॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
৫. কৃতজ্ঞতা : আল্লাহ তাআলা মানুষকে অসংখ্য নিআমাত দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলার এ নিআমতসমূহের বিনিময়ে তাঁর আদের্শ পালন করা হলো কৃতজ্ঞা জানানো। আল্লাহ তাআলার আদেশ মেনে চললে মানুষ কোনো খারাপ কাজ করতে পারবে না। ফলে তার চরিত্র সুন্দর হবে। আল্লাহ তাঁর নিআমত আরো অধিকাহারে শোকরকারীকে দান করবেন। যেমন তিনি বলেছেন, যদি তোমরা শোকর করো, তাহলে অবশ্যই আমি তোমাদের নিআমত বাড়িয়ে দেববো। যারা আল্লাহ তাআলার নিআমতের শোকর করে তাদের পক্ষেই অন্যান্যদের উপকার স্বীকার করা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভব। কৃতজ্ঞ মানুষকে আল্লাহ তাআলা যেমন ভালবাসেন তেমনি মানুষও কৃতজ্ঞ মানুষের জন্য আরও কিছু করার আগ্রহ পোষণ করে থাকেন। ইসলামের শিক্ষা মানুষকে কৃতজ্ঞা জ্ঞাপন অভ্যস্ত করে তোলে। এতে ব্যক্তি সর্বজনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠে।
৬. আমানত সুরক্ষা : মানুষের নৈতিক উন্নয়ন অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ আমানতদারিতা। আমানতদারিতা এক মহান নৈতিক গুণ। এ গুণ মানুষের কাছে মানুষকে বিশ্বাসভাজন ও ভালোবাসার পাত্র করে তোলে। মানুষ অবলীলায় তার কথা শোনে। তার কাছে তাদের সম্পদ এমনকি সম্মান পর্যন্ত আমানত রাখতে দ্বিধাবোধ করে না। ঈমান ও আমানতদারিতা অবিচ্ছেদ্য বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যার আমানতদারিতা নেই তার ঈমান নেই। আল্লাহ তাআলা আমানত সুরক্ষাকে ফরয করেছেন। কুরআন মাজীদে এসেছে, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারের কাছে ফিরিয়ে দিতে। মানবসম্পদ উন্নয়নে গৃহীত বিপুল কর্মসূচি, বিস্তারিত কর্মশালা দিয়ে ব্যক্তির ভেতর আমানতদারিতা তৈরির নিরন্তর চেষ্টা পরিচালনা করতে দেখা যায়। অথচ ঈমান ও ইসলামের শিক্ষা ব্যক্তিকে আখিরাতে জবাবদিহিতার চেতনায় স্বভাবতই আমানতদার করে তোলে।
৭. ওয়াদা পালন : ওয়াদা এক ধরনের আমানত। কাউকে কথা দিলে তা রাখতে হয়। ওয়াদা করলে তা পালন করতে হয়। আল্লাহ তাআলা ওয়াদালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না। তিনি ওয়াদা পালনের আদেশ দিয়ে বলেন, মুমিনগণ! তোমরা চুক্তিসমূহ পূর্ণ করো। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে ওয়াদা রক্ষা করেছেন। তাঁর সাহাবীগণ এ ব্যাপারে তাঁকে পুরোপুুরি অনুসরণ করেছেন। ওয়াদা পালন প্রতিশ্রুতি রক্ষা মানবিক উন্নয়নের অন্যতম দৃষ্টান্ত। ঈমান আনার সাথে সাথে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি পালনেও প্রত্যয় গ্রহণ করে।
৮. হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকা : সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হওয়ার প্রধান উপায় হলো হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা। হিংসা, অহঙ্কার, ঘৃণা, নিজেকে বড় এবং অন্যকে নীচ মনে করার হীনমানসিকতা সুন্দর চরিত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) হিংসা-অহঙ্কারকে পুণ্য ধ্বংসের কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা আগুন যেমন কাঠ ভস্মিভূত করে, হিংসা-বিদ্বেষও তেমনি সৎ আমল নষ্ট করে। হিংসা-বিদ্বেষ মানবিক গুণ বিরোধী। এটি মানুষকে দাম্ভিক করে। এমন ব্যক্তি কোন কাজে সফল হতে পারে না। মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তাই হিংসা-বিদ্বেষ থেকে ব্যক্তিকে মুক্ত করার কথা বলা হয়ে থাকে। ঈমান এমন একটি অনন্য প্রশিক্ষণ, যা মানুষকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে রেখে সকলের নিকট প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় করে তোলে।
