কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে নতুন অর্থবছরের পথচলা শুরু হয়েছে। এ মুহূর্তে প্রধান লক্ষ্য দেশের সকল নাগরিককে করোনার ভ্যাকসিন দিয়ে আগে জীবন বাঁচানো। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার করে জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। করোনার কারণে অতি স্বল্প আয়ের আড়াই কোটি মানুষ ফের দরিদ্র হয়ে পড়েছেন। এ কারণে দারিদ্র্য বিমোচনেও বাজেটে জোর দেয়া হয়েছে। টাকার অঙ্কে চলতি অর্থবছরের জন্য রেকর্ড ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের বাজেট হচ্ছে করোনা থেকে দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার বাজেট। এ কারণে বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়নে অর্থবছরের শুরু থেকে জোরেশোরে কার্যক্রম গ্রহণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাদের মতে, করোনার সবচেয়ে পিক টাইমে রয়েছে বাংলাদেশ। করোনা থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে এখন দেশের সবাইকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এ জন্য দ্রুত ভ্যাকসিন আমদানি, উৎপাদন এবং স্বাস্থ্যখাতের অনুকূলে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার সঠিক বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
গত বছরের মতো এবারও করোনা মোকাবেলায় জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে বাজেট দেয়া হয়েছে। এবারের বাজেট হয়েছে পুরোপুরি ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব। এ জন্য বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে সর্বক্ষেত্রে কর ও ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ অর্থবিল পাসের দিন অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে আনার সুযোগ দেয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, করোনা থেকে বাঁচাতে দেশের সবাই বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পাবেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, মসলাসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। এছাড়া কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এতে করে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়লে দাম আর বাড়বে না। এছাড়া এবারের বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করেন তিনি। অন্যদিকে পদ্মা সেতুসহ বড় বড় প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময় শেষ করার জন্য বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাজেটের শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’।
করোনার কারণে করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন হবে ২০২১-২২ অর্থবছরে। ইতোমধ্যে মহান সংসদে প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া করোনা সঙ্কট উত্তরণ ও বাজেট বাস্তবায়নে গতবারের মতো এবার চারটি কৌশল বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কর্মপন্থার চারটি প্রধান কৌশলগত দিক রয়েছে। প্রথম কৌশলটি হলো সরকারী ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দেয়া, বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করা, গত এক দশকের সুশৃঙ্খল মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি বাস্তবায়নের ফলে আমাদের ঋণের স্থিতি জিডিপির অনুপাত অত্যন্ত কম হওয়ায় প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে সরকারী ব্যয় বড় আকারে বাড়লেও তা সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। এছাড়া দ্বিতীয় কৌশলটি হলো- ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করা যাতে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হয় এবং দেশে-বিদেশে উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় কৌশলটি হলো-হতদরিদ্র, কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষা দেয়া এবং চতুর্থ কৌশলটি হলো- বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো। তবে এ কৌশলটি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করা হচ্ছে যাতে মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
করোনা থেকে জীবন বাঁচানোর বাজেট ॥ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের এবারের বাজেট মূলত মাহমারী করোনাকে ঘিরেই। সবকিছুতেই বাজেটে অগ্রাধিকার পেয়েছে করোনা। বাজেটে করোনার ক্ষতি থেকে যেমন অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ আছে, তেমনি করোনায় বিপর্যন্ত মানুষের জীবন বাঁচানোরও উদ্যোগ রয়েছে। রয়েছে করোনা থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য টিকার বিষয়টিও। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ অনেক বেড়েছে। এ খাতে আগামী বছরের জন্য অর্থমন্ত্রী বরাদ্দ রেখেছেন তারমধ্যে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। এই অঙ্ক মোট বাজেটের প্রায় ১৮ শতাংশ। নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন ভাতাভোগীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এতে সবমিলিয়ে আরও প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ গরিব মানুষ সরকারের সহায়তা পাবে। এতদিন এই ভাতা পাচ্ছিলেন ৮৮ লাখ গরিব, অসহায় মানুষ। নতুন করে সুবিধাভোগীর সংখ্যা যোগ হলে ভাতা পাওয়া গরিবের সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। একইভাবে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির সঙ্গে করোনা ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য নতুন বাজেটেও থোক বরাদ্দ হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃায় আরও বলেন, আমাদের এবারের বাজেটও দেশ ও জাতির উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাধিকার পাচ্ছে দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ- প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবন জীবিকা।’
