সুনামগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস আর প্রথম ফাল্গুন থেকেই ‘বসন্ত বাতাসে সইগো, বসন্ত বাতাসে, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ, আমার বাড়ি আসে সই গো, বসন্ত বাতাসে’- বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানটি শোনা যাচ্ছে সকল বয়সের মানুষের মুখে।
আজ ২ ফাল্গুন (১৫ ফেব্রুয়ারি) অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ১০৬তম জন্মবার্ষিকী। ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার ধলআশ্রম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইব্রাহীম আলী ও মাতার নাম নাইওরজান। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শাহ আব্দুল করিম মৃত্যুবরণ করেন।
দারিদ্র্য ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। তিনি বাউলগানের দীক্ষা লাভ করেছেন সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর কাছ থেকে। শরীয়তী, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীতসহ বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন। উপহার দিয়েছেন অনেক মনে রাখার মতো গান। উজানধল, কালনী নদী, রাখাল, দুঃখ, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, বিচ্ছেদ বেদনা, অভাব অনটন, টানাপোড়েন, কাঁদামাটির মানুষের বাউল গান এই নিয়ে আব্দুল করিম। শোষণ বঞ্চনা আর নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের হৃদয় নিংড়ানো কথা স্থান পেয়েছে তার রচিত গানে। গানের কথা, সুর, তাল, লয়ে সৃষ্টিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, প্রেম বিরহ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা সহ মানব জীবনের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে তার গানে।
কালজয়ী বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম গ্রামের অন্যদশটা পরিবারের মতো ছিলো না তার পরিবার। সংসারের অভাব অনটন, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থার মধ্যে বেড়ে ওঠেন করিম। পিতা ইব্রাহিম আলী ছিলেন কৃষক আর মাতা নাইওরজান বিবি ছিলেন সাদামাটা গ্রাম্যবধূ। ইব্রাহিম আলীর ছয় সন্তানের মধ্যে করিম ছিলেন একমাত্র ছেলে, বাকী ৫ জন মেয়ে।
উজানধল গ্রামের পাশদিয়ে বয়ে গেছে কালনী নদী। সারি সারি করচ গাছ কালনীর ছোট ছোট ঢেউ যেকোন মানুষ কে বাউল দর্শনের কাছে জোর করে টেনে নিয়ে যাবে। প্রকৃতির এমন রূপদেখে বেরসিকের কণ্ঠেও অবচেতন মনে গুন গুন গান ভেসে আসবে। গান পাগল করিমের পরিপার্শ্ব ছিলো মন মাতানো রূপের। শেষ বিকেল অথবা ভরদুপুরে কালনীর তীরে বসে করিম রচনা করেছেন অসংখ্য বাউল গান।
ভাটিবাংলা খ্যাত সুনামগঞ্জের ছোট্ট উপজেলা দিরাইয়ের আব্দুল করিম রচিতগান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত ব-দ্বীপের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিয়েছে। আর তাই তো দিরাই শহরের ৫/৬ বছর বয়সের শিশুরা তাকে চেনে করিম সাব হিসেবে। বাংলাদেশের প্রবাদ তুল্য বাউল আবদুল করিম ভাটিবাংলার অপরূপ সৌন্দর্য করিম ধারণ করেছিলেন তার হৃদয়ের গভীরে। ভাটির প্রকৃতি জল-স্থল,আকাশ-বাতাস,কাদামাটি সহজ-সরল মানুষের প্রতিকৃতি ধারণ করেছিলেন আপন সত্ত্বায়।
শাহ আব্দুল করিম তার সহপাঠীদের নিয়ে গাজীর গান, বাউলা গান, ঘাটু গান, পালাগান, সারিগান,মালজোড় গান, কবিগান সহ বিভিন্ন অতি প্রাকৃতজনের গান গাইতেন। সে সময় ভাটি অঞ্চলের হাওরে নাও বাইছ (নৌকা বাইছ) হতো তখন করিম তার সহপাঠীদের নিয়ে নাওয়ে উঠে গাইতেন ‘কোন মেস্তুরী নাও বানাইছে কেমন দেখা যায় ঝিল-মিল-ঝিল-মিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও’। এভাবে গানের মধ্যদিয়ে চলে তার বাউল গান চর্চা। বৃহত্তর ভাটি বাংলার সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে মালজোড় গান খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বাউল শাহ আব্দুল করিম জীবনভর সাধনার সর্বোচ্চ স্বীকৃতি তার একুশে পদক প্রাপ্তি। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক পান। এ পর্যন্ত তার প্রাপ্ত বিভিন্ন পদক ও সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘রাগীব রাবেয়া সাহিত্য পদক ২০০০’ আইডিয়া সংবর্ধনা স্মারক ২০০২’ লেবাক এ্যাওয়ার্ড ২০০৩, মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০০৪’ প্রভৃতি।
বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী বাউল সম্রাটের গানের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। বিলেত প্রবাসীদের আমন্ত্রণে তিনি কয়েকবার বিলেতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন ও গান পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করেন। সিলেট তথা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আগরতলা, শিলচর ও করিমগঞ্জের বাঙালিদের গর্ব বাউল শাহ আব্দূল করিম।
গণসংগীত শিল্পী হওয়ার সুবাদে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য লাভ করেন। তাদের জনসভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করে তিনি জনগণকে মুগ্ধ করতেন।
বাউল করিমের প্রথম গানের বই ‘আফতাব সঙ্গীত’ পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় বই গণসংগীত প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। তৃতীয় বই ‘কালনীর ঢেউ’ ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। ১৫৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটিতে মোট ১৬৩টি গান রয়েছে। প্রতিটি গানেই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে লেখকের আত্ম প্রতীতির স্বাক্ষর বিদ্যমান, যা সহজেই সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করে। চতুর্থ বই ধলমেলা প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। পঞ্চম বই ‘ভাটির চিঠি’ প্রকাশ হয় ১৯৯৮ সালে। বাংলাদেশের অন্যতম পুরস্কার একুশে পদক পেয়েছেন তার অনবদ্য সৃষ্টিশীল রচনার জন্য।