অমুসলিমকে বিয়ে করার বিধান

68

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥

পরিবার হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। পারিবারিক ব্যবস্থার সূত্রপাত হয় বিবাহের মাধ্যমে। বিয়ে ছাড়া কোনো কোনো সমাজ পরিবার গঠন করার অনুমতি দিলেও ইসলাম এ ব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। ইসলাম বিয়ে করার পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা বা নীতিমালা প্রদান করেছে। এই নীতিমালা না মানার কারণে পারিবারিক জীবনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও পরিবার গঠনের প্রথম পদক্ষেপ, বিয়ে-শাদীর ক্ষেত্রে ইসলামের নীতিমালা আজকাল অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হচ্ছে। যার বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।
মুসলিম পুরুষ অমুসলিম নারীদের কিংবা মুসলিম নারী অমুসলিম পুরুষদের বিয়ে করতে পারবে কিনা তা জানা দরকার। কারণ বিশ্বায়নের যুগে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন প্রয়োজনে তাকে মুসলিম কিংবা অমুসলিম দেশে অবস্থান করতে হয়। বাংলাদেশের অনেক মুসলিম পরিবারের সন্তান আছে যারা বিদেশে গিয়ে অন্য ধর্মের নারী কিংবা পুরুষকে বিয়ে করে। বাংলাদেশেও আন্তঃধর্মীয় বিয়ের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে আন্তঃধর্মীয় বিয়ের ক্ষেত্রে বৃটিশ কর্তৃক প্রবর্তিত বিশেষ আইন ১৮৭২ অনুসরণ করা হয়।
বিশেষ বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্ম ত্যাগ করা অত্যাবশ্যক। দুই পক্ষই ধর্ম ত্যাগ না করলে বিয়েটি বাতিল বলে গণ্য হবে। এ আইনের বিধানে যেকোনো ধরনের মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবেদনকারী যদি বাস্তবে ধর্ম ত্যাগ না করে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ধার্য হয়েছে- তিনি মিথ্যা বর্ণনা দিয়েছেন।
বাংলাদেশে মুসলিম কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলে অন্য ধর্মের কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম আইন অনুযায়ীই বিয়ে করতে পারেন। যদি অন্য পক্ষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তবে কোনো সমস্যাই নেই, অর্থাৎ বিয়েটি ‘বৈধ বিয়ে’। আর যদি অন্য পক্ষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ নাও করেন, তবু মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ে করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে বিয়েটি ‘অনিয়মিত’ হবে। যদিও অনেকে মনে করেন, এই আইনের মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে, যা পুরোপুরি পার্টির (বা পক্ষলোর) স্বার্থ রক্ষা করে না। অমুসলিমদের বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামের কতগুলো বিধিবিধান রয়েছে। অমুসলিমদেরকে ইসলামের দৃষ্টিতে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ১। যারা আসমানী কিতাবের অনুসারী ২। যারা আসমানী কিতাবের অনুসারী নয়। পবিত্র কুরআনে ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে মূলত আহ্লে কিতাব বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: তোমরা বল, ‘কিতাব তো শুধু আমাদের পূর্বে দুই সম্প্রদায়ের (ইহুদী ও খ্রিস্টান) প্রতিই অবতীর্ণ হয়েছিল; আমরা তাদের পঠন-পাঠন সম্বন্ধে তো গাফিল ছিলাম।
ইসলামে আহ্লে কিতাব নারীদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: সচ্চরিত্রা মুমিন নারী এবং তোমাদের পূর্বে যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের সচ্চরিত্রা নারী তোমাদের জন্য বৈধ করা হল।
