কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহাসড়কে অপরাধ প্রতিরোধ, নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন ও দুর্ঘটনা রোধে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। ইতোমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ২৫০ কিলোমিটারজুড়ে ৪৯০টি স্পটে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। সার্বক্ষণিকনজরদারি বাড়াতে চারটি জোনে ভাগ করা হয়েছে মহাসড়ক। এসব জোনের ২৫০ কিলোমিটারজুড়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করার কাজ শুরু হয়েছে। এই চারটি জোনে ১৪২৭টি সিসি ক্যামেরা বসছে। তারমধ্যে লংভিশন পিটিজেড ডোম ক্যামেরা ১৬টি, পিটিজেড ডোম ক্যামেরা ৪৭১টি, বুলেট ক্যামেরা ৯২৪টি ও চেকপয়েন্ট ক্যামেরা আছে ১৬টি। ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-খুলনাসহ সবকটি মহাসড়কে চলতি বছরের মধ্যেই ক্যামেরাগুলো স্থাপন করার কথা রয়েছে। এডিপির অর্থায়নে পুলিশের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে উর্ধতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়।
সূত্রগুলো জানায়, যাত্রীদের নিরাপত্তা ও যান চলাচল নির্বিঘ্ন করার পাশাপাশি দুর্ঘটনা ও অপরাধ প্রতিরোধ করতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশের বিশেষ ইউনিট হাইওয়ে পুলিশ। ইতোমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ২৫০ কিলোমিটারজুড়ে ৪৯০টি স্পটে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বিদ্যুত বিভাগ থেকে এসব ক্যামেরার অনুমোদন নেয়া হয়েছে। ওইসব স্থাপনে জমা দেয়া হয়েছে ১১৪টি লাইটপোলের প্রতিবেদন। পাশাপাশি ডাটা সংযোগের জন্য বিটিসিএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়েছে। মেঘনাঘাট হাইওয়ে কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার মনিটরিং ও ডাটা সেন্টার স্থাপন করার কাজ প্রায় শেষের দিকে।
সিসি ক্যামেরার বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু হওয়ার পর অটোমেটিক নাম্বার প্লেট শনাক্ত করা, যানবাহনের গতিপথ শনাক্ত, হাইস্পিড ডিটেকশন ও ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করা যানবাহন দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হবে। ক্যামেরাগুলো স্থাপন হলে অন্ধকার ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায়ও স্পষ্ট ছবি ক্যাপচার ও রাস্তায় চলাচলরত যানবাহনের নম্বর প্লেটের ছবি ক্যাপচার ও সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
তিনি জানান, কোথাও কোন ঝামেলা বা অপরাধের কারণে লোকসমাগম বেশি হলে মনিটরিং সেলে আগাম সংকেত বার্তা চলে আসবে। যানজট নিরসনেও কার্যকর ভুমিকা থাকবে। সিসিটিভির ফুটেজ প্রায় এক মাস ধরে সংরক্ষণ করা যাবে এবং ভবিষ্যতে ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনে সহায়ক হবে। যানবাহনের হাইস্পিড মাপতে যন্ত্রাংশ বসানো হবে মহাসড়কগুলোতে।
এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মল্লিক ফখরুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা ও অপরাধ, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। দেশের সবকটি মহাসড়কে নিরাপত্তায় হাইওয়ে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বসানো হচ্ছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। ইতোমধ্যে একটি কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। ক্যামেরাও শিপমেন্ট হয়েছে। বেশ কিছু স্থানে ক্যামেরা স্থাপন হয়েছে। আশা করি আগামী দুই মাসের মধ্যে সব পয়েন্টে ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপনের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, মহাসড়কে যানবাহনের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চালকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক কথা বলছে পুলিশ। সিসি ক্যামেরাগুলো স্থাপন হয়ে গেলে যে কোন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তাছাড়া মাদক পাচাররোধ, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার, চোরাচালান প্রতিরোধ ও অভিযুক্তদের ধরতে পুলিশের বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, এডিপির অর্থায়নে পুলিশের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে বৈঠক করেন উর্ধতন কর্মকর্তারা। সেখানে হাইওয়ে পুলিশের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় প্রকল্প পরিচালক জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৫০ কিলোমিটার রাস্তায় ১৪২৭টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো নিয়ে আলোচনা হয়। ক্যামেরাগুলো বসবে ৪৯০টি স্পটে। এসব ক্যামেরার মাধ্যমে মহাসড়কে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা সম্ভব হবে। হাইওয়ে মনিটরিং সিস্টেমের চূড়ান্ত সার্ভে সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য ১১৪টি লাইট পোলের প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। দেশের বাইরে থেকে সিসি ক্যামেরাও আনা হয়েছে। মেঘনাঘাট হাইওয়ে কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার মনিটরিং ও ডাটা সেন্টার স্থাপনের কাজ চলছে। ডাটা সংযোগের জন্য বিটিসিএলএর সঙ্গে খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। সার্বক্ষণিক