কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে ব্যাপক ও ভয়াবহ বোমা হামলা করে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর জন্য অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিয়ে বোমা তৈরির কারিগর বানাচ্ছে আইএসপন্থী নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এই নতুন কৌশল নিয়েছে জঙ্গি সংগঠনটি। জঙ্গি সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যের কাছে অনলাইনে বোমা তৈরির ম্যানুয়েল পাঠিয়ে লাইভ জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে বানানো হচ্ছে বোমা তৈরির কারিগর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর বোমা হামলা করতে বোমা তৈরির কারিগর তৈরি করছে জঙ্গি সংগঠনটি। গ্রেফতার হওয়া কয়েকজন জঙ্গিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া জবানবন্দীতে ও তদন্তে এই ধরনের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাহাদী হাসান জন নামে এক ব্যক্তি নব্য জেএমবি নামের জঙ্গি সংগঠনটির নতুন আমির পরিচয় দিচ্ছেন আবু আব্বাস আল বাঙালি। তুরস্কে বসে জঙ্গি সংগঠনটি সংগঠিত করে সদস্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে বোমা প্রস্তুতের দক্ষ জঙ্গি কারিগর তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তার নির্দেশনাতেই প্রত্যেক সদস্য জঙ্গি সদস্যকে বোমা তৈরিতে দক্ষ করে গড়ে তুলে বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করেছে জঙ্গি সংগঠনটি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত জঙ্গি বিরোধী অভিযানের মুখে জঙ্গি সংগঠনটি কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও এখন আবার জঙ্গি হামলার নেশার মনোভাবে মাঠ পর্যায়ে করে তোলা হচ্ছে আগ্রাসী।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, সাব্বির নামে ভয়ঙ্কর এক জঙ্গি যুবকের সন্ধান পেয়েছেন তদন্তকারীরা। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার দায়িত্বশীল হিসেবে নব্য জেএমবির হয়ে কাজ করছে এই যুবকটি। বোমা তৈরিতে এক্সপার্ট এই সাব্বির। ফোরকান নামে আরেক যুবককে নিয়ে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ করছে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টার্গেট করে হামলার পরিকল্পনা করে আবারও প্রস্তুতি নিচ্ছে এই জঙ্গি সংগঠনের জঙ্গিরা। এই জঙ্গি সংগঠনের জঙ্গিরাই গত মে মাসে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা বা আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) রেখে এসেছিল। পরে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট গিয়ে সেই বোমা নিষ্ক্রিয় করে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তদন্তে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, হাজার দুয়েক টাকা খরচ করে কীভাবে সহজেই একটি বোমা তৈরি করা যায়, এরকম একটি ম্যানুয়াল তৈরি করেছে নব্য জেএমবির সদস্যরা। এই বোমা তৈরির উপকরণ খোলা বাজারে সহজলভ্য। (নিরাপত্তার স্বার্থে বোমা তৈরির উপকরণের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা নিষেধ) এসব উপকরণ সংগ্রহের পর ঘরে বসেই বোমা তৈরি করা যায়। যা অনেক বেশি শক্তিশালী না হলেও বিস্ফোরিত বোমার কেন্দ্র থেকে অন্তত ২০-২৫ বর্গমিটার এলাকায় থাকা মানুষ হতাহত হতে পারেন। প্রতিটি বোমাই দূরনিয়ন্ত্রিত ডিভাইসের মাধ্যমে বিস্ফোরণের কৌশল শেখানো হচ্ছে। এই লক্ষ্য নিয়ে নব্য জেএমবি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তারা এখন বোমা তৈরির দিকে মনোনিবেশ করেছে। সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যকে বোমা তৈরিতে দক্ষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। জঙ্গি সংগঠনটির পলাতক জঙ্গিদের নাম পরিচয়সহ এতদ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পলাতক জঙ্গিদেরও কয়েকজন গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন এবং তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি।
কে এই ফোরকান : গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন ফোরকান। বর্তমানে নব্য জেএমবির বোমা তৈরির প্রধান কারিগর হিসেবে কাজ করছেন। সাব্বির হোসেন ওরফে জন ডেভিড নামে আরেক তরুণ তার অন্যতম প্রধান সহযোগী। সাব্বির নব্য জেএমবির ময়মনসিংহ অঞ্চলের দায়িত্বশীল সামরিক কমান্ডার। সে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল এলাকার অনেক তরুণকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে হাতে-কলমে ও অনলাইনে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছে। জঙ্গি বিরোধী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে গ্রেফতার ও হতাহতের প্রক্রিয়ায় বোমা তৈরিতে দক্ষ লোকের সঙ্কটে পড়ে নব্য জেএমবি। পরে ফোরকান ও সাব্বিরের মাধ্যমে ফের বোমা তৈরিতে মনোনিবেশ করে এই জঙ্গি সংগঠনটি। এই গ্রুপের সদস্যরাই গত বছরের নবেম্বরে কুমিল্লার দেবীদ্বারের একটি বাজারে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের দোকানের সামনে বিস্ফোরণ ঘটায়। সর্বশেষ, গত ১৯ মে সিদ্ধিরগঞ্জে পুলিশ বক্সের সামনে বোমা রেখে আসে। এছাড়া ঢাকার একটি মন্দির এলাকায়ও একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য বোমা পুঁতে রাখে ফোরকানের নেতৃত্বে এই জঙ্গি দলটি।
