের জীবনে ও ঘটেনি।
ওসমানি জন্মগ্রহণ করেছিলেন পরাধীন ভারতে, পরে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তানে এর পরে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে ৩টি দেশের নাগরিক ছিলেন এবং ৩টি দেশ ও জাতির পক্ষে মরণপণ যুদ্ধ করেছেন। ওসমানী কখনো স্বজাতি স্বদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন নি। এমনি মেধাবী ও দক্ষ সমরনায়ককে বিজাতীয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাঁর মেধাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছে, তাঁর যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন করেছে। স্বজাতি পাকিস্তানীরা তাঁর মেধাকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমৃদ্ধ করেছে তবে তাঁর যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন করে নি। এই মূল্যায়ন না করার কারণটি ‘পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক নীতি ছিল’ না ‘প্রখর মেধাবী ও দক্ষরা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার নীতি রপ্ত করতে পারেন না বলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাংখিত স্থানে যেতে পারেন না’ এটা কার্যকারী ছিল তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কেননা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও দু একজন বাঙালি কর্ণেলের উপরে পদায়িত হয়েছিলেন। জেনারেল ওসমানীর মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে সবচেয়ে কম কাজে লাগিয়েছে বাংলাদেশ। তিনি ছিলেন একজন সফল ও পরীক্ষিত সেনানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে অকোতভয় মুক্তিযোদ্ধারা মরণপণ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। তিনি তৎকালীন প্রতিটি আর্মি অফিসারকে ব্যাক্তিগতভাবে চিনতেন এবং জানতেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলদেশে সামরিক বাহিনী গঠনের দায়িত্ব বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানীকে দেওয়া হয়নি। তাঁকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী না করে করা হয় বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী। সে সময় সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব বাছাইয়ে জেনারেল ওসমানীর মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। সেদিন যদি বঙ্গবন্ধুর সরকার সেনাবাহিনীর বিষয়ে জেনারেল ওসমানীর মতামতকে প্রধান্য দিতেন, তাহলে হয়ত ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ এবং তৎপরবর্তী হত্যা-ক্যু ইত্যাদি সংঘঠিত হতো না। মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ফাঁসির কাস্টে ঝুলতে হতো না। একুশ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির চাকা পিছনের দিকে ঘুরত না। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আলবদররা পতাকাবাহী গাড়ি দৌড়াতে পারত না। এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে বঙ্গবীরের জীবন ও কর্ম নিয়ে একাডেমিক গবেষণার দাবি রাখে। জেনারেল ওসমানীর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তারঁ রুহের মাগফেরাত ও জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করছি।