কবি নজরুলের প্রয়াণবার্ষিকী আজ

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,/কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না…। পুরনো চিন্তা সেকেলে ধ্যান ভাঙার অহর্নিশ লড়াই। চির বিদ্রোহ। সাম্যের সমাজ আর মানবিক পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন। আর তার পর মনোবেদনা নিয়ে প্রস্থান। চিরতরে দূরে চলে যাওয়া। আজ ১২ ভাদ্র ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের’ ৪৫তম প্রয়াণবার্ষিকী। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে চিরপ্রস্থান গ্রহণ করেন তিনি। প্রয়াণ দিবসে আজ গানে কবিতায় প্রিয় কবিকে স্মরণ করবে বাঙালি।
নজরুল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক নতুন যুগস্রষ্টা। বিস্ময়কর আলো হয়ে জ্বলছেন। পথ দেখিয়ে চলছেন বাঙালিকে। নিজের জাত চেনাতে কবি লিখেছিলেন- ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর-/বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’ তবে শুধু বিদ্রোহী বীর নন, তিনি ছিলেন ‘বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের।’ ‘অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন। তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভান্ডারটির স্রষ্টা তিনি। অসম্প্রদায়িক এই কবি বাঙালির চিন্তা-মনন ও অনুভূতির জগতে নানাভাবে নাড়া দিয়েছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি নারীর প্রতি উপেক্ষা কখনও মেনে নেননি। সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষের কাছে টেনে নিয়েছেন। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তিনি সম্পর্কিত ছিলেন বটে। সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সারজীবন। ধারালো উচ্চারণে বলেছিলেন, যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত,/আজ নয় কাল ভাঙবে সে তো,/যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া…। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় বহুবার জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে চলেন তিনি। হয়ে উঠেছেন কাজী নজরুল ইসলাম।
অন্যান্য সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলকে ভিন্ন উচ্চতায় আসীন করে। এ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন কবি। মানবতার বাণী প্রচার করেন। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’। এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা’। এই কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থেও ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো দারুণ হৈচৈ ফেলে দেয় সে সময়।
গদ্য রচনার সময়ও স্বতন্ত্র চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন নজরুল। তাঁর প্রথম গদ্য রচনা ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। এখানে বসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান’। একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী’।
তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে সঙ্গীত। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গানের রচয়িতা তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তাঁর সৃষ্ট রাগ বিস্মিত করে বড় বড় প-িতদের।
তবে জীবনের শুরুটা ছিল ভীষণ অনিশ্চয়তার। ক্ষণজন্মা কবি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান নজরুলের পড়ালেখার শুরু মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। রুটির দোকানে কাজ শুরু করেন কবি। বালক বয়সে লোক সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট নজরুল যোগ দেন লেটো দলে। এই লেটো দলেই তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু হয়। পরে মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেছেন। যৌবনে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এভাবে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য আর বিচিত্র জীবনযাপন করেন নজরুল। তবে ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন তিনি। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারান। ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন তিনি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক।
কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
নজরুলের প্রয়াণ দিবসে প্রতি বছর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নেয়া হয় বহু কর্মসূচী। তবে বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেক কিছুই বদলে গেছে। এর প্রভাব পড়বে নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকী পালনেও। ভার্চুয়ালি নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে বলে জানা গেছে। এর বাইরে বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে থাকবে নানা আয়োজন। সব ধরনের আয়োজন থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা জানানো হবে।