॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
মানুষ মহান আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি। এই মানুষকে কেন্দ্র করেই সমগ্র সৃষ্টিজগতের সকল আয়োজন। আধুনিককালে মানুষের জীবন কীভাবে আরো ফলপ্রসূ করা যায় তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ এই মানুষের উন্নয়ন সাধন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করতে হলে প্রয়োজন যথার্থ কৌশল প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন। আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা ইসলাম মানবসম্পদ উন্নয়নে কী কী নির্দেশনা দিয়েছে তা এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের পরিচয়, এ ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা বাস্তবায়নে জ্ঞান অর্জন, জীবিকা অর্জন, স্বনির্ভরতা অর্জন, কর্তব্য পালন, যোগ্যতা অর্জন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে ইসলামের গুরুত্বারোপ ও কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপ বিষয়ে অত্র প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে পরকালীন চেতনা ও নৈতিকতার শিক্ষার গুরুত্ব দলীলসহ উপস্থাপন করা হয়েছে।
মানবসম্পদ উন্নয় আধুনিক উন্নয়ন চিন্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ ধারণা। বিশ শতকের শেষ দশকে এ ধারণার প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ঘটে। বর্তমানে উন্নয়ন চিন্তার ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণাটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে এবং সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা অন্য যে উন্নয়নের কথাই বলা হোক, সকল উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মানবসম্পদ। একে ঘিরে এবং এর জন্যই সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টা। টেকসই উন্নয়ন, সমন্বিত উন্নয়ন ধারণা, সামগ্রিক উন্নতি বা সর্বাত্মক সুষম উন্নয়ন, সকল ক্ষেত্রে মানুষের সুখ-সুবিধাই মূল বিবেচ্য হয়ে থাকে। মানবসম্পদ উন্নয়ন ছাড়া প্রাকৃতিক, নৈসর্গিক বা পরিবেশগত কোনো সুবিধা গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। বর্তমাান উন্নয়ন ধারায় প্রথমে তাই মানবসম্পদ উন্ননে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণকে আবশ্যিক বলে গণ্য করা হয়। ইসলাম গোড়া থেকেই মানবসম্পদ উন্নয়নকে সামগ্রিক উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম মানবকে সত্যিকারার্থে শ্রেষ্ঠতম সম্পদ বলে ঘোষণা করেছে এবং এর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিধি-ব্যবস্থাসমূহ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাস্তব উদ্যোগে গ্রহণ করেছে।
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মানব সম্পদ উন্নয়ন ধারণাটির বিকাশ ও বিস্তারে যে পরিমাণ গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে এবং গুরুত্ব প্রদানের প্রেক্ষাপটে যে ফল লাভ হচ্ছে তা নিতান্তই অপ্রতল। এতে মানুষের বৈষয়িক উন্নয় কিছুটা হয়তো হচ্ছে, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি, সহযোগিতা ও ভালোবাসা বস্তুগত অর্জনের কাছে প্রতিনিয়ত মার খেয়ে যাচ্ছে। মানবিক বিপর্যয়ের চালচিত্র প্রতিদিনই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে, যা মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এমতাবস্থায় মানবসম্পদ উন্নয়নে ইসলামের ভূমিকা বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন একান্ত আবশ্যক। এ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন মানবসম্পদ উন্নয়নে আধুনিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতা এবং সফলভাবে মানবসম্পদ উন্নয়নের পথ নির্দেশ করবে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিচিতি : উন্নয়ন একটি মৌলিক পরিবর্তন প্রক্রিয়া, যা সমগ্র সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে একটি সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ভৌত কাঠামো, পাশাপাশি সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ ব্যবস্থা ও জীবন ধারণা পদ্ধতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হয়। উন্নয়ন একটি ব্যাপক ধারণা, যা একটি সমাজকে বর্তমান অবস্থান থেকে অধিকতর কাম্য অবস্থানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত করে এবং এই কাম্য লক্ষটি নির্ধারিত হয় ঐ সমাজের জনগণের ইতিহাস অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হতে। উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু মানুষ। এটি একটি পথ মাত্র, চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। যে উন্নয়নে মানুষের জীবন উন্নত হয় না বা যাতে মানুষের অংশগ্রহণ থাকে না, সে উন্নয়ন উন্নয়নই নয়। এ বোধই মানবসম্পদ উন্নয়ন ধারণার জনক, যার মূল কথা মানুষের উন্নয়ন, মানুষের জন্য উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন। উন্নয়ন