মাতৃভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা

3

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাসই নয়, মাসটি মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধের বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসে। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেজন্য আমাদের গৌরব করার কারণ নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু যে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বায়ান্নতে মাতৃভূমির অকুতোভয় সন্তানেরা জীবন দিয়েছিলেন সে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষায় ব্যর্থ হলে পরম গৌরবময় সেই আত্মদান বৃথা যাবে। তাই ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর সবচেয়ে বড় উপায় হলো বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও শুদ্ধতা এবং সৌন্দর্য যাতে অক্ষুণ্ন থাকে সে লক্ষ্যে সক্রিয় থাকা। মাতৃভাষা সহজাতভাবেই মানুষ আয়ত্ত করে থাকে বটে, যদিও তার চর্চা বা প্রয়োগে সচেতন না হলে সে ভাষার শুদ্ধতা ও বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। ভাষা ব্যবহারে হেলাফেলা ও অসতর্কতার কারণে শুদ্ধতা হারাতে পারে প্রাণের ভাষা- এটা মনে রাখা কর্তব্য। ভাষার মাস তাই ভাষার প্রতি ভালবাসা প্রকাশের পাশাপাশি দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতনতার মাসও। ভাষার মাসে মাতৃভাষার প্রতি মানুষের ভালবাসা জাগিয়ে তোলা এবং ভাষা-সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটি তাৎপর্যপূর্ণভাবে শুরু করা এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন। নবীন শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, আকাক্সক্ষা আর স্বপ্নের আদান-প্রদান মাতৃভাষার মাধ্যমেই সবচেয়ে সফলভাবে সম্পন্ন হতে পারে। এটাও অনস্বীকার্য যে, ভাষার প্রতি ভালবাসা লালনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব ভাষাভাষী মানুষের প্রতি সম্প্রীতি ও মমতা তৈরি হয়, যা সুখে-দুঃখে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে একে অন্যকে পাশে রাখে। আশঙ্কার বিষয় হলো, বাংলা ভাষায় ইংরেজীসহ বিদেশী শব্দের অযথা প্রবল অনুপ্রবেশ ঘটছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা আবশ্যক। লক্ষ্য রাখতে হবে বাংলা ভাষার বিশুদ্ধতা যেন বজায় থাকে।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন দেশের প্রধান সাংস্কৃতিক ঘটনা। ভাষার মাসজুড়ে জাতীয় মননের প্রতীক বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে একাডেমি প্রাঙ্গণ ও অধুনা সোহাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিবছর আয়োজন হয়ে থাকে প্রাণের গ্রন্থমেলা। লেখক-পাঠকদের প্রকৃত মিলনমেলায় পরিণত হয় এই মেলা। উদ্যাপিত হয় নতুন বইয়ের মহোৎসব হিসেবে। বছরের আর কোন সময় বাংলা ভাষায় এত বিপুল সংখ্যক বই প্রকাশ হয় না। সেদিক দিয়ে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিকে হাজারো বইয়ের প্রকাশের মাস হিসেবেও অভিহিত করা চলে। বছরের এই একটি মাসের জন্য লেখক-পাঠক-পুস্তক ব্যবসায়ীরা আগ্রহভরে প্রতীক্ষায় থাকেন।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এবারও করোনা মহামারীর কারণে যথাসময়ে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। আপাতত প্রাথমিক প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে দেশে করোনা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রদান শুরু হয়েছে সর্বস্তরে। শেষ পর্যন্ত সব কিছুই নির্ভর করবে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতির ওপর। চল্লিশের দশকের এক কবি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’ সেই সুরে সুর মিলিয়ে আমরাও যেন বলতে পারি, যথাসময়ে না হলেও এটিও মূলত অমর একুশে গ্রন্থমেলাই। প্রভাতফেরি না হলেও যেন সমস্বরে সবাই গাইতে পারি- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’, কিংবা ‘মোদের গরব মোদের আশা/আমরি বাংলা ভাষা।’