কাজিরবাজার ডেস্ক :
স্কুলগুলোতে চলছে নিবন্ধনের তোড়জোড়। এসব স্কুল থেকে শিশু শিক্ষার্থীদের তালিকা ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পেরিয়ে পৌঁছেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়ে। আইসিটি মন্ত্রণালয় শুরু করেছে নিবন্ধন কার্যক্রম। একবারে সব শিক্ষার্থীর নিবন্ধন সম্ভব না হলেও ধীরে ধীরে সব শিক্ষার্থীই নিবন্ধিত হবে টিকার জন্য। আর এই কার্যক্রম ত্বরিত গতিতে চলবে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। এতে করে শিশু শিক্ষার্থীদের করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি নিম্নের দিকে থাকবে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে টিকা পেতে যাচ্ছে এই ভেবে উচ্ছ্বসিত শিশু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন যেহেতু সিরিঞ্জ ভীতি বড়-ছোট অনেকেরই মধ্যেই রয়েছে তাই শিশুদের টিকা দিতে কিছুটা বেগ পেতে হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের। কিছু কিছু অভিভাবকের মধ্যেও এখনো বাচ্চাদের টিকা দেয়াবেন কি না তা নিয়ে রয়েছে দ্বিধা। তাই এসব দ্বিধা কাটাতে স্কুল-কলেজে টিকাদান কর্মসূচী শুরুর আগে শিশু শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কাউন্সিলিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষার্থীদের তালিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এসে পৌঁছেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা আইসিটি মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করেছে। এখন শুধু টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা বাকি। আর এই প্রস্তুতির প্রেক্ষিতেই ১ নবেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে টিকাদান কর্মসূচী। জানা যায়, ২৭ সেপ্টেম্বরে আসা ৫০ লাখ টিকার সঙ্গে হাতে দুই কোটি টিকা মজুত রয়েছে। এসব টিকার মধ্য থেকেই শিক্ষার্থীদের প্রথমে ঢাকায় ১২টি কেন্দ্রে টিকা দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। একটু সময় নিয়ে সারাদেশেই শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া হবে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী প্রতি দিন ৪০ হাজার টিকা দেয়া যাবে। তিনি বলেন, ১২ থেকে ১৭ বয়সী শিক্ষার্থীদের দেয়া হবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি করোনার টিকা। তিনি জানান, নভেম্বরে ফাইজারের আরও ৩৫ লাখ ডোজ টিকা দেশে আসবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২৮ অক্টোবর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন ঢাকা মহানগরীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ১২-১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের কোভিড-১৯ টিকা প্রদানের জন্য স্কুল-কলেজগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে তাদের মধ্যে সঠিক ফরমেটের ডাটা সুরক্ষা ওয়েব সাইটে রেজিস্ট্রেশন সুবিধার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই তথ্যের প্রেক্ষিতে এখন সুরক্ষা সাইটের একটি নির্দিষ্ট অপশনে গিয়ে দ্রুততম সময়ে জরুরী ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম নিশ্চিতভাবে সম্পন্ন করা হবে। অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোঃ গোলাম ফারুক জানান, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ‘ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন’ এবং টিকা গ্রহণের কেন্দ্র হিসেবে ‘ঢাকা স্কুল কেন্দ্র (উত্তর) নির্বাচন করবে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন’ এবং টিকা গ্রহণের কেন্দ্র হিসেবে ‘ঢাকা স্কুল কেন্দ্র (দক্ষিণ)’ নির্বাচন করবে। রেজিস্ট্রেশনের সময় দেয়া মোবাইল ফোনে টিকা গ্রহণের তারিখ এসএমএস এর মাধ্যমে এবং সংশ্লিষ্ট কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা টিকা গ্রহণ করবে তা পরবর্তীতে জানানো হবে। শুধু তাই নয়, আগের দেয়া তথ্যানুযায়ী কোন শিক্ষার্থী সুরক্ষা সাইটে রেজিস্ট্রেশন করতে না পারলে তাদের সঠিক তথ্য পূর্বের নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিক ফরমেটে (জন্ম নিবন্ধন নম্বর টেক্স ফরমেট এবং এক্সেল শিট) এ নির্ধারিত তারিখ এক্সেল ফাইলে প্রতিষ্ঠা থেকে একটি নির্ধারিত ইমেইলে পাঠাতে হবে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের টিকাপ্রাপ্তির খবরে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। রাজধানীর ইউনিভার্সেল টিউটরিয়ালের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ইশানের মা সঞ্চিতা বলেন, শিশুদের টিকা দেয়া হচ্ছে এটা সত্যি ভাল খবর। কিন্তু আমি চাই না এখনই আমার ছেলেকে টিকা দেয়াতে। যদিও নিবন্ধন করেছি। কিন্তু কয়েকদিন দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নেব এ ব্যাপারে। একই কথা বলেন, রাজধানীর ভিকারুননেসা স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তাথৈয়ের বাবা শংকর সাহা। তিনি বলেন, স্কুল-কলেজ পুনরায় খুলেছে এটি শিশুদের জন্য উচ্ছ্বাসের হলেও আমাদের সর্বক্ষণ টেনশনে থাকতে হয়। এই বুঝি বাচ্চা করোনায় সংক্রমিত হবে। এই বুঝি মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেললো। এখন তাদের টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি লাগছে। তবে এই টিকাদান কর্মসূচী আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে করা হলে ভাল ছিল। যদিও একটি ট্রায়াল হয়েছে। কিন্তু সন্তানের নিরাপত্তার জন্য এটি পর্যাপ্ত নয়। আরও বেশ কয়েক ধাপে শিশুদের ওপর টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন ছিল।
তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও শিশুদের টিকাদান কর্মসূচী সাফল্যের সঙ্গে চলছে দাবি করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন যেহেতু আমরা পেয়েছি সেহেতু শিক্ষার্থীদের টিকা দিতে কোন বাঁধা নেই। তবে এক্ষেত্রে শিশুদের পাশাপাশি অভিভাবকদের বোঝাতে হবে টিকার কার্যকারিতা। আমরা মনে হয় ঠিকমতো বোঝাতে পারলে কারো মধ্যে কোন দ্বিধা থাকার সুযোগ নেই। শিশুদের টিকাদানের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের কাউন্সিলিং করলে আর কোন বিপত্তি থাকবে না বলে জানান করোনা প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল আর্সনালও। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশই এখন শিশুদের টিকা দিচ্ছে। ফাইজারের টিকা এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আমরাও তাদের মতো ফাইজারের টিকাই শিশুদের দিচ্ছি। তাই এতে আতঙ্কের কোন কারণ নেই। এতে করে করোনা প্রতিরোধে শরীরে যেমন এন্টিবডি তৈরি হবে তেমনই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর আগে ২১ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের তালিকা পেলে এ মাসেই তাদের টিকাদান শুরু হবে। তাদের ৩০ নবেম্বরের মধ্যে ওই তালিকা আইসিটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা রয়েছে। শিশুদের টিকাদান কার্যক্রমের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ প্রস্তুত। তিনি বলেছেন, স্কুল শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটির মতো। তাদের জন্য তিন কোটি ডোজ টিকা লাগবে। যা আমাদের হাতে আছে। আমরা এখন অপেক্ষায় আছি নিবন্ধনের জন্য। আইসিটি বিভাগের মাধ্যমে নিবন্ধন হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তালিকা আইসিটি বিভাগকে দেবে। তারা তাদের সিস্টেমে তা নিয়ে নেবে। তখন থেকে শিক্ষার্থীরা নিবন্ধন করে টিকা নিতে পারবে। একেবারে সব নিবন্ধন করা সম্ভব হবে না। নিবন্ধন হতে থাকবে আমরা টিকাও দিতে থাকব। তবে সার্বিক প্রস্তুতি নিতে মাস পেরিয়ে নতুন মাস শিক্ষার্থীদের টিকাদানের মাধ্যমে শুরু হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী।
এর আগে ১৪ অক্টোবর মানিকগঞ্জের কয়েকটি স্কুলের ১২০ জন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষামূলক ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ দেয়া হয়। তাদের ১০ থেকে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ওই পর্যবেক্ষণে কোন শিশুর শরীরে কোন ধরনের জটিলতা দেখা না দেয়ায় পরবর্তীতে দেশব্যাপী শিশু শিক্ষার্থীদের টিকাদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।