আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন চরম রূপ নিলেও পটভূমিটা তৈরি হয়েছিল আরও পাঁচ বছর আগেই। সাতচল্লিশে পাকিস্তান জন্মের পূর্ব থেকেই মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার বিষয়ে সচেতন ছিলেন পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক নেতারা। তাই ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু হয় মায়ের ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে নানা কর্মসূচী। আর সেই সময় ভাষার চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন অনেকেই। তাদেরই অন্যতম একজন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের এক অনিবার্য চরিত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
ইতিহাসের ধারাভাষ্য অনুযায়ী, ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্ব থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শেখ মুজিব। ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হকের একটি লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্ম নিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক চেতনার যুব সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ। সেদিনই অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রগতিশীল চেতনার এই সংঠনের সম্মেলনের। ঢাকা মিউনিসিপালিটির ভাইস চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসনাতের বাড়িতে অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেছিল খাজা নাজিমুদ্দিন। সেই বাধা উপেক্ষা করেই হয়েছিল সম্মেলন। আর সেই সম্মেলনে ভাষাসংক্রান্ত প্রস্তাবকে উপস্থাপন করেছিলেন সেই সময়ের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সাধু ভাষায় পঠিত সেই প্রস্তাবে তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবেÑ সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়ে দেওয়া হউক। জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক’। এভাবেই বায়ান্নার আগে সাতচল্লিশেই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ভাষার দাবি। শুধুই তাই নয়, মাতৃভাষায় বিনা খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পাওয়ার মৌলিক অধিকারের দাবিও উচ্চারিত হয়েছিল সেই সম্মেলনে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিও করা হয়েছিল ওই সম্মেলনে।
মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে ১৯৪৮ সালের মার্চে গঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ মার্চ ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। এর আগে ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক পরিষদের একটি সভা হয়েছিল সেই সভায় পরদিন ধর্মঘটের বিষয়ে অনেকেই সরকারের আপোসের পথ খুঁজছিলেন। কিন্তু আপোসকামিতাকে ধিক্কার দিয়ে গর্জে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ। তিনি বলে উঠলেন, ‘সরকার কি আপোসের প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে।’ এমন সোচ্চার উচ্চারণে শেখ মুজিবকে সমর্থন দিয়েছিলেন অলি আহাদ, তোয়াহা, শওকত, শামসুল হক প্রমুখ। তাদের সমর্থনে ভেস্তে গিয়েছিল আপোসকামীদের ষড়যন্ত্র। ১১ মার্চের হরতাল ও পিকেটিংয়ের সময় সেক্রেটারিয়েটের সামনে থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদসহ অনেকে। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাতকারে অলি আহাদ বলেছিলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছতেন তাহলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না।’
১১ মার্চের সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা পূর্ব পাকিস্তানে। অবস্থার অবনতি দেখে খাজা নাজিমুদ্দিন আপোসের কথা তুললেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর ৮ দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের সময় যেহেতু বঙ্গবন্ধুসহ ভাষা আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা কারারুদ্ধ ছিলেন তাই কারাগারে চুক্তির খসড়া নিয়ে গিয়ে তাদের সম্মতি নেয়া হয়। শর্তানুসারে ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুসহ বাকি নেতারা মুক্তি পেলেন। এদিকে জেল থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধু অনুভব করলেন পুলিশি জুলুম ও সরকারের গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা তাদের দাবি আদায়ে বদ্ধপরিকর। তাদের মনের কথাটি বুঝতে পারলেন বঙ্গবন্ধু। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিব। সভা শেষে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করতে তিনি ছাত্র-জনতাকে সঙ্গী করে ব্যবস্থাপক সভা ঘেরাও করেন। সেখানে পুলিশি লাঠিচার্জের পাশাপাশি কাঁদানে গ্যাস ছাড়া হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিও ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। সেই সময় কারাবন্দী থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন শেখ মুজিব। তিনি কারাবন্দী অবস্থাতেই ওই ধর্মঘটের সমর্থন দিয়েছিলেন। ধর্মঘটের দিন মিছিল নিয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করেছিল ছাত্র-জনতা। মিছিল শেষে পরবর্তী ঘোষণার জন্য সকলে সমবেত হয়েছিল বেলতলায়। সে সময় শামসুল হক চৌধুরী, গোলাম মওলা, আব্দুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে শেখ মুজিব বাতা পাঠান যে একুশের দেশব্যাপী হরতালের প্রতি তিনি সমর্থন দিয়েছেন। সঙ্গে ছিল একটি বাড়তি উপদেশ। সেটা হলোÑ মিছিল করে সেদিন আইনসভা ঘেরাও করতে হবে এবং বাংলা ভাষার প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। এছাড়াও মুজিব আরও একটি খবর পাঠিয়ে বলেন যে, তিনি এবং মহিউদ্দিন সাহেব রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন। একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল হবে। এদিকে অনশনের নোটিস দেয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি।
পরবর্তীতে ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে সভা হয়। পরবর্তীতে একুশে রক্তঝরা সংগ্রামে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মুসলিশ লীগ সরকার। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। এভাবেই ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণের পাশাপাশি সেই আন্দোলনকে নানাভাবে এগিয়ে নিয়েছিলেন মুজিবুর রহমান।