ড. এ কে এম খোরশেদ আলম :
বাংলাদেশের অবস্থান ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মিজ তিনটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে হওয়ায় দেশের উত্তর ও পূর্ব দিকে প্রতিনিয়ত ভূকম্পন অনুভূত হয়, যা বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য কখনো কখনো ঝুঁকি তৈরি করে। আমাদের অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা ও জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকিতে আছে। গত প্রায় আড়াই শ বছরে বাংলাদেশ ও আশপাশে ৭.০ বা তার বেশি মাত্রার ৯টি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে কাছের এবং বড়টি ছিল ১২ জুন ১৮৯৭ তারিখের ৮.১ মাত্রার। এ ছাড়া গত ২৫ বছরে দেশে ৪.২-৬.১ মাত্রার অনেক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। কিন্তু ২৯ মে ২০২১ তারিখের সিলেট অঞ্চলে ৪.১-২.৮ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো সবার নজর কেড়েছে, উদ্বেগের কারণ হয়েছে এবং প্রমাণও করেছে যে ছোট ভূমিকম্পগুলোও ক্ষতি করতে সক্ষম। কোনো এলাকায় ভূ-অভ্যন্তরে টেকটোনিক কারণে ক্রমান্বয়ে শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে, একটা সময় পরে ক্রমেই সঞ্চিত এই শক্তি কোনো দুর্বল অংশ দিয়ে, ভূতত্ত্বের ভাষায় যাকে ফল্ট বা চ্যুতি বলে, বিমুক্ত হয়ে ভূমিকম্প আকারে প্রকাশিত হয়। সময়ের সঙ্গে এ অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে অর্থাৎ ওই এলাকায় আবার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, যা শত শত বছর বা হাজার বছর পরও হতে পারে। দেশের ভূতত্ত্ববিদরা বড় মাত্রার ভূমিকম্প উৎপাদনে সক্ষম এমন কয়েকটি ফল্ট চিহ্নিত করেছেন উত্তর দিকে ডাউকি ও পূর্ব দিকে প্লেট বাউন্ডারির ফল্টগুলো। ডাউকি ফল্টে গত প্রায় এক হাজার বছরে তিনটি বড় ভূমিকম্প উৎপন্ন হয়েছিল বলে আমাদের ভূতত্ত্ববিদরা নিরূপণ করেছেন, যার শেষেরটি ঘটেছিল ১৮৯৭ সালে। ১৭৬২ সালে প্লেট বাউন্ডারিতে দেশের পূর্ব-দক্ষিণের উপকূল এলাকায় একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প ঘটেছিল, এতে ভূমিরূপে বেশ পরিবর্তন এসেছিল। যাই হোক, ওই সময়ে আমাদের দেশে জনসংখ্যা কম ও অবকাঠামোর স্বল্পতা থাকায় প্রাণহানি ও ক্ষতি কম হয়েছে। ভূমিকম্প সম্পর্কে একটি বহুল প্রচলিত কথা হলো, ভূমিকম্প নিজে কাউকে মারে না; কিন্তু কম্পনের ফলে অবকাঠামো, জান-মালের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই এখন যেমন জনসংখ্যা বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে অবকাঠামোগত প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এ জন্য ভূমিকম্প আমাদের কাছে উদ্বেগের কারণ হয়েছে।
তাহলে স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন আসে, ভূমিকম্পঝুঁকি থেকে রক্ষায় কোনো আগাম সংকেত বা পূর্বাভাস দেওয়া যায় কি না? অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের বেলায় তা সম্ভব হলেও ভূমিকম্প সংঘটনে লিপ্ত জটিল ভূগাঠনিক-ভূতাত্ত্বিক-ভূপদার্থিক প্রক্রিয়ার দুর্বোধ্যতার কারণে আগাম সতর্কবাণী প্রদানের কার্যকর কোনো পন্থা এখনো বের হয়নি। তবে অতি সাম্প্রতিক সময়ে এক খবরে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলের বাসিন্দাদের জন্য সেলফোনের মাধ্যমে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কীকরণের সক্ষমতা অর্জনের ব্যাপারে জানা গেছে এ পদ্ধতিতে দূরবর্তী উৎপত্তিস্থলের উঁচুমাত্রার ভূমিকম্পের জন্য নাগরিকরা সর্বোচ্চ ৮০ সেকেন্ড সময় পাবে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর হতে পারে তা বিবেচনার দাবি রাখে, তবে এ সময়ের মধ্যে জরুরি গ্যাস বা বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধের; ট্রেনের গতি কমানোর ও লিফট বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