৯. ধূমপান ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকা : মানবসম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে ধূমপান ও মাদকাসক্তির কুপ্রভাব অত্যন্ত কার্যকর। ইসলাম তাই ধূমপান ও মাদকাসক্তি ত্যাগের নির্দেশনা দিয়েছে। ধূমপানে অর্থ-সম্পদের অপচয় হয়, ব্যক্তির নিজের ও অন্যের ক্ষতি হয়। আল্লাহ তাআলা এসবই হারাম ঘোষণা করে বলেছেন: আর কোনোক্রমেই অপচয় করবে না। নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।
অন্যদিকে আল্লাহ তাআলা মাদক সেবনকে সরাসরি হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী এবং ভাগ্য নির্ধারক তীর অবশ্যই শয়তানের অপবিত্র ও ঘৃণ্য কাজের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই তোমরা তা বর্জন করো, তাহলে তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশ এমনকি আন্তর্জাতিক নানা সংঘ ধূমপান ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও তেমন কোন সুফল অর্জন করতে পারেনি। ফরে এর ক্ষতি থেকে মানবজাতিকে সঠিকভাবে রক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অথচ ইসলামের ঘোষণা ও শিক্ষা এক্ষেত্রে মুমিনকে ধূমপান ও মাদকাসক্তি থেকে প্রকৃতার্থেই দূরে রাখতে সক্ষম।
১০. কথা ও কাজে মিল রাখা : কথায়-কাজে মিল রাখা সুন্দর চরিত্র অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা কথা-কাজের অমিলকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা তোমরা করো না? আল্লাহর নিকট এটা অত্যন্ত অপ্রিয় যে, তোমরা যা বলো তা করো না। মানবসম্পদের প্রকৃত উন্নয়ন সাধনের জন্য কথা ও কাজের মিল থাকা আবশ্যক। কারণ কথা ও কাজের বৈপরীত্ব থাকলে মানুষকে প্রকৃত মানুষ বলা চলে না। এমন মানুষকে কেউ ভালোবাসে না। বিশ্বাসও করে না। কথা ও কাজের মিল প্রতিষ্ঠাকে ঈমানে অনিবার্য শত করে দিয়ে ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়নের ঈমানী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
উপসংহার : বস্তুত মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন, মানবিক ও নৈতিক গুণে বিভূষিত হওয়া, মানুষকে আত্মিক ও বাহ্যিক দিক থেকে সত্যিকার গুণ ও আচরণে সমৃদ্ধ সম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত সকল চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সে কারণে তথাকথিত সভ্য সমাজে, অফিসে, দেশে, পরিবারে মানুষের কাছে মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মানুষই মানুষের সম্পদ, সম্মান ও জীবনের হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। মানুষের আচরণ স্বার্থপরতা, হীনতা ও পাশবিকতায় ভরে ওঠেছে। এ অবস্থা নির্মূল করে মানুষকে সত্যিকারার্থে সম্পদে পরিণত করার জন্য ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষার অনুশীলন অনিবার্যÑআলোচ্য নিবন্ধে উপস্থাপিত তথ্য, প্রমাণ ও বিশ্লেষণ এ বিষয়টির অবিসংবাদিত প্রমাণ। এ কারণে মানবসম্পদের চিরস্থায়ী উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য সর্বক্ষেত্রে ইসলামের অনুশীলন অনিবার্য। (অসমাপ্ত)