রাষ্ট্রপতির সংলাপ ঘিরে ঐকমত্যের পূর্বাভাস ॥ পর্যায়ক্রমে সব নিবন্ধিত দলের সঙ্গে আলোচনা

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাষ্ট্রপতির সংলাপকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে ঐকমত্যের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন উপলক্ষে সার্চ কমিটি গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আলোচনা করেছেন। এসব আলোচনা থেকে দেশের রাজনীতিতে জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়টি জোরালো হয়ে উঠেছে। দেশের বিশিষ্ট ৩৭ নাগরিকের বিবৃতিতেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বিশিষ্ট নাগরিকগণ রাষ্ট্রপতির সংলাপে জাতীয় ঐকমত্যের আশা পোষণ করছেন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের ইস্যুতে গত সোমবার থেকে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ দেশের সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে প্রথম সংলাপে বসেন রাষ্ট্রপতি। জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির ধারাবাহিক সংলাপের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। একদিন বিরতি দিয়ে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সঙ্গে আলোচনা করেন। আগামী সপ্তাহ থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সংলাপ করবেন রাষ্ট্রপতি। সংলাপে অংশ নেয়া দুটি রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন। দুটি দলেরই চাওয়া একটি গ্রহণযোগ্য ও দক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন। এছাড়া উভয় দলই চায় সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন। ইতোমধ্যে এই আইন প্রণয়নের কাজ আইন মন্ত্রণালয় শুরু করেছে। পরবর্তী কোন সংসদ অভিবেশনে হয়ত আইনটি পাস করার জন্য উত্থাপন করা হবে। তবে তার আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে চলতি নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। ফলে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে যাচ্ছেন। তারই অংশ হিসেবে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন। রাষ্ট্রপতির এই সংলাপকে ঘিরে রাজনীতিতে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। সেই আশাটা হচ্ছে, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এই ঐকমত্য জরুরী। সে বিষয়টি অনুধাবন করে দেশের ৩৭ বিশিষ্ট নাগরিক বুধবার একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এই বিবৃতির মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রপতির সংলাপে জাতীয় ঐকমত্যের আশা করছেন। বিবৃতিতে বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলাপ-আলোচনার উদ্যোগকে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সময়োপযোগী ও জরুরী বলে মতামত দিয়েছেন। তারা আশা করছেন, আজকের ক্ষীণ গণতন্ত্রের বাংলাদেশে এখন আবার নতুন করে গণতন্ত্র চর্চা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, জবাবদিহিতা, আইনের সম ও ন্যায্য প্রয়োগ এবং আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সর্বময় ও বণ্টন ব্যবস্থাকে সাম্যমূলক করে তোলার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও ঐকমত্যের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আলাপ-আলোচনা করবেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা এও আশা করি, এই আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের ব্যাপারে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা খসড়া প্রস্তাবনা প্রণীত হবে। যাতে বর্তমানে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত আওয়ামী লীগের রূপকল্পও স্থান পাবে। আমাদের প্রত্যাশা যে, সেই সঙ্গে মানবাধিকার সংক্রান্ত আমাদের ব্যাপক এবং প্রকট বিচ্যুতি নিরসনের নির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলোও রচিত হবে। আমরা আরও আশা করি যে, দলগুলোর মধ্যে ‘তিন জোটের রূপরেখার’ আদতে একটা ঐকমত্য সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে গণমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠনগুলোকেও যুক্ত করার জন্য রাষ্ট্রপতির প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। তারা আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৫) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মন্ত্রিপরিষদের বিবেচনার জন্যে পাঠাবেন বলে আশা করি।
বিবৃতিদাতারা হলেন- ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী এম হাফিজউদ্দিন খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বিচারপতি আব্দুল মতিন, সাবেক বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, ড. হামিদা হোসেন, মানবাধিকারকর্মী, ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক গবর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক, আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মহিউদ্দিন আহমদ, সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অধ্যাপক পারভীন হাসান, ভাইস চ্যান্সেলর, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, ড. শাহদীন মালিক, এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, মুনিরা খান, সভাপতি, ফেমা, শিরিন হক, সদস্য, নারীপক্ষ, ব্যারিস্টার সারা হোসেন এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, আবদুল লতিফ মন্ডল, সাবেক সচিব, সঞ্জীব দ্রং, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, ড. শহিদুল আলম, আলোকচিত্র শিল্পী, শারমিন মুরশিদ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্রতী, শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লেখক, অধ্যাপক স্বপন আদনান, অধ্যাপক ও গবেষক, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন, সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাবেক ব্যাংকার, আবু সাঈদ খান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গোলাম মোনোয়ার কামাল, নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অধ্যাপক নায়লা জামান খান, পরিচালক, ক্লিনিকাল নিউরোসায়েন্স সেন্টার, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন, জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ, ফারুক ফয়সাল, আঞ্চলিক পরিচালক, আর্টিকেল ১৯, ড. ফস্টিনা পেরেরা মানবাধিকারকর্মী, নূর খান লিটন, মানবাধিকারকর্মী।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে এবার তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথমবার ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডাকেন। দ্বিতীয়বার ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সংলাপ শুরু হয়, চলে ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত । বঙ্গভবনে পর্যায়ক্রমে মোট ৩১টি রাজনৈতিক দল এই সংলাপে অংশ নেয়। উল্লেখ্য, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। পরদিন নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি ২০ জানুয়ারির মধ্যে নতুন সার্চ কমিটি গঠন করবেন। এই সার্চ কমিটি রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নতুন কমিশন গঠনে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করবে।