কাজিরবাজার ডেস্ক :L
করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় সোমবার থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ সময় জরুরী পরিষেবা ছাড়া সকল সরকারী, বেসরকারী অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরী পণ্যবাহী ব্যতীত সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। এ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত যানবাহন শুধু চলাচল করতে পারবে। জরুরী কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে কেউ বের হতে পারবেন না। গণমাধ্যম এর আওতার বাইরে থাকবে। মাঠে থাকবে সেনাবাহিনী। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আদেশ আজ শনিবার মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা হবে। করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের কমিটির সুপারিশের পর শুক্রবার দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০৮ জনের মৃত্যুর ঘটনায় এই লকডাউনের দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠেছিল। গত বৃহস্পতিবার কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া এবং লোকজনের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধে সারাদেশকে ১৪ দিনের লকডাউনের পরামর্শ দেয়। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের তিনটি ধরনের প্রভাবে চরম আকার ধারণ করতে যাচ্ছে পরিস্থিতি। ধরন তিনটি হলো : আলফা, বিটা ও ডেল্টা। বর্তমানে ডেল্টার প্রকোপ বেশি হওয়ায় সংক্রমণের হারও বেড়েছে। শুক্রবার সারাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। দিনটিতে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৮৬৯। নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লকডাউনের বিকল্প ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এবারের লকডাউনে জরুরী সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস আদালত, সবকিছু বন্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লার পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সারাদেশে বিধিনিষেধ চলছে, যা ১৫ জুলাই পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে। এছাড়া করোনার বিস্তাররোধে ঢাকার আশপাশের সাতটি জেলায় কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে রাজধানী ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে। এতে বলা হয়েছে, ভারতের মতো দেশে টানা লকডাউনের মতো কর্মসূচী করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কাজে এসেছে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে লকডাউন পালন করা জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে টানা ১৪ দিন লকডাউন কর্মসূচী দিতে হবে। সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধে লকডাউনের বিকল্প নেই। কমিটি মনে করছে, দেশের ৫০টির মতো জেলা সংক্রমণের অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এই হারে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে আগামীতে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ পড়বে।
কেমন হবে এবারের লকডাউন : বৃহস্পতিবার কমিটি লকডাউনের সুপারিশ করার পর থেকেই আলোচনায় এসেছে লকডাউন শব্দটি। শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, আমলা ও ব্যাংকার, শ্রমজীবীসহ সব শ্রেণীর মানুষের কাছেই লকডাউনের কথাটি নিয়ে চর্চা হচ্ছে। এটা এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। লকডাউন শব্দটি এবং এর প্রয়োগ সম্পর্কে ধারণা থাকলেও লকডাউন সম্পর্কে কারও ধারণা না থাকায় এত আলোচনা। লকডাউন শব্দের অর্থ বন্ধ। করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দুই সপ্তাহের লকডাউন শুরু হলে দেশের সবকিছু বন্ধ থাকবে নাকি অন্য কোন উপায়ে নিয়ন্ত্রীত হবে, সবার মনে এখন সেই প্রশ্ন।
১৪ দিনের প্রস্তাবিত লকডাউন নিয়ে পরামর্শক কমিটির এক সদস্য বলেন, লকডাউন শব্দটি এখন হেলাফেলার হয়ে গেছে। লকডাউনের মধ্যেও গণপরিবহন চলছে, মার্কেট শপিংমলসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। এ কারণে তারা ‘কার্ফু’ শব্দটি প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কার্ফু হোক আর লকডাউন হোক, সারাদেশে আগামী ১৪ দিনের জন্য যানবাহন ও মানুষের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে পরিস্থিতির ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। এমনকি চিকিৎসাসেবা বন্ধের উপক্রমও হতে পারে হাসপাতালে।
এই বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, আগে আমাদের সংক্রমণ ৭ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখনও অনেক জায়গা আছে যেখানে সংক্রমণ ১০ শতাংশের নিচে। আমরা চাইছি ইতোমধ্যে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছি। তারপরও ঢাকার মধ্যে লোকজন এসে যাচ্ছে। এই যোগাযোগগুলো। ইতোমধ্যে বাস, ট্রেন, যাত্রীবাহী নৌযান বন্ধ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করেই কিন্তু আমরা এ সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, সংক্রমণ কমাতে পদক্ষেপ নিতে আমাদের বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করছে। সেই অনুযায়ী যে সিদ্ধান্ত নেয়া উপযুক্ত এবং সঠিক হবে, সেটা আমরা নেব।
করোনা প্রতিরোধে ৫ এপ্রিল থেকে সরকারের লকডাউন কর্মসূচী চলছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস-আদালত ও তৈরি পোশাক শিল্প চালু রয়েছে। তবে লকডাউন ঘোষিত হলে একেবারেই লকডাউন দিতে হবে বলে মনে করেন পরামর্শক কমিটির সভাপতি প্রফেসর মোহাম্মদ শহিদুল্লা। তিনি মনে করেন, লকডাউন মানে একেবারেই লকডাউন। জরুরী সেবা ছাড়া দোকানপাট, যানবাহন, হাটবাজার, অফিস, আদালত কোন কিছুই চলবে না। তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পুরোটা লকডাউন দেয়ার মাধ্যমে করোনা নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেয়েছে। তাই আমাদের দেশেও অন্তত ১২ দিনের কঠোর শটডাউন দিতে হবে।
মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত মেনে, গত মঙ্গলবার থেকে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। রেল, নৌ ও দূরপাল্লার বাস যোগাযোগ সবই বন্ধ রয়েছে। রাজধানী ঢাকার প্রবেশপথে সাত জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ও যান চলাচল বন্ধ করার অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারপরও রাজধানী থেকে লোকজনের বের হওয়া এবং প্রবেশ আটকানো যাচ্ছে না। ভেঙ্গে ভেঙ্গে কেটে কেটে লোকজন রাজধানী ছাড়ছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ কাজে রাজধানীতে আসছেন এমন লোকজনের সংখ্যাও কম নয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গণপরিবহন না থাকলেও মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসে করে দূরপাল্লার গন্তব্যে যাচ্ছেন যাত্রীরা। মানুষকে ঢাকার ভেতরে আসা ও বাইরে যাওয়া ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে। আগামীতে কঠোর কর্মসূচী আসতে যাচ্ছে এমন আশঙ্কায় শ্রমজীবী মানুষদের অনেকেই ঢাকা ছাড়ছেন। সেক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী জেলার অনেকেই হেঁটেই ঢাকা ছাড়ছেন।
আশপাশের জেলা থেকে রাজধানীতে মানুষের প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। একইভাবে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকে। খোলা আছে বিভিন্ন পরিবহনের টিকেট কাউন্টার। মাইক্রোবাসের টিকিট বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। যাত্রীদেরও ডাকতে দেখা গেছে। অনেকেই মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিক্সাসহ বিভিন্ন ছোট ছোট পরিবহনে যাতায়াত করছেন। সবার দাবি, জরুরী প্রয়োজনেই যাতায়াত করতে হচ্ছে তাদের।