কুলাউড়ায় একটি সেতুর কারণে পাল্টে গেছে ৩ ইউনিয়নের মানুষের জীবন চিত্র

20

কুলাউড়া থেকে সংবাদদাতা :
ভারত সীমান্ত ঘেঁষা ৩ ইউনিয়ন শরীফপুর, পৃথিমপাশা ও হাজিপুর। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার এই ৩ ইউনিয়নে লক্ষ মানুষের বসবাস।
উপজেলা সদরে আসতে যেখানে তাদের সময় লাগার কথা আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা অথচ তাদের এখন আসতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। কারণটা খুব স্বাভাবিক।
ইউনিয়ন থেকে সরাসরি কুলাউড়া আসা সম্ভব না। শরীফপুরের মানুষ কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর বাজার ছুঁয়ে ঘুরে প্রায় ২০ কিলোমিটার অতিরিক্ত সড়ক পাড়ি দিতে হয়।
হাজিপুর ইউনিয়নের মানুষকেও পোহাতে হতো নানা ভোগান্তি। বিরম্বনায় পড়তে হতো পৃথিমপাশা ইউনিয়নের মনু নদী ঘেঁষা মানুষদেরর।
নানারকম প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হতো এখানকার মানুষদের। যাতায়াত ভাড়া অতিরিক্ত দেয়ার পাশাপাশি সময়ের অপচয় সে তো নিত্যনৈমেত্তিক বিষয়ে পরিনত হয়েছে। সড়কের অতিরিক্ত দূরত্ব থাকায় শরীফপুর এলাকার মানুষ বাধ্য হয়ে শমসেরনগর বাজারে গিয়ে তাদের কাজ সারতেন। তবে দাপ্তরিক কাজ, চিকিৎসা, শিক্ষা কাজে কুলাউড়া শহরে আসতে হতো প্রায় প্রতিদিন।
এই ভোগান্তির অবসান চেয়ে গত প্রায় দুই যুগ ধরে কুলাউড়ার দক্ষিণাঞ্চলের এই ৩ ইউনিয়নের মানুষজন আন্দোলন করে আসছিলেন। তাদের দাবি ছিলো, উপজেলা সদরে কম সময়ে যাতায়াতের জন্য মনু নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করার। অবশেষে তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে।
বিগত ২০১৮ সালে বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ সময় মনু নদীর উপর একটি সেতু ও এর সংযোগ সড়ক নির্মাণে ৯৯ কোটি ১৭ লক্ষ টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। মৌলভীবাজার-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য আব্দুল মতিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এর সভায় অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রায় ১০০ কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি কুলাউড়া শহরের সাথে সেতু-বন্ধনের শিক্ষা, কৃৃষি, পর্যটনশিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। জীবনমান উন্নয়নে এ প্রকল্পটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে ধারণা স্থানীয় জনগন, জনপ্রতিনিধির।
প্রকল্পে কুলাউড়া-পৃথিমপাশা-হাজীপুর-শরীফপুর সড়কের ১৪তম কিলোমিটারে পিসি গার্ডার সেতু (রাজাপুর সেতু) ও সাড়ে ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। বর্তমান সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এই সেতুর কার্যক্রম শুরু করা হয়। ইতোমধ্যে সেতুর ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
তবে করোনার প্রভাবে সংযোগ সড়কের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ পিছিয়ে গেছে। যদিও গত ৭ জুন মৌলভীবাজার ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা তানভীর হোসেন সংযোগ সড়কের ভূমি অধিগ্রহণের অগ্রগতি জানতে কুলাউড়া উপজেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছেন।
রাজাপুর সেতুটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৮ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স মাতৃভূমি নির্মাতা’ কাজটি সম্পাদন করছে। এছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়া শরীফপুর ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী হাজিপুর ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের যোগাযোগের প্রধান সড়ক প্রশস্তকরণে গৃহীত প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলেছে। কুলাউড়া স্কুল চৌমুহনী থেকে পৃথিমপাশার ঝিলেরপাড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ কাজ প্রায় শেষ। শিগগির সেতুর পশ্চিম পাশের হাজীপুর ও শরীফপুর এলাকায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার