শাহাদাত ও আত্মঘাতী হামলা বিষয়ে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি!

25

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

আত্মঘাতী হামলা ক্রমবর্ধমান একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ সমস্যার আদর্শিক ও ধর্মীয় প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণ থাকলেও র্ধমকে বিশেষত ইসলামকেই বেশি দায়ী করা হচ্ছে। ফলে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে এবং মুসলিমদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। ইসলাম মানব জীবনকে সর্বাধিক মর্যাদা দিয়েছে এবং এ সম্পর্কিত অসংখ্য বিধিনিষেধ নির্ধারণ করেছে; এমনকি জীবন বাঁচানোর তাগিদে বিভিন্ন ইবাদতের মধ্যেরুখসাতের বিধান রেখেছে এবং প্রাণ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টাকে ফরয করেছে। আত্মঘাতী হামলা একটি বহুবিধ হত্যাকন্ড হওয়ায় আসলাম একে কুফরি হিসাবে আখ্য দিয়ে সর্বোচ্চ কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করেছে।
আত্মঘাতী হামলা একটি মানবতা বিরোধী অপরাধ। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটছে। তাই এটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। শাওল শাইয়ের মতে, সর্বপ্রথম আত্মঘাতী হামলা সংঘটিত হয় দশম শতাব্দীতে শী‘আ হাশ্শাশীন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যেঅ অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে এশিয়ার মানুষেরা পাশ্চাতের দখলদারদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে তাদেও বিরোদ্ধে এই আত্মঘাতী হামলার পথ বেছে নেয়। আধুনিক যুগের প্রথম আত্মঘাতী হামলা সংঘটিত হয় ১৯৮৩ সালে লেবাননে। সর্বমোট ৫০টি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে লেবাননে। এর অর্ধেক সংখ্যক হামলা ঘটে সেক্যুলার সংগঠন, কমিউনিস্ট পার্টি, সমাজতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে এবং বাকি অর্ধেক হামলা সংঘটিত হয় লেবাননের মুসলিম দল কর্তৃক। তবে পরবর্তীতে এমন হামলার পরিমাণ অনেক কমে যায়। পক্ষান্তরে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে আত্মঘাতী হামলা দিন দিন বাড়তেই থাকে। বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল সংখ্যালঘু সংগঠন তাদের স্বাধীনতার জন্য শ্রীলংকাতে সংখ্যাগুরু সিনহালিজ গ্রুপের বিরোদ্ধে আত্মঘাতী হামলা ঘটায়। আরেকটি সেক্যুলার সংগঠন ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে তুরস্কে মোট ১৬টি আত্মঘাতী হামলা পরিচালনা করে, যাদের অধিকাংশ ছিল মার্কসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দি, যদিও এর সদস্যরা নামে মাত্র মুসলিম হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে বহু আত্মঘাতী গ্রুপ ও সন্ত্রসী সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে এবং গোটা বিশ্বব্যাপী এই হত্যাকান্ড দিন দিন বেড়েই চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব গ্রুপ ও সংগঠন সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। এবং মানুষের নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। আত্মঘাতী হামলার সামাজিক অথনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও মানসিকসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কিন্ত সম্প্রতি আত্মঘাতী হামলার ভয়াবহতা ধর্মকে লক্ষণীয়ভাবে স্পর্শ করছে। গবেষণায় আত্মঘাতী হামলার সাথে ধর্মের কিছুটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। বিশ্বের প্রধান ছয় ধর্মের অনুসারীদের মাঝে চালিত এক সমীক্ষায় বেড়িয়ে এসেছে, যায়া বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সহযোগিতামূলক কাজে অংশগ্রহণ করে তাদের সাথে আত্মঘাতী হামলার ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু মুসলিমদের মাঝে যারা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত অংশগ্রহণ করে, তাদের সাথে আত্মঘাতী হামলার সম্পর্ক নেই। এতে প্রমাণিত হয় যে, শুধু ইসলামের মূলধারায় যারা একনিষ্ঠ, তাদের আত্মঘাতী হামলার সাথে কোন রকম সম্পর্ক নেই। কোন কোন লেখক আধুনিক যুগের আত্মঘাতী হামলার মূলে একমাত্র ধর্মীয় উগ্রবাদকে দায়ী করেন। আবার কেউ যে কোন সন্ত্রাসী হামলাকে যে কোন উপায়ে শুধু ইসলামের সাথে সম্পর্কিত করেন। এমন প্রচারণা এক দিকে ইসলামের অনুসারীদেরকে দোষারোপ করে বিভিন্ন রকম ভোগান্তিতে ফেলে দিচ্ছে; অন্য দিকে সাধারণ মুসলিম, নওমুসলিম এবং ইসলাম গ্রহণ করতে ও জানতে আগ্রহীদেরকে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে ফেলা হচ্ছে। সর্বোপরি মুসলিমসহ অন্যদেরও সাধারণ জীবন যাপনের নিরাপত্তা বিঘ্ন হচ্ছে। এজন্য মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় উৎসের আলোকে আত্মঘাতী হামলার মূল্যায়ন করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ যদিও কোন ধর্মের অনুসারীদের আচরণের মাধ্যমেই অন্য ধর্মালম্বীরা এই ধর্মকে বিচার করে থাকে; কিন্তু ধর্মে মূলধারা তথা অধিকাংশ অনুসারীদের আচরণই কেবল এমন বিচারে কিছুটা সঙ্গত হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে অনুসারীদের ধর্মগ্রন্থই এবং ধর্মেও মূল ধারার রচনাসমগ্রই তাদের ধর্মকে প্রকৃতভাবে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এর মাধ্যমেই ধর্মকে বিচার করা যৌক্তিক। প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হাসিলে গবেষণার বিশ্লেষণ পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে।আত্মঘাতী হামলা ও প্রাসঙ্গিক পরিভাষা ঃ আত্মঘাতী হামলা : A violent, politically motivated action executed couciously,actively,and with prior intent by a single individual ( or individuals),who kills himself in the course of the operation together with his choosen target, The guaranteed and preplanned death of the perpetrator is a prerequisite for the operation`s success.  একটি সহিংস, রাজনৈতিক প্ররোচনাপ্রসূত কাজ, যা সচেতনার সাথে সক্রিয়ভাবে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এক বা একাধিক বক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়; যে তার অভিযানের স্বার্থে বাছাইকৃত টার্গেটের সাথে নিজেকেও হত্যা করে। অভিযানের সফলতার জন্য অপরাধ সংগঠনকারীর অঙ্গীকারকৃত ও পূর্বপরিকল্পিত মৃত্যু পূর্বশর্ত।
আর্থিক ও অন্যান্য পার্থিব লোভে রাগান্বিত কিংবা হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় নিজের জীবনকে নিঃশেষ করে দেয়া। এতে শুধু ব্যক্তি নিজেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ডুরকেইম বলেন, জ্ঞাতসারে এমন ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক প্রত্যেক কাজ সংঘটিত করা, যা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ব্যক্তিতে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এটি এমন মানবীয় কাজ, যার মাধ্যমে অপর মানুষের প্রাণ নিঃশেষ হয়ে যায়। এটি পৃথিবীর সকল ধর্ম ও সভতায় সর্বোচ্চ দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। বিচারবিধি অনুযায়ী অপরাধের সাজাপ্রপ্ত ব্যক্তির দেহ থেকে তার রুহকে নিঃশেষ করে দেয়া।নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের (যেমন কিসাস, রিদ্দাহ, বিবাহিতের যিনা ইত্যাদি) শাস্তি স্বরুপ দেশের বিচার বিভাগ কর্তৃক অপরাধী জীবন নিঃশেষের যে দন্ড দেয়া হয়। এটি ইচ্ছাকৃত হত্যার অন্তর্ভুক্ত, যা একমাত্র রাষ্ট্রই অপরাধী ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করে থাকে।
