উৎপাদন বাড়লেও লোকসানের মুখে চা শিল্প

3

চুনারুঘাট থেকে সংবাদদাতা :
চায়ের উৎপাদন বাড়লেও মূল্য কমে যাওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে হবিগঞ্জের লস্করপুর ভ্যালির চা বাগানগুলো। উৎপাদনের প্রথমদিকে নিলামে চায়ের প্রতি কেজি গড়ে ২শ টাকা হলেও শেষ দিকে নিলামে দাম উঠেছে প্রতি কেজি ১৪০ টাকা। যেখানে এক কেজি চা উৎপাদনে খরচ হয় ১৮০ টাকা থেকে ২শ টাকা, সেখানে নিলামে চায়ের বিক্রয়মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৪০ টাকা। এতে ভ্যালির চা বাগানগুলো লোকসানের দিকে যাচ্ছে।
হবিগঞ্জের লস্করপুর ভ্যালির ১৭টি চা বাগানে ২০২১ সালে উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ৬৯৬ কেজি চা পাতা; যা ২০২০ সালের চেয়ে ১৫ লাখ ২৩ হাজার ২৫ কেজি বা ১৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। তবে ২০১৬ সালে ভ্যালিতে রেকর্ড ১ কোটি ৩২ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল। ভ্যালিতে চায়ের উৎপাদন বাড়লেও বাড়েনি চায়ের মূল্য। ২০২০ সালে নিলাম বাজারে প্রতি কেজি চায়ের গড় মূল্য ১৯০ টাকা হলেও ২০২১ সালে চায়ের মূল্য মারাত্মক হারে কমে গেছে।
২০২১ সালের প্রথম দিকে নিলামে প্রতি কেজি চায়ের মূল্য ২শ থেকে ২২০ টাকা হলেও বছরের শেষে দিকে চায়ের মূল্য কমে দাঁড়ায় ১৪০ টাকা। আগামী নিলামে এ মূল্য আরো কমে ১৩০ টাকায় নামতে পারে বলে চা সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কায় রয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ২০২১ সালে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু চাহিদা সেভাবে বাড়েনি। গত দুই বছর ধরে দেশে করোনার থাবায় চাহিদা কমে যাওয়া, নতুন বাজার সৃষ্টি না হওয়া এবং বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকেই তারা দায়ী করছেন।
চা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরি ১২০ টাকা হলেও তাদের রেশন, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ সকল সুবিধা দিতে হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান বাজারে সার, কীটনাশকসহ সকল পণ্যেও দাম বেড়েছে। বেড়েছে মেশিনারি সব যন্ত্রের। এ অবস্থায় বর্তমানে এক কেজি চা তৈরি খরচ পড়ছে ১৮০ টাকা থেকে ২শ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে চায়ের মূল্য প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। এ অবস্থায় উৎপাদন বাড়লেও লোকসান হচ্ছে বাগান কর্তৃপক্ষের।
ভ্যালির ডানকান ব্রাদার্স ও দেউন্দি টি কোম্পানির চায়ের মূল্য একটু বেশি হলেও তা উৎপাদনের খরচের চেয়ে কম। ফলে ভ্যালির ছোট-বড় ২৫টি চা বাগানই শঙ্কায় রয়েছে। ঋণ আর ভর্তুকি দিয়ে চলতে হচ্ছে তাদের।
লস্করপুর ভ্যালির চেয়ারম্যান ও তেলিয়াপাড়া চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ২০২১ সালের চা মৌওসুমের শুরুতেই খরার আঘাত আসে চা শিল্পে। মৌসুমের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বৃষ্টি কম থাকায় এবং খরার কারণে আমরা উৎপাদন পাইনি। এছাড়া খরার কারণে চা বাগানে রেড স্পাইডার ও হেলোফিলিস রোগে আক্রান্ত হয় অনেক বাগান। তার মধ্যে চা গাছে এক ধরনের মশার উৎপাত বেড়েছে গত তিন বছর ধরে। ফলে মৌসুমের প্রথম চার মাসে ভ্যালিতে ৪০ শতাংশের বেশি চা উৎপাদন হয়নি। তবে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আমরা উৎপাদন পেয়েছি অনেকগুণ।
এতে ভ্যালির উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু বাজার সিন্ডিকেট নিলামে চায়ের মূল্য ১৪০ টাকা থেকে ১৫০ টাকার ওপরে চা কিনছে না। কিন্তু আমরা বাজার থেকে প্যাকেটজাত চা ৩শ থেকে ৫শ টাকা কেজি কিনে খাচ্ছি। এ সিন্ডিকেট না ভাঙলে চায়ের মূল্য বাড়বে না বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি চায়ের নিলাম মূল্য কমপক্ষে আড়াইশ টাকা নির্ধারণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
চন্ডিছড়া চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক চৌধুরী মুরাদ আহমেদ বলেন, চা বাগান এখন আগের অবস্থানে নেই, চায়ের উৎপাদনে এখন নানা প্রতিকূলতা যোগ হয়েছে। বেড়েছে শ্রমিকদের খরচ, বেড়েছে গ্যাস বিদ্যুতের দাম, বেড়েছে চায়ের প্রক্রিয়াজাতের খরচ, কিন্তু বাড়ছে না চায়ের মূল্য। দিন দিন চায়ের নিলামে মূল্য কমছে। তিনি চায়ের মূল্য নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন।
দেউন্দি চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক রিয়াজ রহমান জানান, চা শিল্প দিন দিন লোকসানের দিকে যাচ্ছে। কারণ প্রতিদিন চায়ের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, কিন্তু চায়ের বাজার মূল্য কমছে। উৎপাদনের সঙ্গে বিক্রয়মূল্য সামঞ্জস্য না থাকলে ক্ষতির মধ্যে পড়বে চা শিল্প।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের দেউন্দি টি কোম্পানির চা নিলামে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা। অথচ আমাদের প্রতি কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ১৮০ টাকার বেশি। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে আমাদের প্রায় অর্ধেক সময় সেচ দিয়ে চা উৎপাদন করতে হচ্ছে। তাছাড়া খরাসহ নানা রোগের আক্রমণ তো আছেই। সবমিলিয়ে চা বাগানগুলো লাভের মুখ দেখতে গেলে নিলামে চায়ের মূল্য নির্ধারণ জরুরি।