কাজিরবাজার ডেস্ক :
কয়লা নিয়ে নাটকীয়তার পর জলবায়ু চুক্তিতে সম্মত হলো দেশগুলো। কয়লার ব্যবহার ‘ধাপে ধাপে শূন্যে নামিয়ে আনা’ না ‘ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা’ হবে এ নিয়ে গ্লাসগো জলাবায়ু সম্মেলনের খসড়া তিন দফা সংশোধন করা হয়। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বের তৃতীয় কার্বন দূষণকারী দেশ ভারত। এ নিয়ে নির্ধারিত সময়ে সিদ্ধান্তে আসতে না পারার কারণে সম্মেলনে সময় একদিন বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত কয়লার ব্যবহার থেকে ‘ধাপে ধাপে পুরোপুরি সরে আসার’ পরিবর্তে ‘ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার’ ব্যাপারে একমত হয় দেশগুলো। ফলে পূর্ণতা পায় গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্ট।
তবে এই চুক্তি নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন দেশগুলোর নেতারা। নাগরিক সমাজ, এনজিও ব্যক্তিত্ব এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে ২৬তম জলবাযু সম্মেলনে সভাপতি পর্যন্ত। সম্মেলন শেষে শনিবার রাতে জলবায়ু সম্মেলনের ফলাফল নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সভাপতি অলোক শর্মা একে ‘ঠুনকো বিজয়’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এ সময় তাকে অনেকটা আবেগপ্রবণ হতে দেখা যায়। অলোক শর্মা বলেছেন, ঘটনাপ্রবাহ এগিয়েছে তাতে তিনি ‘গভীরভাবে দুঃখিত।’ তিনি বহু কষ্টে অশ্রু সংবরণ করেন এবং প্রতিনিধিদের বলেন, সম্পূর্ণ চুক্তিটি করা খুবই গুরুত্বপূণ ছিল। বিশ্বের দুইশ’টি দেশের কার্বন নিঃসরণ কমানো, জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধ করতে একমত পোষণের বিষয়টিকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করেন। এর আগে দুই সপ্তাহের ক্লান্তিকর আলোচনা শেষে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন থেকে ফলাফল না আসায় সময় বাড়িয়ে শনিবারের মধ্যে চুক্তি হওয়ার আশা প্রকাশ করেছিলেন কপ-২৬ প্রেসিডেন্ট যুক্তরাজ্যের অলোক শর্মা। সেই আশা সত্যি করতে শনিবার রাতে বড় একটি নোটবুক হাতে নিয়ে তাকে সম্মেলন কেন্দ্রে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ছুটাছুটি করতে দেখা যায়।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, দুনিয়াটার ভাগ্য স্রেফ একটি ‘চিকন সুতার মাধ্যমে ঝুলে আছে। আমরা এখনও একটি জলবায়ু বিপর্যয়ের দরজায় টোকা দিচ্ছি। এখনই সময় জরুরী ব্যবস্থা নেয়ার। অথবা গ্রীনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ শূন্যে নামিয়ে আনার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যাবে।’ শেষ পর্যন্ত যে চুক্তি হয়েছে, তাকে তিনি ‘রাজনৈতিক আপস’ আখ্যায়িত করেছেন। পাঁচ বছরের জন্য অপেক্ষা না করে সামনের বছরই আরও ‘কঠোর’ জলবায়ু প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসার জন্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, তিনি আশা করেন ‘বিশ্ব কপ-২৬ এর দিকে ফিরে তাকাবে জলবায়ু পরিবর্তনের শেষের শুরু হিসেবে’। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন ‘তিনি লক্ষ্যে পৌঁছাতে অবিরাম কাজ করবেন।’
মার্কিন জলবায়ু বিষয়ক দূত জন কেরি বলছেন, ‘আমরা আগের চেয়ে প্রকৃতপক্ষে অনেক কাছাকাছি অবস্থান করছি কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে। সেগুলো জলবায়ু বিষয়ক জটিলতা, দূষণমুক্ত বায়ু নিশ্চিত করা, নিরাপদ পানি এবং সুরক্ষিত গ্রহ’।
অতিরিক্ত একদিন স্নায়ুক্ষয়ী দর কষাকষি শেষে যে চুক্তি হলো, তাকে ‘একেবারেই কোন ঐকমত্য না হওয়ার চেয়ে মন্দের ভাল’ বলে মনে করছে দেশগুলো। তাতে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে ধরিত্রীকে বাঁচানোর বাস্তবসম্মত সুযোগ তৈরির আশাটা অন্তত জিইয়ে রাখা গেল। কিন্তু বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার যে আহ্বান সেটা বেশি দূর আগায়নি।
এবারের সম্মেলন শেষ হওয়ার কথা ছিল শুক্রবার সন্ধ্যায়। কিন্তু অংশগ্রহণকারী দেশগুলো কোন সমঝোতায় আসতে না পারায় সম্মেলনের সময় একদিন বাড়ানো হয়। কিন্তু সেই সমঝোতায় পৌঁছাতেও শনিবার পুরোদিন লেগে যায়। খসড়া চুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ভারত। কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর প্রস্তাবে কয়লার ওপর অতিনির্ভর দেশটি। তার সঙ্গে আপত্তি জানিয়েছিল চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজিরিয়া ও ইরানও। ভারতের জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী ভুপেনদার ইয়াদাভ প্রশ্ন তোলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যেখানে ‘এখনও উন্নয়নের নানা এজেন্ডা ও দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে’ সেখানে তারা কিভাবে কয়লা এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ধাপে ধাপে বন্ধ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে? অধিবেশনে জি-৭৭ জোট এবং চীনের পাশে অবস্থান নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা বলেছে, ‘সবার জন্য এক নীতি কোন ভাল প্রস্তাব হতে পারে না।’ পরে সেই তালিকায় যোগ দেয় ইরান। অধিবেশনে দেশটির প্রতিনিধি বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে। আমরা এ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের অনুরোধ করছি।’