শাহাদাত : ধর্মীয় ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় কোন মুসলিম দেশের বা জনগোষ্ঠীর প্রধানের নেতৃত্বে শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিরোধের যুদ্ধে নিহত হওয়া। পৃথিবীতে মানব জীবনের মর্যাদা সর্বাপেক্ষা বেশি। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই মানব জীবনের মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে: আমি তো আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে ওদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; ওদেরকে উত্তম রিযিক দান করেছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর ওদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। শুধু মানুষের জীবনই সুরক্ষিত ও সম্মানিত নয় বরং দেহের প্রতিটি অঙ্গকে সুরক্ষার মাধ্যমে ইসলাম মানুষকে সম্মানিত করেছে। হাদীসের ঘোষণা অনুযায়ী, একজন মুমিনের জান,মাল ও ইজ্জত-আব্রু সম্মানিত ও সুরক্ষিত। মানব জাতির এই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে পৃথিবীর প্রথম মানব আদম ( আঃ) এর সৃষ্টির কাহিনীতে। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যে গুণান্বিত করেছেন যেগুলো অন্যান্য সকল সৃষ্টির উপর মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। তিনি মানব জাতিকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তার রুহ থেকে মানব দেহে ফুঁক দিয়েছেন,মানব জাতিকে তার জ্ঞান থেকে জ্ঞানদান করেছেন, সৃষ্টির প্রথম মানব আদমের সম্মানার্থে ফিরিশতাকুলকে সিজদার নির্দেশ দিয়েছেন, গোটা মানব গোষ্ঠিীকে একই পরিবার থেকে সৃষ্টি করেছেন, তাদেরকে এই পৃথিবী আবাদ করার দায়িত্ব দিয়েছেন এবং তার খলীফা হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। তাই ইসলাম একটি প্রাণ বাঁচানোর মহত্ত্বকে গোটা দুনিয়ার সকল মানুষের প্রাণ রক্ষার মর্যাদাসম করেছে।
মানব জীবনের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ন রাখতে ইসলাম অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়েছে এবং মানব জীবন সুরক্ষাকে ইসলামী আইন দর্শনের (মাকাসিদুশ্ শারী‘য়াহ) ‘পাঁচ অপরিহার্য উদ্দেশ্যের’ (পঞ্চ অপরিহার্যতা) অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই লক্ষ্য হাসিলে ইসলাম বহু ধরনের বিধান প্রণয়ন করেছে। এছাড়াও মানব জীবনে মৌলিক অধিকার ও তৎসংশ্লিষ্ট সকল প্রকার অধিকার নিশ্চিতকরণে ইসলাম সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে।
মানব জীবন সুরক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা অন্যন্য সকল আসমানী গ্রন্থ ও মানব রচিত বিধানের শীর্ষে। যে সব কারনে মানব জীবনের সুরক্ষা হতে পারে এবং যে সব কারণে মানব জীবনের মর্যাদাহানি হতে পারে এমন সব করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মানব জীবনের সকল স্তরে সুস্থ, সবল ও কর্মঠ থাকাই মানব জীবন সুরক্ষার বহিঃপ্রকাশ। তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সকল স্তরে জীবন সুরক্ষার নিমিত্তে ইসলাম সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশ দিয়েছে। এ সকল নির্দেশ মেনে চললে মানুষ তার জীবনকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে পারবে। মানব জীবন বাঁচিয়ে রাখার প্রধান উপকরণ পানাহার। তাই জীবন রক্ষায় ইসলাম স্বাভাবিক অবস্থায় হালাল পানাহারের নির্দেশ দিয়েছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে পানাহারকে ফরয (অত্যাবশক) করে দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা হতে তোমরা আহার কর…। এছাড়াও কুরআনের আরো অনেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা হালাল এবং পবিত্র আহার গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
