কাজিরবাজার ডেস্ক :
আগামী জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, ততই নানামুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত বাড়বে। সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার নামে অপপ্রচার চালানো হতে পারে। এ ব্যাপারে সর্বদা সজাগ ও সতর্ক থেকে এসব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সত্য তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জবাব দিতে হবে, উকিল নোটিস প্রদানসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আর আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এখন থেকেই নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজ শুরু করতে হবে। দলের মধ্যে থাকা দ্বন্দ্ব-বিবাদ দ্রুত নিরসন করে একদম তৃণমূল পর্যন্ত দলকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। দলের মতের বিরুদ্ধে কাজ করলে সে যত বড় নেতাই হোন না কেন তাৎক্ষণিকভাবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কাউকেই ন্যূনতম ছাড় দেয়া হবে না।
প্রায় এক বছর পর বৃহস্পতিবার গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের দীর্ঘ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন নির্দেশনা দিয়েছেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক শুরু হয়। নামাজ ও মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতিসহ বিকেল সোয়া তিনটার দিকে বৈঠকটি শেষ হয়। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের ৫৩ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে শোক প্রস্তাব উত্থাপনের পর সাত বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের সাংগঠনিক লিখিত রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন। সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন দেশের বাইরে থাকায় চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ওই বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট বৈঠকে তুলে ধরেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, করোনার কারণে দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সাংগঠনিক এবং আগামী নির্বাচন নামনে রেখে দলীয় প্রস্তুতির বিষয়গুলো রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রাধান্য পায়। বৈঠকে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়া সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি ফেরানোর নির্দেশ দেন সভাপতি শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে একটি সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের জন্য দলের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজও শুরুর নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে তাই সরকারবিরোধী অপপ্রচার বেশি হচ্ছে। এসব অপপ্রচার সাংগঠনিকভাবে মোকাবেলা করার তাগিদ দেয়া হয়েছে বৈঠকে। এছাড়া দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি ভবিষ্যতে কখনও নৌকার মাঝি করা হবে না বলেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে বৈঠক থেকে।
বৈঠক শেষে গণভবনের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, পরবর্তী (দ্বাদশ) নির্বাচনের প্রস্তুতির লক্ষ্যে আমাদের অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করার নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের বিভিন্ন উপ-কমিটি সেমিনারের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনের যে ইশতেহার হবে, সেখানে যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে; সেগুলো আপডেট করার জন্য উপ-কমিটিগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় আমরা কী কী অন্তর্ভুক্ত করব তা তুলে ধরা হবে। তিনি জানান, যেখানে যেখানে সাংগঠনিক সমস্যা আছে এবং যেগুলো সমাধান করা দরকার, সেগুলোর ব্যাপারে বৈঠকে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিছু কিছু ছোটখাটো কলহ-বিবাদ আছে, সেগুলোও মীমাংসা করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
বৈঠক সূত্র জানায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সাংগঠনিক রিপোর্টে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে তৃণমূলে এমপিদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দূরত্বের বিষয়টি উঠে আসে। এর জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, এমপিরা এমপিত্ব করবে, দলও করবে। কিন্তু খবরদারি করবে না। জেতার জন্য অনেককেই মনোনয়ন দেয়া হয়। তার অর্থ এই নয় যে, তারাও দলে খবরদারি করবে। এমপিরা যেন দলের ভেতরে দল তৈরি না করে- সে বিষয়ে সতর্ক করে তিনি বলেন, কমিটি কমিটির গতিতে হবে। দলের ভেতরে গ্রুপিং বা উপদল তৈরি করা যাবে না। ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দলকে শক্তিশালী করতে হবে। দুর্দিনের ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে হবে।