শেষ পর্যন্ত দেশগুলো কয়লার ব্যবহার থেকে ‘ধাপে ধাপে পুরোপুরি সরে আসার’ পরিবর্তে ‘ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার’ ব্যাপারে একমত হয়। অব্যাহত কয়লা শক্তি ‘পর্যায়ক্রমে শূন্যে নামিয়ে আনা’র বদলে ‘পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা’ শব্দগুচ্ছ খসড়া চুক্তিতে প্রতিস্থাপন করে সংশোধন করা হয়। এ নিয়ে সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের হতাশা প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি শনিবার সন্ধ্যার পর ‘গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি’ সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হয়। নাটকীয় এক পরিসমাপ্তি ঘটে ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনের দরকষাকষি। উল্লেখ্য, গ্লাসগো ক্লাইমেট প্যাক্ট হচ্ছে প্রথম কোন জলবায়ু চুক্তি যেখানে কয়লা ব্যবহার থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল। কয়লাকে বলা হয় গ্রীনহাউস গ্যাসের জন্য সবচেয়ে খারাপ জীবাশ্ম জ্বালানি।
চুক্তিতে আরও জরুরী ভিত্তিতে গ্রীনহাউস গ্যাস উদ্গিরণ কমানো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়, যাতে দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করতে পারে। কিন্তু উষ্ণতা বৃদ্ধির সীমা দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াসে আটকে দেয়ার উদ্দেশ্যে এই চেষ্টা খুব বেশি এগোতে পারেনি।
চুক্তির মূল অর্জন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এতে বলা হয়েছে কার্বন নিঃসরণের মাত্র কমিয়ে এনে তাপমাত্রা ১.৫ সেলসিয়াসে আনার যে পরিকল্পনা করা হয়েছে সেটা পরের বছর আবার পর্যবেক্ষণ করা হবে। প্রথমবারের মতো সমন্বিতভাবে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি প্রদান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা বাড়ানো।
চুক্তিতে দেশগুলো আগামী বছর বৈঠকে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা পরের বছরে আবারও কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার আহ্বান জানাবে যাতে তাপমাত্রা ১.৫ সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ থাকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই তাপমাত্রা ঠিক না রাখলে লাখ লাখ মানুষ ভয়ানক তাপমাত্রা সহ্য করতে হবে। এজন্য চুক্তিতে আরও জোর দেয়া হয় জরুরী ভিত্তিতে কার্বন নিঃসরণ কমিযে আনার। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও অর্থ দেয়া যাতে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশ চীন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য ২০৬০ সালকে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে, যেখানে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে সেই লক্ষ্য পূরণ প্রয়োজন। গ্লাসগো সম্মেলনে যোগ দিলেও চীন নতুন কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি, বরং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার নিয়ে প্রস্তাবে ভারতের সঙ্গে আপত্তি জানায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কয়লা উৎপাদনকারী এ দেশটিতে জ্বালানির প্রধান উৎসও ওই কয়লা। বিশ্বে ব্যবহৃত মোট কয়লার অর্ধেকেরও বেশি চীনেই ব্যবহৃত হয়।
শক্তি তৈরির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো হলে বাতাসে মেশে বিভিন্ন কার্বন গ্যাস, এর বেশিরভাগই কার্বন ডাইঅক্সাইড। এসব গ্যাস সূর্যের আলো থেকে তাপ ধরে রাখে। ফলে বাড়তে থাকে পৃথিবীর তাপমাত্রা।
এই বাড়তি তাপমাত্রাই বদলে দিচ্ছে জলবায়ু, একদিনে বরফ গলে যাচ্ছে, আরেক দিকে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। চরম আবহাওয়া ডেকে আনছে মৃত্যু আর ধ্বংস। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিপর্যয় এড়াতে হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি কমিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে বাড়তি দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সেজন্য কমাতে হবে কার্বন গ্যাস নির্গমন। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বনেতারাও তাতে একমত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে এ লক্ষ্য অর্জনে বেশিরভাগ দেশ প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। লক্ষ্য অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমানো, আর ২০৫০ সালের মধ্যে মোটামুটি শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা দরকার। কিন্তু গ্লাসগো সম্মেলনে যত প্রতিশ্রুতি এসেছে তাতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রীর বেশি হওয়ার পথে এগোবে বলে একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে ক্লাইমেট এ্যাকশন ট্র্যাকার।