পৃথিবীতে মানুষের জন্মলাভের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে বৈধ বিবাহের পারিবারিক মাধ্যম। অন্যথায় অবৈধ পন্থায় জন্মলাভকারী শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে বেড়ে উঠে না। চারিত্রিক শিক্ষা থেকেও তারা দূরে অবস্থান করে। ফলে তাদের মাধ্যমে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। এ সকল মানুষ সমাজে এক ধরনের বিচ্ছিন্ন ও মানহীন জীবন যাপন করে থাকে। তাই পৃথিবীতে মানুষের সম্মানকে অক্ষুন্ন রাখতে এবং মানব জীবনের ক্রমধারাকে অব্যাহত রাখতে ইসলাম বিবাহ বিধানের প্রবর্তন করেছে। পাশাপাশি ইসলাম বিবাহের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে যাতে পৃথিবীতে মানব জীবনের বিলুপ্তি না ঘটে। বিবাহ শুধুমাত্র মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য নয় বরং সৎ সন্তান লাভের মাধ্যমে পৃথিবীতে নতুন প্রাণের আবির্ভাব ঘটানো বিবাহ বিধানের অন্যতম লক্ষ্য।
হাদিস শরীফে এসেছে: মা‘কিল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বললো, আমি এক সুন্দরী ও মর্যাদা সম্পন্ন নারীর সন্ধান পেয়েছি, কিন্তু সে বন্ধ্যা। আমি কি তাকে বিয়ে করবো? তিনি বললেন না, অতঃপর লোকটি দ্বিতীয়বার এসেও তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে নিষেধ করলে লোকটি তৃতীয়বার তাঁর নিকট এলে তিনি তাকে বললেন: এমন নারীকে বিয়ে করো যে প্রেমময়ী এবং অধিক সন্তান প্রসবকারী। কেননা আমি অন্যান্য উম্মতের কাছে তোমাদের সংখ্যাধিক্যেও কারণে গর্ব করবো। এ প্রসঙ্গে ইমাম শাতিবীর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, বিবাহের প্রধান এবং প্রথম উদ্দেশ্যই হচ্ছে প্রজনন।
একমাত্র সুশৃঙ্খল পারিবারিক জীবনের মাধ্যমেই নতুন প্রজন্মকে সুস্থ ও সবলভাবে গড়ে তোলা সম্ভব।এজন্য ইসলাম এক পূর্ণাঙ্গ পারিবারিক জীবন বিধান উপহার দিয়েছে, যাতে রয়েছে বংশক্রম রক্ষার সুস্থ পদ্ধতি, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার, সন্তানের অধিকার, পিতা-মাতার অধিকার এবং পারিবারিক আচরণবিধি যার মাধ্যমে একটি সুন্দর পরিবার ও সমাজ সৃষ্টি হতে পারে। ইসলামের সোনালী যুগের পারিবারিক জীবনধারা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই পৃথিবীতে মানবজাতির ক্রমবর্ধমান ধারা অব্যাহত রাখতে এবং মানব সভ্যতার বিকাশে ইসলামের পারিবারিক জীবনবিধান অবশ্যম্ভাবী।
পারিবারিক আর্থিক বিধানের মাধ্যমে ইসলাম মানব জীবনে সুরক্ষাকে নিশ্চিত করেছে। মানব জীবন সুরক্ষার অধিকাংশ উপকরণই অর্থ ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। পরিবারের একজন সক্ষম ব্যক্তি নিজেই তার জীবিকা উপার্জন করতে পারে। পক্ষান্তরে, পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধসহ যারা জীবিকা অর্জন করতে অক্ষম, জীবন রক্ষার নিমিত্তে ইসলাম পরিবারের সক্ষম ব্যক্তিদের উপর তাদের জীবিকার দায়িত্ব অর্পণ করেছে। উলামায়ে কিরামের ইজমা সংঘটিত হয়েছে যে, সম্পদহীন অক্ষম সন্তানদের জীবিকার জন্য ব্যয় করা পিতা- মাতার উপর ফরয। মহান আল্লাহ বলেন: যদি তারা তোমাদের সন্তানদিগকে স্তন্যদান করে, তবে তাদেরকে পারিশ্রমিক দিবে। হাদিস শরীফে এসেছে: আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, হিনদ্ বিনতে উতবা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ লোক। আমাকে এ পরিমাণ খরচ দেন না, যা আমার ও আমার সন্তানদের জন্য যথেষ্ট; তবে তার অজানাতে যা আমি (চাই) নিতে পারি। তখন তিনি বললেন: তোমার ও তোমার সন্তানদের জন্য নিয়মানুসারে যা যথেষ্ট হয় তা তুমি ( তার অজানাতে ) নিতে পার।
