আতিকুর রহমান মাহমুদ ছাতক থেকে :
ছাতকে খছরু মিয়া (৪৯) হত্যা মামলার মূল আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও হত্যাকান্ডে জড়িত কোন আসামী এখনো আটক হয়নি। এতে নিহতের স্ত্রী ও মামলার বাদিনীসহ পরিবারের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট পুলিশ প্রশাসনের প্রতি অসন্তোষ। পিতার হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করছেন সন্তানরা।
৯ সন্তান নিয়ে স্বামীবিহীন স্ত্রীও ভালো নেই। তিনি তার স্বামী হত্যার বিচার চান।
জানা যায়, উপজেলার ভাতগাঁও ইউনিয়নের জহিরপুর গ্রামের সাবেক মেম্বার নুর মিয়া গংদের জমি প্রায় ৪বছর ধরে দেখাশুনাসহ ধানক্ষেত করে আসছিলেন পাশের বাড়ির ও তালতো ভাই মৃত আলতাব আলীর পুত্র খছরু মিয়া। প্রতি বছর ক্ষেতের উৎপাদিত ফসল অর্ধেক নিজে ও জমির মালিকদের কথামত বাকী ফসল স্থানীয় মাদরাসায় দিতেন। এতে গায়ে জ্বলতো জমির মালিকের শ্যালক, একই বাড়ির মৃত আলফত আলীর পুত্র মজু মিয়ার। এনিয়ে দু’পরিবারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর নুর মিয়াদের ওই জমিতে ছোট মাছ দেখতে পেয়ে ছেলে তাজবীর হোসেন ও নাতি পায়েল মিয়াকে জমিতে পাঠিয়ে দেন খছরু মিয়া। জমিতে মাছ ধরতে গেলে মজু মিয়া গালিগালাজ করে। বিষয়টি খছরুর কানে আসে। ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পাশের বাড়ির তালতো ভাই মজু’র বড় ভাই ফয়জুর রহমানের কাছে বিচার প্রার্থী হয় খছরু। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে কৌশলে বাড়ি ফিরে এসে দা’নিয়ে প্রতিপক্ষকে জবাব দিতে ঘর থেকে বেরুলে মধ্যস্থতায় দা’টি কেড়ে নেয় স্ত্রী বিনা বেগম ও বোন সাকিনা। ওই সুযোগে প্রতিপক্ষের লোকজনরা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে খছরুর উপর হামলা চালায়। তাকে মাটিতে ফেলে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে হামলাকারীরা। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় কৈতক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
চিকিৎসাধিন অবস্থায় ওইদিন রাতেই সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ঘটনার একদিন পর গ্রামের মৃত আলফত আলীর পুত্র মজু মিয়াকে প্রধান আসামি করে ছাতক থানায় একটি হত্যা মামলা (নং-৩১) দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী বিনা বেগম।
মামলার অন্যান্য আসামিরা হলেন, মৃত আলফত আলীর পুত্র ফয়জুর রহমান, মৃত মখলিছ মিয়ার পুত্র আবুল হোসেন, আবুল বশর ও আবদুল কুদ্দুছ, মজু মিয়ার পুত্র রুবেল মিয়া, জুবেল মিয়া ও সাহেল মিয়া, আতাউর রহমানের পুত্র সাজু মিয়া, মৃত আলকাছ মিয়ার পুত্র আবদুল হামিদ, আজিজুর রহমানের পুত্র পাবেল মিয়া, ফয়জুর রহমানের পুত্র নাজমুল হোসেন, আবদুন নুরের পুত্র শফিকুন নুর ও আবুল হোসেনের স্ত্রী শামছিয়া জাহান লিনা।
ঘটনার পরদিন সকালে গ্রামের আব্দুন নুরের পুত্র শফিকুন নুর ও আসামী আবুল হোসেনের স্ত্রী শামছিয়া জাহান লিনাকে আটক করে থানা পুলিশ।