সম্পর্কিত নতুন এ ধারণাটির উদ্ভবের ফলে মানবিক দিকটি যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করে। বৈশ্বিকরণ প্রক্রিয়া জোরেসোরে উচ্চারিত হওয়ার সময়ও স্থিতিশীল ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের সাথে মানব উন্নয়নকে আবশ্যিকভাবে যুক্ত করা হয়। কারণ মানব উন্নয়ন ধারণা সৃষ্টিশীলতা ও বিকাশকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। সাধারণ কথায়, মানবসম্পদ উন্নয়নকে বলা হয়, People Centre Development অর্থাৎ উন্নয়ন ব্যবস্থা হবে সম্পূর্ণ মানবকেন্দ্রিক; মানুষ নিজেরা নিজেদের দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন ঘটাবে এবং নিজেরাই তার ফল ভোগ করবে। শিক্ষাবিদ-গবেষকগণের কেউ কেউ মানবসম্পদ উন্নয়নকে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট করে দেখেছেন যা কর্ম-কৃতিত্ব (Job Performance) বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা বলেছেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো কর্ম-কৃতিত্ব উন্নয়ন বৃদ্ধির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে সংগঠিত শিক্ষা অভিজ্ঞতা।
মানবসম্পদ উন্নয়নে ইসলামের পদক্ষেপসমূহ : ইসলামে মানব উন্নয়ন আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের মূল বিষয়। কুরআন মাজীদের মৌলিক বিষয় হলো মুসলিমের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য মানব উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ গঠন। এ উন্নয়নের জন্য ইসলাম মানুষের দৈহিক আকৃতিতে মানুষ হওয়ার সাথে সাথে মানবিক ঔদার্য ও মানসিক সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ার উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলাম ঘোষণা করেছে, আল্লাহ তা’য়ালার সৃষ্টি হিসেবে মানুষ সম্মানিত এবং শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ তা’লাই মানুষকে এ শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি বানিয়েছেন’।
তিনি অন্যত্র বলেছেন: নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দিয়েছি, তাদেরকে স্থলভাগে ও সাগরে চলাচলের বাহন দিয়েছি, তাদেরকে পবিত্র জীবিকা দিয়েছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তবে মানুষের এ শ্রেষ্ঠত্বকে আল্লাহ তা’য়ালা স্থায়ী ও অক্ষয় করে দেননি। বরং মানুষের আচরণিক ও আত্মিক উন্নয়ন করা ও না করার উপর এর ভিত্তি স্থাপন করেছেন। কেউ যদি আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশনা মেনে নিজের আচরণ ও মানসিকতা উন্নত করে তাহলে সে তার শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে পারবে। আর যদি এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় তাহলে নীচ থেকে নীচতর স্তরে নেমে যাবে। ‘‘আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে বলেছেন: নিশ্চয় আমি মানুষকে সুন্দরতম করে সৃষ্টি করেছি। এরপর আমি তাকে সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে দিয়েছি’’। মানুষের মর্যাদা ও সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার পথ হিসেবে আচরণিক ও আত্মিক উন্নয়ন অনিবার্য করে ইসলামে মানবসম্পদ উন্নয়ন চেষ্টা নৈতিকভাবে সকলের জন্য বিধিবদ্ধ উপায়ে আবশ্যিক করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আবশ্যিক হয়েছে জ্ঞান অর্জন, হালাল জীবিকা উপার্জন ও গ্রহণ, স্বনির্ভরতা অর্জন, কর্তব্য পালন, যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ, আখিরাতে সফলতা- ব্যর্থতাকে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ এবং বিশেষভাবে নৈতিক উন্নয়ন।
জ্ঞান অর্জন : মুমিন হওয়ার জন্য জ্ঞান অর্জনকে ইসলাম প্রথম শর্ত হিসেবে গণ্য করেছে। আল্লাহ তাআলা প্রথম মানুষ আদম (আ.) কে সৃষ্টির পর সবার আগে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন এবং এ জ্ঞানের পরীক্ষাতেই আদম (আ.) এর মাধ্যমে ফেরেশতাদের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। কুরআন মজীদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আল্লাহ আদমকে প্রতিটি বিষয়ের নাম শেখালেন। এরপর তা ফেরেশতাদের সামনে পেশ করলেন এবং বললেন, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে আমাদের এগুলোর নামসমূহ জানাও।’ ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি মহাপবিত্র। আপনি আমাদের যা শেখান, তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী, মহা প্রজ্ঞাময়।’ আল্লাহ বললেন, ‘হে আদম! তুমি যাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দাও।’