উল্লেখ্য যে, স্বাভাবিক অবস্থায় স্বামীর বিনা অনুমতিতে তার সম্পদ ব্যয় করার অধিকার স্ত্রীর নেই, কিন্তু স্ত্রীর নিজের ও তার সন্তানদের জন্য নিয়মানুসারে যথেষ্ট হয় এমন পরিমাণ সম্পদ স্বামীর অগোচরে তার থেকে ব্যয় করার অনুমতি ইসলাম স্ত্রীকে প্রদান করেছে। এই অনুমোদনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব জীবনকে সুরক্ষা করা। তবে এ ক্ষেত্রে নিয়মানুসারে যথেষ্ট হয় শুধু এ পরিমাণ সম্পদ ব্যয়ে স্ত্রীর সততা একান্তই জরুরী। অনুরুপভাবে, সম্পদহীন পিতা-মাতার জন্য ব্যয় করা সন্তানের উপর ফরজ; এবং এ ব্যাপারেও স্কলারদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অধিকাংশ স্কলারের মতে, দাদা-দাদী, নানা- নানী ও তদূর্ধ্বেও জন্য এবং নাতি-নাতনি ও তদনিম্নের জন্য একই বিধান প্রযোজ্য। ইসলামের এই যুগান্তকারী পারিবারিক বিধানের লক্ষই হচ্ছে মানব জীবনকে সুরক্ষা করা।
স্বাভাবিক অবস্থায় মানব জীবন সুরক্ষার জন্য ইসলাম হালাল পানাহারের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু যখন কোন ব্যক্তি ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ে এবং তার জীবন রক্ষার জন্য ন্যূনতম পানাহার আবশ্যক হয়ে পড়ে, ঠিক সেই মুহূর্তে ইসলাম এমন ব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ পানাহার গ্রহনের সাময়িক অনুমোদন দিয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহর অসংখ্য দলীলের পাশাপাশি উলামায়ে কিরামের ইজমা হয়েছে যে, জীবন রক্ষার জন্য বাধ্য হলে হারাম পানাহার গ্রহণ করা বৈধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: নিশ্চয় আল্লাহ মৃত জন্তু, রক্ত, শূকর-মাংস এবং যার উপর আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্যের নাম উচ্চইরত হয়েছে, তা তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। কিন্তু যে অন্যোনাপায় কিন্তু নাফরমান কিংবা সীমালঙ্ঘনকারী নয় তার কোন পাপ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। এছাড়াও কুরআনের অন্যান জায়গায় এমন অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
সুস্থতা সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে মানব জীবনের এক অপারনিয়ামত। মানুষের ইহলৌকিক দায়িত্ব-কর্তব্য এবং পরলৌকিক ইবাদত-বন্দেগী ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে সুস্থতা অত্যন্ত জরুরী। পক্ষান্তরে রোগ-ব্যাধিও আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মানুষের ঈমান ও নৈতিক উন্নয়নের পন্থা ও পরীক্ষা স্বরূপ। একারণে জীবন রক্ষার তাগিদে রোগ প্রতিরোধে ইসলাম ঔষধ গ্রহণ করতে নির্দেশনা দিয়েছে। শুধু তাই নয় বরং অসুস্থতা ও ঔষধ গ্রহণের পূর্বেই ইসলাম নিবৃত্তিমূলক চিকিৎসা ও প্রতিষেধক চিকিৎসার উভয় প্রকার চিকিৎসার নির্দেশনা দিয়েছেন। নিবৃত্তিমূলক চিকিৎসা হিসেবে যা কিছুই রোগের কারণ হতে পারে তা থেকেই ইসলাম বারণ করেছে। উদাহরণ স্বরুপ পানাহারে অপচয় সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেন: মানুষ পেট হতে অধিক নিকৃষ্ট কোন পাত্র পূর্ণ করে না। মেরুদন্ড সোজা রাখতে পারে এমন কয়েক গ্রাস খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য,এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে। প্রতিষেধক চিকিৎসা হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আধ্যাত্মিক চিকিৎসা যেমন ঝাড়ফুঁক ও দোয়া এবং বস্তুগত চিকিসা যেমন রোগের উপযুক্ত ঔষধ গ্রহণ ইত্যাদি শিক্ষা দিয়েছেন। অপরপক্ষে ,মানুষের জীবন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উপর সকল প্রকার সীমা লঙ্ঘনকে ইসলাম হারাম করেছে; এবং এগুলোকে কবীরা গুনাহ ( বড় অপরাধ) হিসেবে ঘোষণা করেছে। এমন সীমা লঙ্ঘনকে বন্ধ করতে ইসলাম মৌলিক শাস্তি যেমন কিসাস, রক্তমূল্য; বদলামূলক শাস্তি যেমন রক্তমূল্য, প্রহার, রোজা; এবং অনুগামী শাস্তি যেমন ওসিয়ত, উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি বিধান প্রবর্তন করেছে। (অসমাপ্ত)