কাজিরবাজার ডেস্ক :
সরকারের প্রশাসনের ভেতরে খোলস পাল্টে ঘাপটি মেরে আছে বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা। দেশে-বিদেশে সরকারের ভেতরের গোপন তথ্য পাচার করে দিচ্ছে তারা। গুরুত্বপূর্ণ মামলার তথ্য, আলামত, ভিডিও ক্লিপিং, অডিও রেকর্ডিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করছে এই চক্র। প্রশাসনের ভেতরে আওয়ামী লীগার সেজে বিএনপি-জামায়াতের মতাদর্শের কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টির প্রমাণ পাওয়ার পর এদের চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করছে সরকার। সরকারের নীতি নির্ধারক মহল সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (চলতি দায়িত্বে) শেখ ওমর ফারুক এবং খাগড়াছড়ির মহালছড়ির ষষ্ঠ এপিবিএনের অধিনায়ক মোঃ আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। বিএনপি-জামায়াত ঘরনার সঙ্গে তাদের গোপন যোগাযোগ আছে এই ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে অবসরে পাঠানোর মতো পদক্ষেপ নেয়া হয়। সিআইডির উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক শেখ ওমর ফারুক চিত্রনায়িকা পরীমনি, মডেল পিয়াসা ও মৌয়ের মামলাগুলোর তদন্ত কার্যক্রম তদারক করার সময়ে তার কিছু বিতর্কিত মন্তব্য ও তথ্য পাচারের ঘটনা ঘটে। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত শুরু হতে না হতেই তথ্য ও আলামত পাচার, ভিডিও ক্লিপিং, অডিও রেকর্ডিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একটি ভিডিও ক্লিপ সরাসরি আমেরিকায় বিএনপি-জামায়াতপন্থী বিতর্কিত সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের কাছে চলে যায় এবং তিনি সেটি সেখান থেকে ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করার পর তোলপাড় শুরু হয়। এরপর সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ হলে নড়েচড়ে বসে সরকার।
সিআইডির ডিআইজি ওমর ফারুক অন্তত দুটি সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত যারা পরীমনি, পিয়াসা-মৌয়ের বাসায় গেছেন তাদের জিজ্ঞাসা করার জন্য তালিকা তৈরি করা হবে বলে জানান। এরপর এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। অভিজাত শ্রেণীর ধনাঢ্য বিভিন্ন ব্যবসায়ী সরকারের নীতি নির্ধারক মহলে অভিযোগ করেন। এমনকি পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে তারা ফোন করে চাঁদাবাজির শিকার, হয়রানি হওয়ার ভয়ভীতির কথা জানান। ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশ কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম নিজে একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন যে, বিভিন্ন লোকজন তার কাছে ফোন করে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগকারীরা পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়েছেন, তারা বাসায় থাকবে কিনা ? এরপর কঠোর হস্তে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে তাদের অবসর-সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব ধনঞ্জয় দাসের সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় সরকারী চাকরি ২০১৮ (২০১৮ সালের ৫৭নং আইন)-এর ৪৫ ধারার বিধান অনুযায়ী জনস্বার্থে তাদের সরকারী চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলো। প্রজ্ঞাপনে বলা হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক শেখ ওমর ফারুককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। অভিনেত্রী পরীমনি, মৌ ও পিয়াসার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তত্ত্বাবধান করছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি সিআইডির ঢাকা মহানগর উত্তরের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ছাড়া খাগড়াছড়ির মহালছড়ির এপিবিএন ৬-এর অধিনায়ক মোঃ আবদুর রহিমকেও বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আবদুর রহিম। ওমর ফারুক ও রহিম দু’জনই বিসিএস ১২তম ব্যাচের কর্মকর্তা। চিত্রনায়িকা ও মডেলদের গ্রেফতারের পর গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মামলার অগ্রগতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন ওমর ফারুক। তার এ ধরনের বক্তব্য পুলিশ বাহিনীর নীতিনির্ধারক এবং সরকারের শীর্ষমহল ভালভাবে নেয়নি। এছাড়া তিনি বিএনপি সমর্থক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের জেলা নেত্রকোনার এসপির দায়িত্ব পালন করেছিলেন ওমর ফারুক। বিএনপি আমলে প্রাইজ পোস্টিংও পেয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করে পুলিশে আসা এই কর্মকর্তা। ওমর ফারুক বিএনপির স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন বলে বিশ্বাস করতেন অনেকে। এমনকি বিএনপির শাসনামলে তারা হাওয়া ভবনের হয়ে কাজ করেছেন এমন অভিযোগ পায় সরকারের নীতি নির্ধারক মহল। ওমর ফারুকের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট। ১৯৯১ সালের ২০ জানুয়ারি চাকরিতে যোগদান করেন। এরই মধ্যে প্রায় ২৯ বছর চাকরি করেছেন তিনি। অনেকদিন ধরেই ওমর ফারুককে অবসরে পাঠানোর ব্যাপারে গুঞ্জন ছিল। মডেলদের ঘটনায় তার বিতর্কিত কর্মকান্ড চাকরি থেকে অবসরের প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করে বলে জানা গেছে।
সিআইডির ডিআইজি ওমর ফারুক মডেলদের গ্রেফতারের পর সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, ‘পরীমনি, পিয়াসা ও মৌকে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অনেকের নাম পাওয়া গেছে। তারা ব্ল্যাকমেইলিংসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এতে বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছে। নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। যেসব নাম পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে যারা এসব অপরাধে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো আরেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুর রহিমও বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুরে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে পুলিশ ঢোকা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। পুলিশ কর্মকর্তা রহিম ও কোহিনুর মেয়েদের হলে প্রবেশ করেছিলেন। ওই সময় পুলিশের রমনা বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার ছিলেন রহিম আর ডিবির এসি ছিলেন কোহিনুর। তৎকালীন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে নানা উদ্যোগের পর রহিম ও কোহিনুরের বিরুদ্ধে ওই ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি তৎকালীন প্রশাসন। রহিম জোট সরকারের আমলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার, ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (নর্থ) ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। বিসিএস ১২তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের অনেকে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক হলেও রহিমের পদোন্নতি হয়নি।
সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি বলেছেন, প্রশাসনে বিএনপি-জামায়াতপন্থী যে সমস্ত কর্মকর্তা রয়েছে তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। তথ্য পাচার, গোপন নথি অন্যত্র সরিয়ে নেয়াসহ সরকারবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে বাধ্যতামূলক অবসরের আওতায় আনা ছাড়াও অভিযোগের গুরুত্ব অনুসারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের যেকোন সরকারী কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর নজির অসংখ্য। কিন্তু এতদিন আওয়ামী লীগ সরকার চুপচাপ থাকার কারণে সরকারের ভেতরে অন্তর্ঘাত কর্মকান্ডে তৎপর বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা।