কাজিরবাজার ডেস্ক :
মানব পাচার মামলায় সাজা খুবই কম। শতকরা ৯৬ ভাগ মামলা বিচারাধীন। নিষ্পত্তির হার শতকরা চার ভাগ। সারাদেশে মানব পাচারের মামলা হয়েছে ৬ হাজার ১৩৪টি। এর মধ্যে আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৩৩টি মামলা। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫ হাজার ৯০১টি। ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে’ সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচারের জন্য মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদন্ড এবং অন্যূন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান আছে। মানব পাচারের বিভিন্ন মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, দুর্বল তদন্ত ও আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় অধিকাংশ অপরাধীদের শাস্তি হয়নি। আইনে জামিন অযোগ্য হলেও অধিকাংশই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। ফলে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি ও আদালত সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
প্রায় ৬ বছর আগে ২০১৫ সালের ১ মে থাইল্যান্ডের গহিন অরণ্যে অভিবাসীদের গণকবরের সন্ধান মেলে। সেখানে অন্তত ১০ জন বাংলাদেশীর লাশ ছিল। ওই বছর থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে মানব পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার ১৭৫ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনে সরকার। দেশে ফিরে তারা বিমানবন্দর থানায় তিনটি মামলা করেন। থাইল্যান্ডে মামলার বিচারে পাচারকারী চক্রের সাজা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে বিচার এখনও ঝুলে আছে।
সম্প্রতি ভারতে পাচারের শিকার এক বাংলাদেশী তরুণীকে বিভৎস কায়দায় নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওর সূত্র ধরে ২৭ মে ছয়জনকে গ্রেফতার করে বেঙ্গালুর পুলিশ। এরপর ভারতে পাচার হওয়ার ৭৭ দিন পর পালিয়ে দেশে ফিরে ১ জুন রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন আরেক তরুণী। পরপর এ দুটি ঘটনায় মানব পাচারে ভিকটিমের ওপর হিংস্রতার বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে। পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়নি।
গত বছরের ২৮ মে লিবিয়ায় ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশী। এ ঘটনায় গত বছরের ২ জুন রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করে সিআইডি। চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি। বিচার কার্যক্রম শুরু হয়ে মানব পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টি কখন শেষ হবে তা অনিশ্চিত।
মানব পাচারের অধিকাংশ মামলার বিচার কার্যক্রমই চলছে ধীর গতিতে। তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। যে সব মামলা আলোর মুখ দেখেছে (চার্জশিট দেয়া হয়েছে) সেগুলোর ৯৬ ভাগই বিচারাধীন আছে। মামলা নিষ্পত্তির হার ৩ দশমিক ৯১ ভাগ।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যানুসারে, ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে মানব পাচারের ছয় হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদালতে ২৩৩টির নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন আছে ৫ হাজার ৯০১টি। এর মধ্যে ৩৩টি মামলায় ৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। ২০১২ সালের ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে’ সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচারের জন্য মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদন্ড এবং অন্যূন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান আছে।
উচ্চ আদালতের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মানব পাচারের মোট মামলা পাঁচ হাজার ৯৯টি। এর মধ্যে চার হাজার ৮৫১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯০টি। আর ৫৮টি মামলা বদলি করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৩টির বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এ ছাড়া ১৯০টি মামলা পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। তথ্যানুসারে ৯৬ ভাগ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে তিন দশমিক ৯১ ভাগ মামলা।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বলেছেন, আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মানব পাচার আইনের মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। ফলে একজন বিচারকের নানা ধরনের মামলা পরিচালনা করতে হতো। এখন পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তির হার অনেকটা বাড়বে।
ঢাকার মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) সাজ্জাদুল হক শিহাব বলেছেন, মানব পাচার আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অনেক মামলা ইতোমধ্যেই নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে সাজার পরিমাণ খুবই কম। এর প্রধান কারণ সাক্ষী আসে না। এ ছাড়া তদন্তের ত্রুটিও অন্যতম কারণ। সাক্ষীরা কোর্টে এসে আপোসের কথা বলেন। কোর্টে এসে মামলায় উল্টো সাক্ষী দেন। সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণিত না হলে কোন আসামির সাজা হয় না। আর এ সব নানা করণে মামলায় আসামিরা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।
সরকার পক্ষের একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তারা যদি প্রসিকিউশনের সহায়তা নেন, তাহলে মামলায় কাকে সাক্ষী করা যাবে আর কাকে সাক্ষী করা যাবে না- সে বিষয়ে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। সর্বদাই এমন লোকদের সাক্ষী করতে হবে, যাদের ডাক দিলে পাওয়া যাবে। যারা কোর্টে এসে সাক্ষী দিতে প্রস্তুত তাদেরই সাক্ষী করতে হবে। এ ছাড়া নানা আইনী বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রসিকিউশনের সহায়তায় নির্ভুলভাবে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়া সম্ভব।
অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলেন, মানব পাচারের মামলাগুলো দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সত্যিই দুঃখজনক। মামলাগুলো দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। নয়তো বিচারপ্রার্থীদের মনে ন্যায় বিচার নিয়ে হতাশা সৃষ্টি হবে। কোন অপরাধীই যেন আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে পার পেয়ে না যায়- সে ব্যাপারে আদালত, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া মানব পাচাররোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে বর্ডার অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও ততপরতা বাড়াতে হবে। এ সব করা গেলে মানব পাচার কমে আসবে।
পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, অভিযোগের সত্যতা নিরূপণে অনেক সময় অনেক সময় লেগে যায়। অনেক আসামিই তাদের প্রকৃত নাম-ঠিকানা গোপন করে মিথ্যা তথ্য দেয়। সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে সময় লেগে যায়। আবার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলোও যাচাই-বাছাই করতে হয়। মামলার চার্জশিট আসামিদের সঠিক নাম-ঠিকানাসহ তদন্তের বিস্তারিত উল্লেখ করতে হয়। ফলে তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লেগে যায়। তবে মানব পাচারের মামলাগুলো খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করা হয়, যাতে কোন নিরপরাধ মানুষজন দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা না পায় সেই দিকটাও খেয়াল রাখতে হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।