কাজিরবাজার ডেস্ক :
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আগামীকাল সোমবার শুরু হচ্ছে রাষ্ট্রপতির সংলাপ। নির্বাচন কমিশন গঠনে এখনও আইন প্রণয়নের কাজ শেষ হয়নি। তাই এবারও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতিকে সার্চ কমিটির পথে যেতে হচ্ছে। তারই অংশ হিসাবে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সোমবার থেকে নির্বাচন কমিশনে তালিকাভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করতে যাচ্ছেন।
আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। ফলে এর আগেই রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশন নিয়োগ দেবেন। এ কমিশনের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ লক্ষ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নিবন্ধিত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ।
সোমাবর বিকেল থেকে রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে এই সংলাপ শুরু হবে। প্রথম দিন বিকেল ৪টায় শুরু হবে এ সংলাপ। এ সংলাপে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনায় বসবেন রাষ্ট্রপতি।
প্রথম দিনের আলোচায় অংশ নিতে ইতোমধ্যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সৃষ্ট রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
সংলাপে দ্বিতীয় দল হিসাবে যাচ্ছে সরকারের জোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনার একদিন পর জাসদের সঙ্গে সংলাপ হবে। অর্থাৎ ২২ ডিসেম্বর বিকেলে রাষ্ট্রপতি জাসদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে। সংলাপে বসার জন্য ইতোমধ্যে দ্বিতীয় হিসাবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বঙ্গভবন সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অন্য দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সময়সূচী এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে খুব দ্রুতই এই সময়সূচী চূড়ান্ত করে অপর রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হবে। তবে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সাবেক বিরোধী দল বিএনপিকে সংলাপের শেষ দিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে আমন্ত্রিত দুই রাজনৈতিক দলই প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেছে। এই দুটি দল মূলত নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধান অনুসারে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রাখবে বলে জানা গেছে।
২০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ সাত জ্যেষ্ঠ নেতা রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেবেন। অন্য ছয়জন হচ্ছেন- মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ, রুহুল আমিন হাওলাদার, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম।
জানা যায়, জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রপতির কাছে ইসি পুনর্গঠনে কী ধরনের প্রস্তাব দেবে তা দলটি আজকের মধ্যেই বৈঠক করে ঠিক করবে। তবে এবারও সংলাপে ইসি পুনর্গঠনে গত সংলাপের প্রস্তাবগুলোই প্রধান্য পাবে। যার একটি ছিল ইসি পুনর্গঠনে স্থায়ী আইন প্রণয়ন। কারণ, প্রতিবার ইসি গঠন নিয়ে সঙ্কটে পড়তে হয়। মনোপুত না হলে রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন সুরে কথা বলে। এ জন্য একটি স্থায়ী সমাধানের প্রয়োজন। আর এর সমাধান সংবিধানের মধ্যে দেয়া আছে। এখন দরকার সংবিধানের সেই নির্দেশনা মোতাবেক আইন প্রণয়ন করা। এটিই আসলে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে স্থায়ী সমাধান।
এর আগে ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে জাতীয় পার্টি পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই প্রস্তাবগুলো ছিল, সংবিধান অনুসারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন নিয়োগসংক্রান্ত একটি আইনী কাঠামো প্রণয়ন করা; আইনে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাখার বিধান রাখা; নির্বাচন কমিশনের আলাদা সচিবালয় করা; বর্তমান সংসদেই এই আইন পাস করা এবং নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা মূল্যায়নে ৯টি বিষয় বিবেচনায় নেয়া। এই ৯টি বিষয়ের মধ্যে ছিল, নিরপেক্ষতা, ব্যক্তিগত একাগ্রতা ও সততা, ন্যূনতম ও সর্বোচ্চ বয়স, পেশাগত যোগ্যতা, নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে জ্ঞান, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় না থাকা এবং চারিত্রিক স্বচ্ছতা।
জানা যায়, ২২ তারিখে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে জাসদের সংলাপ হবে। ওই সংলাপে জাসদের পক্ষ থেকেও নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হবে। আর এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি থাকবে, যাতে তারা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম হয়।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে এবার তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রথবার ২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডাকেন। তবে বিএনপি তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় থাকায় ওই সংলাপ থেকে কার্যকর কোন ফল বেরিয়ে আসেনি।