সভায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের বসে যেখানে যেখানে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল আছে তা দ্রুত নিরসনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে পুরো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রয়েছে। দেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকের গাত্রদাহ হচ্ছে, গা-জ্বালা করছে। তাই সংগঠন যত শক্তিশালী হবে, দেশ যত এগিয়ে যাবে, ষড়যন্ত্র তত দানা বাঁধবে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এই ষড়যন্ত্র আরও বাড়বে। এখনই দেশী-বিদেশী নানা সংস্থা মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণসহ নেতাদের যোগ্য জবাব দিতে হবে। প্রয়োজনে মিথ্যা অপপ্রচারকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে উকিল নোটিস দিয়ে জবাব চাইতে হবে।
ওবায়দুল কাদের আরও যা বলেন : বৈঠকের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের আরও জানান, দলের মতের বিরুদ্ধে কাজ করলে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক্ষেত্রে কাউকে কোনভাবে ছাড় না দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, বৈঠকে আওয়ামী লীগের আট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুনেছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন দেশের বাইরে থাকায় সেখানে আমাদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বক্তব্য রেখেছেন। আমাদের সাংগঠনিক সম্পাদকরা নিজেরা লিখিত রিপোর্ট করেছেন সভানেত্রীর কাছে। দায়িত্ব থাকা এলাকায় তাঁরা ইউনিয়ন, ওয়ার্ডভিত্তিক বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়েছেন। যেখানে যেখানে বিবাদ আছে, সেখানে সমাধান করা দরকার, প্রধানমন্ত্রী দ্রুত কলহ-বিবাদ মীমাংসা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি জানান, পাবনায় পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে সেখানে অনেক বিদ্রোহী করেছিল মনোনয়ন নিয়ে। পৌর এলাকায় যারা বিদ্রোহ করেছিল তারা ক্ষমতা চেয়ে লিখিত জবাব দিয়েছেন নেত্রী (শেখ হাসিনা) বরাবর। নেত্রী তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন যে, যারা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করছে বিভিন্ন জায়গায়, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে কাউকে কোন ব্যাপারে ছাড় দেয়া যাবে না।
বৈঠকে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র চলছে তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, যতই নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে, ততই অপপ্রচারের মাত্রা বাড়ছে। অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র চলছে সরকারের বিরুদ্ধে। এসব অপপ্রচারের জবাব দিতে হবে, চক্রান্তমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। তাছাড়া করোনাকালে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আমাদের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
বৈঠকে নোয়াখালীর ব্যাপারে কোন কথা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের জানান, বৈঠকে কোন কথা হয়নি নোয়াখালীর ব্যাপারে। সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা কাঠামো দাঁড় করিয়েছি সমাধানের জন্য। এ ব্যাপারে নেত্রী অবগত রয়েছেন। জাতীয় সম্মেলন নিয়ে কোন কথা হয়েছে কি না, প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটার কোন এজেন্ডাই ছিল না।
বৈঠক সূত্র জানায়, নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল এমপির দ্বন্দ্বের বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পায়। একইভাবে মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-মুখী কোন্দলের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়। ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি বিষয়টি উত্থাপন করলে এ সময় ওই জেলার তিন প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের মধ্যে কিছুটা বাদানুবাদ হয়। এ সময় দলীয় কোন্দল নিরসনে দলীয় প্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেন মির্জা আজম।
সূত্র জানায়, এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি মুরব্বি। সবাইকে নিয়ে দলটা করবেন। আপনার রাজপথে অনেক অবদান রয়েছে। আমাদের দুঃসময়ে ছিলেন। নৌকা নিয়ে পাঁচবার এমপি হয়েছেন। আপনি যদি নাছিম, গোলাপসহ সবাইকে ডাকেন, কেউ আপনাকে ফেলে চলে যেতে পারবে? কেউই উপেক্ষা করতে পারবে না।’ নাটোর, পাবনা জেলার কোন্দল নিরসনের জন্য দ্রুত সম্মেলন দিতে নিদের্শনা দেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন আগামী ৬ নবেম্বর ও পাবনা ৭ নবেম্বর জেলা সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন মেয়াদ উত্তীর্ণ জেলাগুলোকে দ্রুত সম্মেলনের তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।