নজরদারি, বাড়াতে চারটি জোনে ভাগ করা হয়েছে মহাসড়ক। জোনগুলো হচ্ছে- ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম লাইন। এসব জোনের ২৫০ কিলোমিটারজুড়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করার কাজ শুরু হয়েছে। এই চারটি জোনে ১৪২৭টি সিসি ক্যামেরা বসছে। তারমধ্যে লংভিশন পিটিজেড ডোম ক্যামেরা ১৬টি, পিটিজেড ডোম ক্যামেরা ৪৭১টি, বুলেট ক্যামেরা ৯২৪টি ও চেকপয়েন্ট ক্যামেরা আছে ১৬টি। কখনও বিদ্যুত চলে গেলে ব্যাকআপ পাওয়ার সিস্টেমসহ ৪৯০টি ক্যামেরার পোল রয়েছে। পাশাপাশি ১টি সেন্ট্রাল কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার, ৫টি মনিটরিং সেন্টার, ৫ পেটাবাইটের ডাটা সেন্টার, ডাটা সেন্টারের মডিউলার সিস্টেম (এসিসহ), নেটওয়ার্ক সিস্টেম, ভিডিও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ভিপিও এ্যানালাইসিস সিস্টেম ও অটোমেটিক নম্বর প্লেট রিকগনিশন সিস্টেম রয়েছে। এই মহাসড়কে ক্যামেরা স্থাপনের পর অন্য মহাসড়কগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ শুরু হবে।
তাছাড়া সড়কে দুর্ঘটনাজনিত মামলাগুলোর তদন্তে কাজ করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মহাসড়কে কোন অপরাধ ঘটলে ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের শনাক্ত করতে একাধিক আধুনিক এ্যাপ্লিকেশন সমন্বিত বিশ^মানের আইটি সেকশন স্থাপন করা হচ্ছে। যার ফলে কোন সড়কে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে গেলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ধরা পড়ে যাবে অপরাধী।
হাইওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকা ঘিরে সরকারের বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি প্রতিদিনই বন্দর থেকে কাভার্ডভ্যানে করে ঢাকায় মালামাল নিয়ে আসা হচ্ছে। আবার একইভাবে ঢাকা থেকেও বিভিন্ন মালামাল চট্টগ্রামে যাচ্ছে। চাঁদাবাজি ও সড়কে কাভার্ডভ্যান থেকে মালামাল লুটের অভিযোগ ওঠে আসছিল। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের জুন মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সড়ক পরিবহন টাস্কফোর্সের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভায় সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান, সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা, পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ এবং টাস্কফোর্সের অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পুরোপুরি ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিভাবে দুর্ঘটনা হয়েছে, কে সড়কে গাড়ি নামালো, সবগুলোই আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আমাদের পুলিশ বাহিনী সিসি ক্যামেরায় দেখতে পাবেন কে কি করছেন। মহাসড়কে চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, চাঁদা বাণিজ্যের কথা আমি বলব না, আমি বলব একটা টোল আছে, সেটা দিতে হবে। সেটা কোথা থেকে নেবে, কিভাবে এবং কত টাকা নেবে সেটা নির্ধারিত হবে। সেই জায়গা ছাড়া এই টোল কেউ নিতে পারবে না। পরিবহনের যে চাঁদা, যেটা মালিক বা শ্রমিকরা নিয়ে থাকে সমিতি চালানোর জন্য, তাও নির্ধারিত রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকার গার্মেন্টস থেকে কাভার্ডভ্যানে মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে নেয়ার পথে চুরির ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি দুুটি প্রতিষ্ঠান থেকে গার্মেন্টস পণ্য শিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। বিদেশে পৌঁছানোর পর ক্রয়াদেশ দেয়া মালের পরিমাণের সঙ্গে দেখা যায় বিস্তর ফারাক। এরপর ওই দুই বায়ারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির কাছে নির্দেশনা অনুযায়ী কম পণ্য দেয়ার অভিযোগ তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে কয়েকটি ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়। এরপর অভিযুক্ত ওই দুই গার্মেন্টের মালিকদের ডেকে পাঠানো হয়। তারা বিজিএমইএ’র কাছে চুক্তি অনুযায়ী সঠিক মাল সরবরাহের তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরেন। ইন ভয়েস ও চালানের কপিতে উঠে আসে সঠিক পণ্য দেয়ার তথ্য। পরিবহনে যুক্ত কাভার্ডভ্যানের লোকজনও মাল বুঝে নিয়েছে বলে চালানের কপিতে সই করার তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যায়। এমনকি বন্দর কর্তৃপক্ষও মালামাল বুঝে পেয়েছে বলে তথ্য উঠে আসে। বিষয়টি নিয়ে গোলকধাঁধায় পড়েন বিজিএমইএর কর্তা ব্যক্তিরা।
এমন পরিস্থিতিতে তারা গোয়েন্দা পুলিশের শরণাপন্ন হন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও জোনাল টিম। এরপর তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। সেখানে দেখা যায়, কয়েকটি সিএনজি গ্যাস স্টেশন সংলগ্ন অনেকগুলো গোডাউন রয়েছে। ওইসব গোডাউনে আগে থেকেই কার্টন ও পলিথিনের প্যাকেট রেডি করে রাখা হয়। আগে থেকেই জানিয়ে রাখা হয় প্রশিক্ষিত লেবারদের। এসব ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় কয়েকজন ট্রাকচালক ও ডাকাতকে। আবার নারায়ণগঞ্জ পার হওয়ার পর মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনাও ঘটে থাকে। এসব বিষয়ও মাথায় রেখে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের স্থান নির্ধারণ করা হচ্ছে।