যেভাবে বোমা তৈরির কারিগরদের সন্ধান : তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়লে দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো গা-ঢাকা দেয়। তার ঠিক তিন বছর পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন পুলিশ বক্সে হামলা ও হামলাচেষ্টায় ‘ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ ব্যবহার করে নতুনভাবে আলোচনায় আসে জঙ্গিরা। এসব হামলার সঙ্গে জড়িত নব্য জেএমবির সদস্যদের কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। কিন্তু তারপরও বোমা তৈরি বন্ধ করা যায়নি। সর্বশেষ গত ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় শক্তিশালী একটি বোমা উদ্ধার হয়। সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে বোমা উদ্ধার করার এ ঘটনায় অভিযুক্ত জেএমবির সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ডেভিড কিলারকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি। গত ১১ জুলাই সাইনবোর্ডে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বোমা রাখার অভিযোগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া কেরানীগঞ্জ থেকে জেএমবির আরেক সদস্য- কাউসার হোসেন ওরফে মেজর ওসামাকে গ্রেফতার করা হয় ১১ জুলাই রাতে। গ্রেফতার হওয়া এই দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদে বোমা তৈরির এক কারিগর হিসেবে জাহিদ হাসানের নাম পাওয়া যায়। গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতার এক জঙ্গির থেকেও এই জাহিদ হাসানের বিষয়ে প্রথম তথ্য পেয়েছিল বলে সিটিটিসির দাবি।
যেভাবে শনাক্ত হলেন জঙ্গি জাহিদ : তদন্তে প্রকাশ পায়, জাহিদ হাসান ২০১৬ সালে জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতক পাস করেছিলেন। ওই বছরই অনলাইন দাওয়াতের মাধ্যমে জেএমবিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য ২০১৪ সালে সীমিত পরিসরে জঙ্গিবাদের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পেয়েছে সিটিটিসি। বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি হিসেবে জাহিদ হাসান পলাতক রয়েছেন। ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি নব্য জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি- ‘শরিফুল ইসলাম’কে চাঁপাইনবাবগঞ্জে গ্রেফতার করেছিল র্যাব। হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এই শরিফুল ইসলাম। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায় যে, জেএমবির বোমা তৈরির মূলে আছেন কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র। আর তিনিই নব্য জেএমবির সদস্যদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিলেন। তবে শরিফুলের কাছ থেকে জাহিদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় নি। সিটিটিসির একটি সূত্র জানায়, পুলিশ বক্সে বোমা হামলাগুলোর ঘটনার তদন্তে বোঝা যায় যে বোমাগুলো একই ধরনের এবং সেগুলো দেশীয়ভাবে তৈরি।
অনলাইনে বোমা বানানো শেখান জাহিদ : সাধারণত একসাথে চার-পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাট বাসায় বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে গেলে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন জাহিদ। প্রশিক্ষণ নেয়ার পরও বোমা বানানোর কাজ রপ্ত করতে না পারলে, সরাসরি ভিডিও কলের মাধ্যমে সব কিছু আবারও বুঝিয়ে দিতেন তিনি। সর্বশেষ সাইনবোর্ড ট্রাফিক পুলিশ বক্স হামলায় গ্রেফতার হওয়া নব্য জেএমবির সদস্য মামুন সিটিটিসিকে জানান যে, তিন দিন বোমা বানানোর পরেও তা কাজ না করলে আরেক জঙ্গি মাহাদি হাসানের দেয়া আইডিতে ভিডিও কল দেন মামুন। ভিডিও কলে জাহিদের পরামর্শ অনুযায়ী বোমা বানালে, সেই বোমা কাজ করে। গত কয়েক বছরে ১০-১২টি পুলিশ বক্সে বোমা হামলার চেষ্টা করে নব্য জেএমবির জঙ্গিরা। এসব ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গিরা সবাই বোমা বানাতে পারেন। এত জঙ্গি কিভাবে বোমা বানাতে পারে; তার উত্তরে চলে আসে জাহিদ হাসানের নাম।
অনলাইন সেল (ইদাদ) : তদন্ত সংস্থা সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিদের বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে অনলাইন সেল (ইদাদ) খুলেন জাহিদ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করার জন্যই এই সেল খোলা হয়। এমন তিনটি ইদাদে ২০ জন করে সদস্য জাহিদ হাসানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। তবে তাদের বিষয়ে এখনও কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।