সরজমিন ঘুরে জানা যায়, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মজু মিয়া, তার ছেলেরা ও ভাইসব মিলে পাশের বাড়ির খছরু মিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। পুত্র শোকে কাতর নিহতের মা জয়ধুন বিবি (৯০) জানান, প্রায় পাঁচ মাস আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তার বড় ছেলে গয়াছ মিয়া মারা গেছেন। সেই শোক সইতে না সইতে তুচ্ছ ঘটনার জেরে জামাতা ফয়জুর রহমানের নির্দেশে তার তৃতীয় পুত্র খছরু মিয়াকে হত্যা করেছে। পুত্রকে যারা খুন করেছে তিনি তাদের ফাঁসি দেখে মরতে চান। নিহতের বোন ও মামলার দুই নম্বর আসামি ফয়জুর রহমানের স্ত্রী সকিনা বেগম জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ভাই খছরু মিয়া বিচার চাইতে এসেছিল তার ভাসুরের কাছে। এসময় দেবর মজু মিয়া তাকে দেখে হুমকি দিয়ে বলেছিল কত ধানে কত চাল দেখাবো। পরে খছরু বাড়িতে গিয়ে দা’ নিয়ে বেরিয়ে আসে।
এসময় তিনি ও বিনা বেগম দা’টি কেড়ে নেন। কিন্তু তার পুত্র তাজবীরকে আঙিনা থেকে সরিয়ে নিতে আসলে ওই সময় মজু মিয়ারা মিলে খছরুকে মাটিতে ফেলে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। এসময় তিনি মধ্যস্থতা করতে গিয়ে বাম হাতে প্রচন্ড আঘাত পান এবং অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে খবর পান তার ভাই মারা গেছে। তিনি তার ভাইয়ের খুনিদের শাস্তি চান। নিহতের চাচাতো ভাই শিপন মিয়া বলেন, শিশুদের মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে মজু মিয়াসহ তার বাহিনীরা খছরু মিয়াকে খুন করেছে। হত্যাকারিদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন সোহেল মিয়া ও ঝুনু মিয়া ও আব্দুল কাদির।
গ্রামের লোকজনরা জানান, ঘটনার ৫ দিন পর আসামি আবুল হোসেনের বসতঘরে লুটপাট হয়েছে। লুটপাটের খবর পেয়ে পরদিন ইউপি চেয়ারম্যানসহ থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। হত্যাকান্ডের পর থেকে নিহতের বোন সকিনা বেগম ছাড়া বাকি আসামিদের বসতঘর তালাবদ্ধ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার একাধিক লোকজনরা জানান, প্রকৃত পক্ষে যারা এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত তাদেরকে গ্রেফতার করে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। কিন্তু ঘটনার সাথে যারা জড়িত নয় এমন কিছু মানুষকে মামলায় আসামি করে হয়রানী করা হচ্ছে। তারা বলেন, প্রতি হিংসা বশত আব্দুল হামিদ, আবুল বশর, আব্দুল কুদ্দুছ, শফিকুন নুর ও নাজমুল হোসেনকে আসামি করা হয়েছে। থানায় মামলা দায়েরের পূর্বে ‘বাংলা টু লন্ডন’ নামক ফেসবুকের একটি পেইজে জনৈক ব্যক্তির কাছে নিহতের স্ত্রী ও মামলার বাদি বিনা বেগম যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আবুল বশর, আব্দুল কুদ্দুছ ও আব্দুল হামিদের নাম বলেন নাই। অথচ ওই মামলায় তাদেরকে আসামি করা হয়। তার দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী রুবেলের মা আয়তেরা, পায়েলের মা জামিরুন জড়িত থাকলেও তাদেরকে মামলায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি
বক্তব্যের অন্য অংশে তিনি উল্লেখ করেন, আবুল হোসেনের স্ত্রী রিনাকে পরদিন মোটরসাইকেল যোগে অন্যত্রে পালিয়ে যাওয়ার সহযোগিতা করায় শফিকুন নুরকে পুলিশ আটক করে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও থানার উপ-পরিদর্শক আসাদুজ্জামান বলেন, মামলার এজহারভুক্ত দুই আসামিকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
ছাতক থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ নাজিম উদ্দিন বলেন, খছরু মিয়া হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।