ফের সুষ্ঠু নির্বাচনের নজির সৃষ্টি করল নির্বাচন কমিশন ॥ ষষ্ঠ ধাপের ইউপি ভোটে কোন প্রাণহানি ঘটেনি

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আবারও সুষ্ঠু নির্বাচনের উদাহরণ সৃষ্টি করল ইসি। ষষ্ঠ ধাপে দেশের ২২ জেলায় ৪২ উপজেলার ২১৮টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ভোটের দিন কোন প্রাণহানি ঘটেনি। এতে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। এছাড়া দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে সে বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এর আগে ১৬ জানুয়ারি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচন দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। আর সর্বশেষ ৩১ জানুয়ারি দেশের ২১৮টি ইউপি নির্বাচনও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। যদিও এ নির্বাচনে বিচ্ছিন্নভাবে ছোটখাট কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে। তবে তা আগের ৫ ধাপের ইউপি নির্বাচনের তুলনায় খুবই কম। ষষ্ঠ ধাপের নির্বাচনেও সহিংসতার আশঙ্কা করেছিল বিভিন্ন মহল। কিন্তু সেই আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই নির্বাচন হয়। এ কারণে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এ নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক কোন মন্তব্য করতে পারেনি। তবে ইলেক্ট্রনিক মেশিনে (ইভিএম) ভোটের গতি ধীর হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কোন কোন মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও ইভিএমে ভোটের গতি ধীর হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের মেয়াদের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো ষষ্ঠ ধাপের ইউপি নির্বাচনও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করে উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য আগে থেকেই ভোট কেন্দ্রগুলোকে কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখে। তাই শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করে। তবুও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু এলাকায় পরস্পরবিরোধী প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ছোটখাট কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে। তবে এরসঙ্গে জড়িত থাকায় পুলিশ বেশ ক’জনকে আটক করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
ষষ্ঠ ধাপের ইউপি ভোটের দিন পরিবেশ শান্ত রাখতে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করে নির্বাচন কমিশন। ভোট গ্রহণকালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মনিটরিং সেলের কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে পরিচালিত হয়। এ সেলের কার্যক্রমের মধ্যে ছিল-১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে অবগত করা। ২. সেলে অন্তর্ভুক্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধির মাধ্যমে নির্বাচন উপলক্ষে মোতায়েন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবস্থা ও সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানানো। ৩. সংস্থার নিজস্ব যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কমিশনের নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করা। ৪. ভোটকেন্দ্র বা নির্বাচনী এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করা। ৫. বিভিন্ন নির্বাচনী মালামাল পরিবহন, বিতরণ এবং ভোটগ্রহণ কাজে নিরাপত্তা বিধানের জন্য মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় করে রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসারদের সহায়তা দেয়া।
ষষ্ঠ ধাপে ২২ জেলায় ৪২ উপজেলার ২১৮টি ইউপি নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৪১ লাখ ৮২ হাজার ২৬৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২১ লাখ ১৪ হাজার ৭২০ ও নারী ভোটার ২০ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৭ জন। এছাড়াও ছয়জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ছিলেন। ভোটারদের ভোটদানের সুবিধার্থে ২ হাজার ১৮৬টি কেন্দ্রে ১৩ হাজার ৩০৫টি কক্ষে ভোট গ্রহণ করা হয়। এ নির্বাচনে বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১১ হাজার ৬০৪ জন প্রার্থী। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে ১ হাজার ১৯৯ জন। সংরক্ষিত নারী সদস্য পদে ২ হাজার ৫৫৯ এবং সাধারণ সদস্য পদে ৭ হাজার ৮৪৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবে ২১৮ ইউপির মধ্যে ২১৬টিতে ইভিএমে ভোট হওয়ায় আগের ৫ ধাপের তুলনায় এবার কম ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতে এ নির্বাচনে ভোট পড়েছে শতকরা ৫৫ ভাগ।
এর আগের ৫ ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংস ঘটনায় শতাধিক মানুষ নিহত হন। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ৫ম ধাপের নির্বাচনের দিনও সহিংস ঘটনায় ৬ জন নিহত হন। এ কারণে ষষ্ঠ ধাপের ইউপি নির্বাচনের আগে ব্যাপক সতর্কতামূলক কার্যক্রম হাতে নেয় ইসি। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ষষ্ঠ ধাপের নির্বাচনের একদিন আগে রবিবার থেকেই প্রতিটি নির্বাচনী এলাকাকে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে আনে। ভোটগ্রহণকালে প্রতিটি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ জন করে সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। সব ইউপিতে পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে একটি করে মোবাইল ফোর্স টিম এবং প্রতি ৩টি ইউপিতে ১টি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স টিম মোতায়েন করা হয়েছিল। আর প্রতিটি উপজেলায় র‌্যাবের ২টি মোবাইল টিম ও একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স টিম, বিজিবির ২টি মোবাইল ফোর্স টিম ও ১টি স্ট্রাইকিং ফোর্স টিম দায়িত্ব পালন করে।
