কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজনৈতিক প্রতিকূলতায় এক যুগেরও বেশি সময় পার করেছে বিএনপি। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রবল প্রতাপের সামনে অনেকটাই যেন অসহায় দলটি। সাংগঠনিকভাবেও ক্রমশ পরিণত হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু শক্তিতে। যদিও একাধিকবার সরকারে থাকা এ দলের রাজপথ কাঁপানোর নজিরও কম নেই। অতীতের সেই স্মৃতি থেকেই কঠিন সময়ে অনুপ্রেরণা খুঁজতে মরিয়া বিএনপি। সেজন্য রাজনীতির মাঠে রণকৌশলও বদলাচ্ছে বারবার। সর্বশক্তি দিয়ে চাইছে ঘুরে দাঁড়াতে। যদিও বিগত বছরগুলোতে বিএনপির সব চেষ্টা ও রণনীতিই চূড়ান্তভাবে ছিল ব্যর্থতা অভিমুখী।
প্রশ্ন উঠছে, সে ব্যর্থতার দায় কার? দেশের অন্যতম বৃহৎ এ রাজনৈতিক দলে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ভাষ্য অবশ্য ভিন্ন। তারা বরাবরই বলে আসছেন, রাজনৈতিকভাবে সরকারের দমন-পীড়ন ও স্বৈরনীতির কারণেই বিরোধীদল হিসেবে গণতান্ত্রিক কর্মপন্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার ন্যূনতম ছাড়ও দিচ্ছে না। হামলা-মামলা, গুম-খুন অব্যাহত রেখে দেশে একদলীয় শাসন চিরস্থায়ী করতে চাইছে আওয়ামী লীগ। সেজন্যই নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে কেড়ে নিয়েছে জনগণের ভোটাধিকার। রাজনীতিক নয়, দেশের রাজনীতি এখন কতিপয় আমলাদের দখলে।
তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন কীভাবে আরও সংগঠিত করা যায়, এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চলছে তোড়জোড়। বিশেষত, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া নিশ্চিত করতে অনেকটা অঘোষিত ‘এক দফা’ নিয়েই মাঠে নেমেছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ জেলায় কেন্দ্রঘোষিত সভা-সমাবেশ করেছে নেতাকর্মীরা। সঙ্গে সরকার পতনের আন্দোলন ইস্যু তো রয়েছেই।
অতীতে অনেক কর্মসূচি সফলতার মুখ না দেখলেও এবারের কর্মসূচিকে কার্যকর ভাবছে দলটি। এছাড়া অতীতে বিভিন্ন সময়ের কঠোর কর্মসূচিতে ব্যর্থতার কারণে নতুন করে কোনো হঠকারী কর্মসূচি দিতেও আগ্রহী নয় বিএনপির হাইকমান্ড। যদিও দলটির একাংশের নেতারা চান, এখনই সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন। তবে দলের নীতিনির্ধারকরা সে চাওয়াকে এ মুহূর্তে আমলে নিচ্ছেন না। বিএনপির দায়িত্বশীলদের দাবি, আন্দোলন বেগবান হচ্ছে এবং চলমান আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজপথে ফয়সালা হবে।
দলীয় সূত্র বলছে, অতীতে কঠোর কর্মসূচি বাস্তবায়নে খোদ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা থাকলেও সেভাবে কোনো সাফল্য আসেনি। এখন লন্ডন থেকে তারেকের নির্দেশনা এবং ঢাকার অন্যান্য নেতারা বাস্তবায়নে থাকলেও অনেকে আন্দোলনের শুরু থেকেই সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন। একইসঙ্গে ঢাকার রাজনীতিতে বিএনপির অবস্থান গড়তে না পারার বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে। তাই বিগত সময়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার ভেবেচিন্তে হিসাব কষে পা ফেলার নীতি নিচ্ছে দলের কমান্ডিং ফোরাম।
খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সারাদেশে জেলা পর্যায়ে সমাবেশ কর্মসূচির ডাক দেয় দলটি। ২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে এ পর্যন্ত অর্ধেকেরও বেশি জেলায় কেন্দ্রঘোষিত এ কর্মসূচি সম্পন্ন হয়েছে। বাকি জেলাগুলোতেও এ কর্মসূচি পর্যায়ক্রমে চলমান। অনুষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি জেলা সমাবেশেই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