উল্লেখ্য, ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয় নির্বাহের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ১১.৩ শতাংশ। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উৎস থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব আসবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া কর-বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরিত হবে আরও ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে একপ্রকার স্থবিরতার কারণে রাজস্ব আদায় পিছিয়ে পড়েছে। ফলে নতুন অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী আর খুব বেশি উচ্চাভিলাসী হননি। মোট রাজস্ব আদায়ের প্রাক্কলন চলতি অর্থবছরের কাছাকাছি রাখা হয়েছে। বরং দেশের রাজস্ব আদায়ের যে বড় উৎস জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার সমান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে বেশি জোর না দিয়ে অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে বিদেশী অর্থায়নের দিকে বেশি জোর দিয়েছেন। ফলে অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সংস্কারমূূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর এবং নতুন কাস্টমস আইন ২০২০ সংসদে পাস হলে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। এছাড়া আয়কর আদায় বাড়াতে ধনীদের ওপর নজর দিয়েছেন। করোনাকালে সাধারণ জনগণের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে সমাজে যারা বিত্তবান, তাদের কাছ থেকেই বেশি কর আহরণের জোর দিয়েছেন।
এ জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সম্পদশালীদের ওপর সারচার্জ বাড়ানো হয়েছে। সেইসঙ্গে সারচার্জ আদায় প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ কর প্রদানে সক্ষম হলেও কর প্রদানকারীর সংখ্যা বর্তমানে মাত্র ২৫ লাখ ৪৩ হাজার। ফলে রাজস্ব জিডিপির অনুপাতে অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। তাই আগামী অর্থবছরে এই কর ফাঁকি রোধ করে কর জাল আরও বিস্তৃত করা হবে, যাতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়।
বিগত একদশকে বাংলাদেশের ক্রমাগত উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। উত্তরণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। এ সময় মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে বলে অর্থমন্ত্রী আশা করছেন।
করোনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট বাস্তবায়নে জোর অর্থ বিশেষজ্ঞদের ॥ মহামারী করোনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চলতি বাজেট বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন অর্থ বিশেষজ্ঞরা। এর পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকেও বাজেট বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ তাগিদ দেয়া হয়েছে। চলতি বাজেট নিয়ে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য, কৃষি ও কর্মসংস্থানে বেশি বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়ার কথা চলতি বাজেটে তা দেয়া হয়নি। বিশেষ করে করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত ছিল বলে মনে করে সংস্থাটি। সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনাকালে সামাজিক নিরাপত্তায় কাক্সিক্ষত বরাদ্দ বাড়েনি। একইসঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতেও বরাদ্দ বাড়েনি।
করোনাকালে নতুন করে যারা কর্মহীন হয়েছেন বাজেটে তাদের বিষয়ে জরুরী কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নের জোর দিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিমউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, চলতি বাজেটে বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন জরুরী। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারিমানের শিল্পখাতে এখনও প্রণোদনা অর্থ বন্টন করা যায়নি।
এতে করে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে। দ্রুত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছরের বাজেট হচ্ছে করোনা থেকে জীবন বাঁচানোর বাজেট। করোনা পরিস্থতি যেন খারাপের দিকে না যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে এই বাজেটে। তিনি বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যখাত আগে থেকেই দুর্বল। করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতের ওপর বেশ চাপ পড়েছে। আর কেবল করোনা নয়, করোনার বাইরেও যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা আছে সেগুলো মোকাবেলা করতে এই খাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা থেকে বাঁচতে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন । সেটাকে জাতীয়ভাবে পুনর্গঠন করতে হবে। সরকারী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে সেবার মান আরও বাড়াতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কেবল অর্থ দিলেই হবে না অর্থের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।