কোন মুসলিম নারীর আহ্লে কিতাব পুরুষকে বিয়ে করা হারাম। মুসলিম পুরুষের জন্য আহলে কিতাব নারীকে কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে বিবাহ করা বৈধ হলেও বিভিন্ন কারণে তা অপছন্দনীয় বলে ফকীহগণ মত প্রকাশ করেছেন। আহ্লে কিতাব না হলে তাদেরকে মুশ্রিক কিংবা কাফির হিসাবে গণ্য করা হয়। আর এদের সঙ্গে মুসলিম নারী-পুরুষের বিবাহ সম্পূর্ণরূপে হারাম। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন: মুশরিক নারীরা ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা তাদেরকে বিবাহ করো না। মুশ্রিক নারী তোমাদের মুগ্ধ করলেও নিশ্চয়ই মুমিন ক্রীতদাস তার চেয়ে উত্তম। মুশ্রিক পুরুষরা ঈমান না আনা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে তোমরা (তোমাদের নারীদের) বিবাহ দিবে না। মুশ্রিক পুরুষ তোমাদের মুগ্ধ করলেও, নিশ্চয়ই মুমিন ক্রীতদাস তার চেয়ে উত্তম।
কোনো ইহুদী-খ্রিস্টান মহিলার সাথে বিবাহ শরীআতের দৃষ্টিতে বিবাহ বলে গণ্য হওয়ার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। এ দুটি শর্তের কোনো একটি না পাওয়া গেলে সেটি বিবাহ বলেই গণ্য হবে না; বরং যিনা ও ব্যভিচার বলে সাব্যস্ত হবে। তবে উভয় শর্ত পাওয়া গেলেই যে তাদেরকে বিবাহ করা বিনা দ্বিধায় নিঃশর্ত জায়েয ও বৈধ হয়ে যাবে- বিষয়টি এমনও নয়; বরং বিবাহের পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বেই আরও কয়েকটি শর্তের উপস্থিতির ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া আবশ্যক। যদি ওই শর্তগুলো না পাওয়া যায় তবে সে ক্ষেত্রেও বিবাহ জায়েয হবে না। এর পরের কথা হল, এই শর্তগুলোও যথাযথ বিদ্যমান থাকলে বিবাহ তো জায়েয হয়ে যাবে, কিন্তু এ কাজ যে অবশ্যই মাকরূহ হবে ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী শরী’আতে যেখানে মুসলিম নারীকে বিবাহ করার ক্ষেত্রেও নামাযী ও শরীআতের অনুসারী নারীকে পছন্দ ও অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে, সেখানে যে মহিলা ইসলামের কালিমাকেই মানে না (যদিও সে আহলে কিতাব হয়ে থাকুক এবং বিবাহ সহীহ হওয়ার নির্ধারিত শর্তসমূহও বিদ্যমান থাকুক) তাকে বিবাহ করা কি আদৌ পছন্দনীয় হতে পারে? নিম্নে আহলে কিতাব মহিলাদের বিবাহ করা সম্পর্কিত ইসলামের নির্দেশনাসমূহ তিনটি স্তরে কিছুটা বিশ্লেষণের সাথে তুলা ধরা হল।
প্রথমেই জানা দরকার যে, এ যুগের অধিকাংশ ইহুদী ও খ্রিস্টান আহলে কিতাব নামধারীরা আদমশুমারিতে ওই দুই ধর্মের লোক বলে সরকারিভাবে রেজিস্ট্রিকৃত হলেও মূলত তারা কোনো আসমানী কিতাব বা ধর্মে বিশ্বাসী নয়; বরং ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে জড়বাদী নাস্তিকই বটে। তাই কোনো নারীর শুধু সরকারি খাতায় ধর্মাবলম্বী বলে নিবন্ধিত হওয়া কিংবা ইহুদী বা খ্রিস্টান নামধারী হওয়াই তার সাথে মুসলমান পুরুষের বিবাহ সহীহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্তসমূহ পূর্বে যাচাই করে নিতে হবে।
মেয়েটি বস্তুবাদী নাস্তিক না হতে হবে; বরং প্রকৃত অর্থে ইহুদী বা খ্রিস্টান তথা আহলে কিতাব হতে হবে। এ জন্য তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপস্থিতি জরুরি। (ক) আল্লাহ তাআলার সত্তা ও অস্তিত্ব স্বীকার করা। (খ) ইহুদী হলে মূসা আ. ও তাওরাতের উপর আর খ্রিস্টান হলে ঈসা আ. ও ইঞ্জিলের উপর ঈমান থাকা।
মেয়েটি পূর্ব থেকেই ইহুদী বা খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী হতে হবে। মুরতাদ, অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে ইহুদী বা খ্রিস্টান হয়েছে এমন না হতে হবে। তাই কোনো মুরতাদ ইহুদী-খ্রিস্টান মেয়ের সাথেও মুসলমান পুরুষের বিবাহ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ নেই।
এসব শর্ত কোনো ইহুদী বা খ্রিস্টান মেয়ের মধ্যে পাওয়া গেলে শরীআতের নিয়ম অনুযায়ী তাকে বিয়ে করলে বিবাহ শুদ্ধ বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ এ সকল শর্ত সাপেক্ষে বিবাহের আকদ করলে তাদের একত্রে থাকা ব্যভিচার হবে না; বরং তাদের মেলামেশা বৈধ ধরা হবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, কেবল এ শর্তগুলো পাওয়া গেলেই তাদেরকে বিবাহ করা জায়েয তথা নিষ্পাপ কাজ বলে গণ্য হবে; বরং সে জন্য দরকার আরও কয়েকটি শর্তের উপস্থিতি। যা পরবর্তী ধাপে বর্ণনা করা হচ্ছে।