দেশব্যাপী চলমান এ কর্মসূচির মধ্যে একই ইস্যুতে আবারও নতুন কর্মসূচি দেওয়ার কথা ভাবছে বিএনপি। এক্ষেত্রে কর্মসূচির ধরনে কৌশলগত পরিবর্তন আনতে চায় তারা। কিন্তু সেই পরিবর্তনের ধরন কী হবে, সে বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে এখনো কোনো ঘোষণা না এলেও জানা গেছে, দলীয় চেয়ারপারসনের সুচিকিৎসার দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির ময়দানে ঘুরে দাঁড়াতে এখনই কৌশল নির্ধারণ করতে চাইছে। যদিও সরকারবিরোধী আন্দোলন বিষয়ে দলের জ্যেষ্ঠ ও প্রভাবশালী নেতাদের কাছে জানতে চাইলে তারা সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন। তাদের ভাষ্য, যে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানই ভালো জানেন।
বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ঘরানায় কাজ করছে দলটি। এরইমধ্যে কূটনীতিকদের সঙ্গে ঘরোয়াভাবে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ বৈঠকের ফলও পাওয়া গেছে। দেশে ও দেশের বাইরে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে। সবগুলো যোগাযোগই ব্যক্তিগত পর্যায়ে ‘ওয়ান-টু ওয়ান’ ফর্মুলায় চলমান। ফলে এ পর্যায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে কোনো ধরনের হঠকারী কর্মসূচি দিয়ে হিতে বিপরীত কিছু চায় না বিএনপি।
তবে শীর্ষনেতাদের বিশ্বাস, খুব শিগগির পাওয়া যাবে চলমান আন্দোলনের সফলতা। দ্রুত আন্দোলনের নতুন কৌশল প্রয়োগ করা হবে। তবে অভিনব সেই কৌশল এখনো রহস্যের সিন্দুকেই বন্দি। এমনও বলা হচ্ছে, নতুন কৌশলে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে আবারও ভিন্ন ধাঁচের কৌশলে যাবে দল। কিন্তু সরকারের পতন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পন্থার এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে আন্দোলনের গতিপথই শুধু প্রয়োজন মাফিক পাল্টাবে।
বিএনপির শীর্ষনেতারা বলছেন, নতুন বছরে মাঠ পর্যায়ে সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়ানো হবে। পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে কর্মসূচি দেওয়া হবে। ‘স্যাবোটাজ’ (নাশকতা) হয় এমন কোনো কর্মসূচি দেওয়া যাবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা নিয়ে শান্তিপূর্ণ যত উপায় ও পদ্ধতি রয়েছে, সবগুলো অ্যাপ্লাই করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকার সব বাধা-প্রতিবন্ধকতা দূর করে।
দলটির মধ্যমসারির নেতারা মনে করেন, এখন পেছনে তাকানোর আর সুযোগ নেই বিএনপির। সমাবেশ কর্মসূচির মাধ্যমে শুরু হয়েছে। যার শেষও দেখতে হবে। এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির যে সংলাপ চলছে, তাও নিয়ে ভাবছে না দল। তবে কমিশন গঠন বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে একটি চিঠি দেওয়া হতে পারে। দেশের পরিস্থিতি ও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় বিএনপি এখন ‘ডু অর ডাই’ পজিশনে। এখন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত হলেও যে কোনো সময় বড় ধরনের কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলের।
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রেহেনা আক্তার রানু দলের চলমান কর্মসূচি প্রসঙ্গে বলেন, চলমান কর্মসূচি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পালন করছি। কিন্তু এ কর্মসূচিতে আমাদের নেত্রীর মুক্তি বা সুচিকিৎসা হচ্ছে না। কর্মসূচি আরও বেগবান হবে এবং এর মধ্য দিয়েই আন্দোলনে আমাদের দাবি পূরণ হবে বলে আশা রাখি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা সবুর করেছিলাম। ভেবেছিলাম- সবুরে মেওয়া ফলবে। সবকিছুর একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। বিএনপির গণজাগরণ শুরু হয়েছে। এটাকে সিনেমার ট্রেইলার মনে করতে পারেন। পুরো সিনেমা এখনো বাকি। গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য।
তিনি বলেন, আন্দোলনে নামার জন্য সাধারণ মানুষের গা ছটফট করছে। জনগণ কিন্তু বছরজুড়ে বা মাসব্যাপী আন্দোলন করে না। খেলার শেষ মুহূর্তে মাঠে নামবে জনগণ এবং আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবে।
‘আমাদের ইগো প্রবলেম দূর করতে হবে। এক নেতার ডাকে সবাইকে একযোগে মাঠে নামতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ হতে হবে’ বলেন গয়েশ্বর।