এরপর যখন আদম তাদেরকে বিষয়গুলোর নাম জানিয়ে দিলেন, আল্লাহ তাআলা বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নিশ্চয় আমি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অদৃশ্য সম্পর্কে জানি? আর আমি খুব ভালভাবেই জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা গোপন রাখ। যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ছাড়া সকলেই সিজদা করল। ইবলীস অবাধ্য হল ও অহঙ্কার করল এবং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন রিসালাত লাভ করলেন তখন তাঁর উপর প্রথম যে ওহী নাযিল হল তাও জ্ঞানার্জন বিষয়ক। হিরাগুহায় ধ্যানমগ্ন রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথম ওহী লাভ করলেন, পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন; যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত হতে। পড়ুন এবং আপনার প্রতিপালক মহাসম্মানিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তা, যা সে জানত না। জ্ঞানকে মর্যাদা ও কল্যাণের বাহন বর্ণনাকরে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দেবেন।” অন্যত্র বলা হয়েছে, তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমাত দান করেন। আর যাকে হিকমাত দেয়া হয় তাকে বিপুল কল্যাণ দান করা হয়। আর জ্ঞানীরা ছাড়া কেউ তো উপদেশ গ্রহণ করে না। আল্লাহ তাআলা সাধারণভাবে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি উচ্চতর গবেষণারও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অতএব হে চক্ষুষ্মান মানুষেরা! তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। জ্ঞানের প্রতি আল্লাহ তাআলার এমন গুরুত্বারোপের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা.) জ্ঞান অর্জনকে ফরয ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতিজন মুসলিমের উপর ফরয। জ্ঞানীকে তিনি নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরী আখ্যায়িত করে বলেছেন, আলিমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে দীনার বা দিরহাম রেখে যাননি। তারা উত্তরাধিকার রেখে গেছেন শুধু জ্ঞান। তাই যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করেছে সে অর্জন করেছে উত্তরাধিকারের পুরো অংশ। জ্ঞানার্জনের কাজকে তিনি আল্লাহর পথে জিহাদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণে বের হয়েছে, সে আল্লাহর পথে রয়েছে, যতক্ষণ না সে প্রত্যাবর্তন করে। এভাবে ইসলাম জ্ঞানার্জন ও গবেষণার কাজকে বাধ্যতামূলক রেখে মানবসম্পদ উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এতে এমন বিধান রাখা হয় যে, একজন মানুষ মুসলিম হলে তাকে অবশ্যই শিক্ষিত হতে হয়। শিক্ষিত হওয়া ছাড়া মুসলিম হওয়ার বিষয়টি বিধিগতভাবে অসম্ভব বলে গণ্য হয়।
জীবিকা অর্জন : আল্লাহ তাআলার ইবাদত যেমন ফরজ, ইসলামে জীবিকা উপার্জনকে তেমন ফরজ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এরপর যখন সালাত আদায় শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করবে এবং আল্লাহর বেশি বেশি যিকর করবে, এতে তোমরা সফল হবে। আবার জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রেও হালা-হারামের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এমন প্রবলভাবে যে, ইবাদত কবুল হবে কি না, ব্যক্তি জান্নাতে যাবে কি না তা একান্তভাবে জীবিকা উপার্জনের পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল রাখা হয়েছে। ফলে ইসলামে একজন ব্যক্তি কেবল জীবিকাই উপার্জন করে না বরং হালাল উপায় অবলম্বন করে বৈধভাবে জীবিকা উপার্জন করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হালাল উপার্জন অন্বেষণ করা ফরজের পরে ফরজ। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, তোমরা উত্তম ও পবিত্র বস্তু আহার করো, যা আমি তোমাদের জীবিকারূপে দিয়েছি এবং কৃতজ্ঞতা আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা একান্তই তাঁর ইবাদাত করো। আল্লাহর রাসূল (সা.) এ প্রেক্ষাপটেই বলেছেন, হারাম সম্পদে তৈরি গোশত ও রক্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং হারাম সম্পদে তৈরি প্রতি টুকরো গোশত ও প্রতি ফোটা রক্তের জন্যে নরকই যথোপযুক্ত আবাস।
স্বনির্ভরতা অর্জন : ইসলামে কেউ কারো গলগ্রহ হয়ে থাকাকে সমর্থন করা হয়নি। ব্যক্তি নিজে উপার্জন করবে, নিজের আয়ের উপর নির্ভর করবে। অন্য কারো আয়ে ভাগ বসাবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, পবিত্রতম উপার্জন হলো মানুষের নিজের হাতের পরিশ্রম এবং প্রত্যেক বিশুদ্ধ ব্যবসায় (এর উপার্জন)। স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য কাজ করতে হলে কেউ যেন তাতে দ্বিধা না করে, লজ্জিতবোধ না করে তা নিশ্চিত করার জন্য ইসলামের শ্রম ও শ্রমিককে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। নানাভাবে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা শ্রম পছন্দ করেন। শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে তিনি বলেছেন, যারা তোমাদের কাজ করে জীবিকা উপার্জন করে, সে শ্রমিক তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই যাদের কাছে এমন লোক আছে তাদেরকে যেন তা-ই খেতে দেয় যা তারা নিজেরা খায়, তাদেরকে যেন তা-ই পরতে দেয়, যা তারা নিজেরা পরে। তোমরা তাদেরকে তাদের সামর্থ্যরে বাইরে কোনো কাজ করতে বাধ্য করবে না। যদি তাদেরকে তোমরা কোনো কঠিন কাজ করতে দাও, তা হলে তোমরা