ইহুদী-খ্রিস্টান মেয়েকে বিবাহের আগে এই বিষয়ে প্রবল আস্থা থাকতে হবে যে, এই বিবাহে স্বামীর দীনÑধর্মের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই; বরং এই বিবাহের পরও সে ঈমান ও দ্বীনের উপর অটল থাকতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।
এই ব্যাপারেও নিশ্চিত ধারণা ও আস্থা থাকতে হবে যে, এই দম্পতির যে সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করবে (মা আহলে কিতাব হওয়ার কারণে) তাদের দীন-ঈমান রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না এবং তারা ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষা অনুযায়ী জীবন কাটাতে পারবে। পুরুষ অথবা তার ভবিষ্যৎ সন্তানদের ক্ষেত্রে উক্ত বিষয়ে কোনো আশঙ্কা থাকলে বিবাহ জায়েয হবে না।
বিবাহের আগে ভালোভাবে জেনে নিতে হবে, যে রাষ্ট্রের মহিলাকে বিবাহ করার ইচ্ছা করছে সে রাষ্ট্রে সন্তানদেরকে মায়ের ধর্মের অনুসারী গণ্য করার আইন রয়েছে কি না। অর্থাৎ ‘মা অমুসলিম হলে সন্তানও অমুসলিম ধর্তব্য হবে’ এ রকম আইন থাকলে সেখানে থেকে ওই মহিলাকে বিবাহ করা জায়েয হবে না।
তালাক বা স্বামীর ইন্তেকালের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সন্তানরা ধর্মের দিক থেকে মায়ের অনুসারী গণ্য হবে এবং স্বামী বা স্বামীর ওয়ারিশরা তাদের নিতে পারবে না- এই ধরনের কোনো আইন যে দেশে রয়েছে সে দেশে অবস্থিত কোনো আহলে কিতাব মহিলাকেও বিবাহ করা জায়েয হবে না।
যদি আলামত-প্রমাণের মাধ্যমে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, এই বিবাহের কারণে ইসলামী রাষ্ট্র বা মুসলমানদের কোনো ক্ষতি হবে, তাহলে এ বিবাহ থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। উপরোক্ত শর্তগুলোর দিকে সূরা মায়েদার ৫নং আয়াতের শেষাংশে ইঙ্গিত রয়েছে। বিধর্মী রাষ্ট্রের ইহুদী- খ্রিস্টানদের মধ্যে যেহেতু সাধারণত উপরোক্ত শর্তগুলো পাওয়া যায় না, তাই ফুকাহায়ে কেরাম ঐক্যবদ্ধভাবে এই ফতোয়া দিয়েছেন যে, বিধর্মী রাষ্ট্রের কোনো আহলে কিতাব মহিলাকে বিবাহ করা মাকরূহে তাহরীমী; তথা না জায়েয ও গোনাহের কাজ। কোনো আহলে কিতাব মহিলা যদি ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসী হয়ে থাকে এবং উপরোক্ত শর্তগুলো পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায়, তাহলে বিবাহ যদিও সংঘটিত হয়ে যাবে; কিন্তু তা হবে খুবই অনুত্তম কাজ। যার আলোচনা তৃতীয় ধাপে আসছে। উপরিউক্ত আলোচনার স্বপক্ষে কিছু নির্ভরযোগ্য দলীল পেশ করা হল। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন: ‘আহলে কিতাব মহিলাগণ ‘হারবী’ তথা অমুসলিম রাষ্ট্রের অধিবাসিনী হলে তাদের সাথে বিবাহ বন্ধন হালাল নয়।’
আল্লামা ইবনে হুমাম রহ. বলেন: ‘অমুসলিম রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মহিলাকে বিয়ে করা ফিকহবিদদের সর্বসম্মতিক্রমে মাকরূহে (তাহরীমী বা না-জায়েয)। কারণ স্বামীকে অমুসলিম রাষ্ট্রে তার সাথে বসবাস করতে হবে। ফলে সকল প্রকার ফিতনার দ্বারা উন্মুক্ত হয়ে যাবে এবং এতে সন্তানদেরকে অমুসলিম সমাজে তাদের মতো করে বেড়ে উঠতে বাধ্য করা হবে।
আল্লামা দারদীর রহ. বলেন, অমুসলিম রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মেয়েকে বিয়ে করা আরও কঠিনভাবে নিন্দনীয়। কারণ মুসলিম রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মহিলার চেয়ে এদের ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে। ফলে মহিলাটি সন্তানদেরকে স্বীয় ধর্মের উপর লালন পালন করতে থাকবে এবং সন্তানের পিতাকে এ ব্যাপারে সে কোনো পরওয়াই করবে না।
বিখ্যাত ফকীহ আল্লামা শিরবীনী রহ. বলেন, কিন্তু যে সকল আহলে কিতাব মহিলা অমুসলিম রাষ্ট্রে থাকে তাদেরকে বিবাহ করা মাকরূহ (তাহরীমী)। তদ্রুপ বিশুদ্ধ মতানুযায়ী মুসলমান অধ্যুষিত দেশে বসবাসকারিণী আহলে কিতাব মহিলাকে বিয়ে করা দূষণীয় ফিতনার আশঙ্কার কারণে।