দ্বিতীয়বার ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সংলাপ শুরু হয়। চলে ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। বঙ্গভবনে পর্যায়ক্রমে মোট ৩১টি রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নেয়। প্রথম দিন সংলাপে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। এরপর ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টি, ২১ ডিসেম্বর এলডিপি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ২২ ডিসেম্বর জাসদ (ইনু) সংলাপে অংশ নেয়। ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি সংলাপে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। এক মাসে পাঁচ দফায় এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের সাবেক প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংলাপে যাকে কি না এ ব্যাপারে দলটির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। যদিও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোন ধরনের সংলাপে যাবে না বিএনপির। এ বিষয়ে দলের নেতৃবৃন্দ একের সময় এক এক কথা বলছেন। বেশির ভাগ স্থায়ী কমিটির সদস্যরাই বলছেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে সংলাপে না যাওয়ার। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে দলের নেতৃবৃন্দের ব্যাখ্যা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে নির্বাচন কমিশন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতি। যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা ইতোমধ্যে বিএনপি জানিয়েছে, সেক্ষেত্রে আসন্ন সংলাপে অংশগ্রহণ করে সংলাপকে রাজনৈতিকভাবে পরিপুষ্ট করার কোন সুযোগ নেই।
সংলাপে অংশ না নেয়ার বিষয়টি গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে আসছিল। জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সভায় গত ২ নবেম্বর স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী নির্বাচনে এই সরকারের অধীনে অংশগ্রহণ করবে না। শুধু তা-ই নয়, কোন আলোচনায় বিএনপি যাবে না। কারণ, আমরা আলোচনা করেছি, অংশগ্রহণও করেছি। তার ফলাফল বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছে।’ পরদিন স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এক সভায় বলেছেন, ‘সামনে যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার না হয়, এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। বিএনপিসহ অন্যান্য দল নির্বাচনে যাবে না। এখানে সংলাপের কোন প্রশ্নই আসে না।’
এরপর গত ২৩ নবেম্বর গুলশানে চেয়ারপার্সনের অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মন্তব্য ছিল, ‘আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট, এই সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা যাব না। নির্বাচন কমিশন গঠনে কোন সংলাপে বিএনপি যাবে না।’
তবে গত ১৪ ডিসেম্বর সংবাদমাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে সুনির্দিষ্ট তারিখের বিষয়ে খবর প্রকাশিত হলে আবারও আলোচনা শুরু হয় বিএনপিতে। এই আলোচনা চলে অনেকটাই ভেতরে-ভেতরে। সংলাপে না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকায় এ প্রসঙ্গে বিএনপির এই আলাপ চলছে অনেকটাই গোপনে, নিজস্ব বলয়ে।
এই আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে কি অটল থাকবে বিএনপি? নাকি একাদশ জাতীয় সংসদে যোগ দেয়ার মতো এবারও শেষ মুহূর্তে সংলাপের টেবিলে বসবেন দলটির নেতারা।
বিএনপির একটি প্রভাবশালী পক্ষ বলছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির আসন্ন সংলাপ যেহেতু ‘রাজনৈতিক’ ভূমিকা রাখবে, সেক্ষেত্রে এই ‘রাজনীতি’ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সংলাপে না গেলে কী পরিবর্তন আসবে? এই পরিবর্তনের অর্জন কী হবে? এসব প্রশ্নের জবাব এখনও বাকি।
দলটির দায়িত্বশীল আরেকটি পক্ষের ইঙ্গিত দিচ্ছেন, এই মুহূর্তে বিএনপির মূল ইস্যু হচ্ছে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে তার উন্নত চিকিৎসার বিষয়টি। সংলাপের মধ্য দিয়ে এ বিষয়টি সামনে আসবে কিনা, এ প্রসঙ্গটিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বিএনপি প্রধানের বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার স্পষ্টত পরামর্শ রয়েছে।
ফলে বিএনপির সংলাপে যাওয়া না যাওয়ার এখনও কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে বলেছেন, ‘এখনও সংলাপের চিঠিই আসেনি। চিঠি আসার পর স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।’
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বিষয়ে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের একাংশ সংবিধান অনুসারে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছে। সরকারের আইনমন্ত্রীও আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেননি। তবে সময় স্বল্পতার কারণে এবার আইন প্রণয়ন সম্ভব না বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।