এবং পৃথিমপাশা এলাকায় ২ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হচ্ছে শিঘঘিরই। রাস্তা নির্মাণের জন্য ২০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হবে। এতে ব্যয় হবে ২০ কোটি টাকা আর নতুন রাস্তা নির্মাণের জন্য ৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন শরীফপুরের ইউপি চেয়ারম্যান জনাব আলী বলেন, রাজাপুর সেতুটি নির্মানের জন্য স্থানীয়রা অনেক আন্দোলন করেছেন। সেতু নির্মাণের ফলে এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের কষ্ট লাগব হতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সেতু নির্মানের কার্যক্রমের উপর আমরা খুশি। সংযোগ সড়কের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হলেই আমাদের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিবে।
হাজিপুর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল বাছিত বাচ্চু বলেন, সেতুটি নির্মানের ফলে শরীফপুর, পৃথিমপাশার সাথে হাজিপুর ইউনিয়নের মেলবন্ধন আরও দৃঢ় হবে। এখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের ইচ্ছার প্রতিফলন এই সেতু। আমরা বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এরকম একটি উন্নয়নমূলক কাজ আমাদের অঞ্চলে করে দেয়ায়।
পৃথিমপাশা ইউপি চেয়ারম্যান আলী বাকর খান বলেন, সেতৃটি নির্মাণের ফলে শরীফপুরের মানুষ সরাসরি পৃথিমপাশা হয়ে কুলাউড়ায় যেতে পারবে। এতে এখানকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। একানকার মানুষের জীবনমানেরও উন্নয়ন হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রাজাপুর সেতুটি নির্মাণ হচ্ছে। সেতুর সংযোগ সড়কের জন্য সাড়ে ৭ কিলোমিটার ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান। বর্তমানে ফিল্ডে ভিজিট করা হচ্ছে। মানুষের কোন হয়রানী ছাড়া জেলা প্রশাসকের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হবে।
কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম শফি আহমদ সলমান বলেন, উপজেলার শরীফপুর, হাজিপুর, পৃথিমপাশা, টিলাগাঁও ইউনিয়নবাসী মনু নদীকে অভিশাপ মনে করতো। কারণ, বর্ষা মৌসুমে নদীর পার ভেঙে দিতো, বন্যায় ভাসিয়ে দিতো এই নদী। বছরের পুরোটা সময় এই নদীর কারণে এই অঞ্চলের মানুষ অনেক ঘুরে কুলাউড়ায় আসতো। তবে বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে ঠিক তখনই এই অঞ্চলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লগেছে। সরকারের সুদৃষ্টিতে এখানকার লাখো মানুষের দীর্ঘদিনের কষ্ট লাগব হতে যাচ্ছে। মানুষ এখন দ্রুত কম সময়ে কুলাউড়ায় আসা যাওয়া করতে পারবে। এতে এখানকার মানুষের জীবন মান উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নও সাধিত হবে। বর্তমানে এই সেতুটি কুলাউড়া উপজেলার জন্য আশির্বাদ বলে আমি মনে করি।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সড়ক উপ-বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ সরকার বলেন, রাজাপুর সেতুটি সরকারের উন্নয়নের একটি অংশ। সেতুটি নির্মাণের ফলে যে শুধু কুলাউড়া উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে তা নয় পুরো মৌলভীবাজার জেলার উন্নয়নে কিন্তু সেতুটি ভূমিকা রাখবে। এখানে একটি পর্যটন স্পট হতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখানকার মানুষ ব্যবসা বানিজ্যে বৃহৎ চিন্তা মাথায় নিতে পারে। ইতিমধ্যে সেতুটির নব্বই শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু ভূমি অধিগ্রহণের জন্য অপেক্ষা করছি। এটা হয়ে গেলে সেতুটির সাথে সংযোগ সড়কের কাজটিও দ্রুত শুরু হবে।
কুলাউড়া উপজেলার নির্মানাধীন এই দৃষ্টিনন্দন সেতুটি দেখতে ও পরিবেশ উপভোগ করতে প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক দর্শনার্থী উপস্থিত হন। কেউ ছবি তুলছেন আবার কেউ একান্তে নদীর পাড়ে বসে সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করতে দেখা যায়।
স্থানীয়রা মনে করছেন, পুরো প্রকল্প শেষ হলে এই সেতুকে কেন্দ্র করে এখানে পর্যটন স্পট গড়ে তোলা সম্ভব।