গতবছর ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর দুই পর্বে প্রথম ধাপের ৩৬৯টি ইউপিতে এবং ১১ নবেম্বর দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৩টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২৮ নবেম্বর তৃতীয় ধাপে ১ হাজার ৭ ইউপিতে ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপে ৮৪০টি ইউপিতে এবং এ বছর ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপে ৭০৭ ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তম ধাপে ১৩৮ ইউপিতে নির্বাচন হবে ৭ ফেব্রুয়ারি এবং আরও ৮টি ইউপিতে নির্বাচন হবে ১০ ফেব্রুয়ারি। বর্তমানে দেশে চার হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এরমধ্যে অল্প কিছু ইউপি ছাড়া বাকি সব ইউপির নির্বাচনই ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হয়ে যাবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিদায় নেবে। তারপর নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে বাকি ইউপির নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ইতোমধ্যে ৯ বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে ১৯৭৩ সালে প্রথম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয়, ১৯৮৩ তৃতীয়, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ, ১৯৯২ সালে ৫ম, ১৯৯৭ সালে ষষ্ঠ, ২০০৩ সালে ৭ম ও ২০১১ সালে ৮ম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নবম ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দলীয় প্রতীকে। আর এবার দ্বিতীয়বারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ষষ্ঠ ধাপের ইউপি ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন সচিব মোঃ হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সংবাদ সম্মেলন করে জানান, ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু এবং সুন্দর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। তবে দেশে প্রচ- শীত পড়ার কারণে ষষ্ঠ ধাপে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল কম। ইভিএমে ভোটগ্রহণে ধীরগতি ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এ কারণে ৫৫ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কোন অপ্রীতিকর খবর পাওয়া যায়নি। কোন কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়নি।
অভিজ্ঞমহলের মতে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নজিরবিহীন সুষ্ঠু হওয়ার পর দলীয় সরকারের অধীনেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে এ বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর ষষ্ঠ ধাপের ইউপি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনায় আরও বেশি প্রাধান্য পায়। নাসিক নির্বাচনের মতো ষষ্ঠ ধাপের ইউপি ভোটের দিনও পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। সকল প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছেন। দু’একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া এ নির্বাচনে কোন সংঘাত-সহিংসতা বা কোন অনিয়মের অভিযোগ উঠেনি।
নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার কারণে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ষষ্ঠ ধাপের ইউপি ভোট হয়। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে নারী ও নতুন ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে বয়স্ক ভোটারদের মধ্যে কারও কারও আঙ্গুলের ছাঁপ বার বার চেষ্টার পরও না মেলার কারণে তারা ভোট দিতে পারেননি। এছাড়া কেউ কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে না নিয়ে যাওয়ায় ভোট কেন্দ্রে কিছুটা বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। তবে ভোটের আগে কোন কোন মহল থেকে সহিংসতার আশঙ্কা করায় নির্বাচন নিয়ে প্রার্থী-সমর্থকদের মধ্যে ছিল টান টান উত্তেজনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ক’টি সহিংসতা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে ভোট সম্পন্ন হয়েছে।
কে. এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই কমিশনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সমালোচনা অব্যাহত রাখে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই কমিশনের বিরুদ্ধে সমালোচনার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। সর্বশেষ ৫ ধাপের ইউপি নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ থাকায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল ব্যাপক সমালোচনা করে। এ কারণে এই কমিশন ছিলেন কিছুটা বেকায়দায়। তাই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ একেবারে শেষ প্রান্তে এসে প্রথমে নাসিক নির্বাচন ও পরে ইউপির ষষ্ঠ ধাপের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপরতা জোরদার করার নির্দেশ দেয়। এতে সফলও হয়।