তাদের সহযোগিতা করবে। শ্রমিককে যেন তার প্রাপ্য মজুরির জন্য নিয়োগকর্তার পেছনে ঘুরতে না হয় এবং শ্রমের ন্যায্য মূল্য নিয়ে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকের মধ্যে যেন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন, শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে রাফি’ ইবনু খাদীজ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কে একদা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন প্রকারের উপার্জন উত্তম ও পবিত্রতম? তিনি বলেছেন, ব্যক্তির নিজের শ্রমের উপার্জন ও সৎ ব্যবসায়লব্ধ মুনাফা। আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল (সা.) নানাভাবে মানুষকে কাজ করায় উৎসাহ দিয়েছেন। ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি অনীহা তৈরির জন্য রাসূল (সা.) বলেছেন, নিচের হাতের চেয়ে উপরের হাত উত্তম। আল্লাহ তা’আলার হুকুম আর আল্লাহর রাসূলের এ নির্দেশনা মেনে ব্যক্তি যদি স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে অনিবার্যরূপে তাঁর ব্যক্তিত্ব, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। এভাবে উন্নয়ন ঘটবে মানবের। অদক্ষ-অক্ষম বোঝার পরিবর্তে ব্যক্তি উন্নত সম্পদে পরিণত হবে।
কর্তব্য পালন : ইসলাম সাধারণভাবে সকল মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সকলের জন্য অর্পিত কর্তব্য পালন আবশ্যিক করেছে এবং এ ক্ষেত্রে যে কোন অবহেলাকে আল্লাহ তাআলার নিকট জবাবদিহিতার বিষয় বলে সতর্ক করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, ইমাম বা নেতা, যিনি জনগণের ওপর দায়িত্ববান-তিনি তার অধীনদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন। আর ব্যক্তি, যে তার পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বশীল- সে তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী দায়িত্বশীল তার স্বামীর পরিবারের সদস্যদের ও সন্তান-সন্ততির। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। আর দাস ব্যক্তি তার মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল এবং সে এই সম্পদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কাজেই সতর্ক হও! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে (পরকালে আল্লাহর নিকট) জিজ্ঞাসিত হবে। ইসলাম একন্তভাবে মানুষকে এ শিক্ষা দিয়েছে, কেউ কারো বোঝা বহন করবে না।
আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন, যারা সরল-সঠিক পথে পরিচালিত হবে নিশ্চয় তারা তাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই সঠিক পথে পরিচালিত হবে। আর যারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তারা ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হবে তাদের নিজেদের ধ্বংসের জন্যই। কেউ কারো কাজের দায় বহন করবে না। আর আমি রাসূল পাঠিয়ে সতর্ক করা ছাড়া কাউকে শাস্তি দেই না। ইসলামের এ নীতি একান্তভাবে দায়িত্ব সচেতন করে এবং দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এ নীতি মানুষকে এমনভাবে ভাবতে শেখায় যে, কেউ অন্য কারো কবরে যাবে না। কেউ অন্য কারো কাজের জবাবদিহিতা করবে না। সাধারণভাবে কেউ অন্য কারো কাজের সুফল বা দায় ভোগ করবে না। বরং প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজের সুফল বা কুফল ভোগ করতে হবে। এ শিক্ষার ফলে মানুষ নিজেকে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে গড়ে তোলে। এটি তার ব্যক্তি সত্তার উন্নতি বিধান করে।
যোগ্যতা অর্জন ও দক্ষতা বৃদ্ধি : ইসলাম মানুষে মানুষে মানবিক কোন ব্যবধান বা বৈষম্য স্বীকার করেনি। মানবিক মর্যাদায় সাধারণভাবে সকলকে সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করেছে। মানুষের উৎস ও বিস্তার সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন, যিনি সৃষ্টি করেছেন সে ব্যক্তি থেকে তার জোড়া, আর তাদের দুজন থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ ও নারী। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অন্যের নিকট কিছু চাও। আর তোমরা আত্মীয়দের (হক আদায় ও সম্পর্ক অটুট রাখার) ব্যাপারে সতর্ক হও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।
আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন, হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে মানবজাতি! সাবধান! নিশ্চয় তোমাদের রব একজন, তোমাদের পিতাও একজন। সতর্ক হও! কোন আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন কালোর উপর সাদার কিংবা সাদার উপর কালোর তাকওয়া ব্যতীত কোন মর্যাদা নেই। সাধারণভাবে সকল মানুষকে এভাবে সমান ঘোষণার পর কুরআন ও হাদীসে মানুষের উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের জন্য বিশেষ যোগ্যতা অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তিই সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি তাকওয়াবান। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন। (অসমাপ্ত)