তবে সার্বিক পরিকল্পনার মাধ্যমে জনসচেতনতা ও প্রস্তুতি হলো ভূমিকম্পঝুঁকি হ্রাসে সফল ব্যবস্থা। ভূমিকম্পের আমাদের সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতাগুলো বলে যে আতঙ্কিত হয়ে শিক্ষা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান অথবা আবাসিক বা ব্যাবসায়িক ভবন থেকে হুড়াহুড়ি করে বের হতে বা নামতে গিয়ে অনেকে হতাহত হয়েছে, কাউকে হাসপাতালেও যেতে হয়েছে। কিন্তু সচেতনতার সঙ্গে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করলে হতাহতের সংখ্যা কমানো যায়। ভূমিকম্পপূর্ব স্বাভাবিক সময়ে ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণকালে নির্মাণ বিধিমালার কঠোর অনুসরণ ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে প্রধানতম করণীয়, যা টেকসই ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে এ দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা মূলত হলোসিন উপযুগের নরম ও অসংহত পলি দিয়ে গঠিত, ৮ শতাংশ প্লেইসটোসিন উপযুগের কাদাসমৃদ্ধ মৃত্তিকা ও অবশিষ্ট ১২ শতাংশ টারসিয়ারি যুগের পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। ভিন্ন ভৌত গুণাগুণসম্পন্ন হওয়ায় ভূকম্পন এসব পলি-মাটি-শিলাতে ভিন্ন ধাঁচে প্রভাব ফেলবে, আবার ভিন্ন মাত্রার কম্পনে দৃশ্যপট পাল্টাবে। ভূকম্পনে পানিসিঞ্চিত ও বালুসমৃদ্ধ নরম ও অসংহত পলিমাটি শক্তি হারিয়ে তরল পদার্থের মতো আচরণ করে। এ অবস্থায় মাটির ওপর নির্মিত ভবন বা অবকাঠামোকে ধরে রাখার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় মাটিতে দেবে যায়, যা ঝুঁকির কারণ। এ ক্ষেত্রে ভূকম্পনের বৈশিষ্ট্য, ভূমিকম্পের উৎস চিহ্নিত ও সম্ভাব্য মাত্রা, ভূমিতে এদের সম্ভাব্য প্রভাব, এমন অবস্থায় ভবন নির্মাণে কৌশল নিরূপণ ইত্যাদিকে অন্তর্ভুক্ত করে ভূকম্পবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, ভূপদার্থবিদ্যা, প্রকৌশল ভূতত্ত্ব, পুরঃপ্রকৌশল ইত্যাদি বিষয়ক সমন্বিত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ ছাড়া ছোট মাত্রার ভূমিকম্পগুলো অগ্রাভিঘাত (ইংরেজিতে ‘ফোর শক’), পশ্চাদ-অভিঘাত (ইংরেজিতে ‘আফটার শক’) ও ভূকম্পন ঝাঁক (ইংরেজিতে ‘আর্থকোয়েক সোয়ার্ম’) আকারে প্রকাশ ঘটায়। যেখানে প্রথম দুটি কোনো চ্যুতিতন্ত্রে বা সাধারণভাবে ফাটলে সৃষ্ট ভূমিকম্পের সঙ্গে সম্পর্কিত হয় আর শেষেরটি কোনো চিহ্নিতযোগ্য প্রধান কম্পনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সামগ্রিক বিচারে ছোট মাত্রার ভূমিকম্পগুলো উপেক্ষণীয় নয়, বরং ভূমিকম্প সংঘটন প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে এগুলোর রীতি, ধাঁচ ও তাৎপর্য পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আনুমানিক ৬০ কিলোমিটার উত্তরে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা অংশে কয়েক শ বছরে কোনো ভূমিকম্প সংঘটিত হয়নি বলে ভবিষ্যতে সম্ভাবনাময় বলে ভূবিজ্ঞানীদের অভিমত, কাজেই এ অঞ্চলের ভূমিকম্পগুলো পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন তাৎপর্যপূর্ণ।
পরিশেষে বলা যায়, ভূমিকম্পের পর্যায়ভিত্তিক অর্থাৎ ভূমিকম্প-পূর্বকালীন ও পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যাপক স্বীকৃত করণীয় রয়েছে; কিন্তু বর্তমান পরিসরে প্রতিটির বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। কাজেই আতঙ্কিত না হয়ে জরুরি পরিস্থিতির জন্য সার্বিক পরিকল্পনা করা দরকার গবেষণা, জনসচেতনতা ও প্রস্তুতি। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভূমিকা রাখতে পারেন। তদুপরি উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানেও স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যে ব্রডব্যান্ড সেইসমিক স্টেশনের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ও রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির প্রয়োগে উপাত্ত সংগ্রহ ও পরিবীক্ষণের এবং ভূকম্পবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, ভূপদার্থবিদ্যা, প্রকৌশল ভূতত্ত্ব, পুরঃপ্রকৌশল ইত্যাদি বিষয়ের সমন্বিত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এতে গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রস্তুতিই হতে পারে ভূমিকম্পঝুঁকি হ্রাসে টেকসই কৌশল।
লেখক : গবেষক, ভূতত্ত্ববিদ।