এম হাফিজউদ্দিন খান :
কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ আবার তীব্র হতে শুরু করেছে। সীমান্ত জেলাগুলো থেকে খারাপ খবর পাওয়া যাচ্ছে। টিকার জোগানও পর্যাপ্ত নয়। মহামারির পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। বাজেটে সবচেয়ে ভালো দুটি দিক হলো করপোরেট করহার কমানো এবং দেশীয় শিল্পে উৎসাহ প্রদান। ব্যবসাবান্ধব বাজেট দিয়ে অর্থমন্ত্রী বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ইচ্ছার কথা বলেছেন। কিন্তু বিনিয়োগ কতটা বাড়বে সেটার ওপরই নির্ভর করবে কর্মসংস্থান। বাজেট ঘাটতি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যে বাজেট দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। চিন্তার বিষয় হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতির যদি আরো অবনতি ঘটে, বাজেটের লক্ষ্য পূরণ করা আরো কঠিন হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে আয় ও ব্যয়ে বিশাল ফারাক রয়েছে। দুই লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো ঘাটতি। এই ঘাটতি কিভাবে পূরণ করা হবে, সেটা খুব সুস্পষ্ট নয়। বিদায়ি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। রাজস্ব আদায়ে এবারও একই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ রাখা হয়েছে, সেটা তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। বিদায়ি অর্থবছরের তুলনায় এবার জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে, এটা ভালো দিক। এবার জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। কিন্তু এই লক্ষ্যমাত্রাও বাস্তবভিত্তিক নয়।
বাজেটে অনেক ক্ষেত্রেই প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের। তাতে ব্যবসায়ীরা খুশি। কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য বাজেটে কিছু নেই। বিশেষ করে যারা করোনার কারণে দরিদ্র হয়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, তাদের তুলে আনার ব্যবস্থা বাজেটে নেই। গত বছর যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল, সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, সেই লক্ষ্যমাত্রা ঠিকমতো পূরণ হয়নি। যারা আসল গরিব তারা ঠিকমতো সহায়তার অর্থ পায়নি। অনেক এলাকায় মিথ্যা তথ্যে ভাতা উত্তোলনের ঘটনাও ঘটেছে। এমন খবরও পাওয়া গেছে যে নিজের স্ত্রীকে বিধবা বানিয়ে টাকা তুলে নিয়ে গেছেন ইউপি পরিষদের সদস্য বা অন্যরা। তাই এসব ব্যাপারে কী করা হবে তার দিকনির্দেশনা বাজেটে থাকা দরকার ছিল, যাতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।
নির্দিষ্ট আয় শ্রেণির (ফিক্সড ইনকাম গ্রুপ) মানুষ, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী যাঁরা, তাঁদের পেনশনই একমাত্র ভরসা। আমাদের সময়ে যাঁরা অবসর নিয়েছিলেন, তাঁরা মেডিক্যাল অ্যালাউন্স পান মাসে আড়াই হাজার টাকা। তাঁদের বয়স এখন ৮০ বছরের ওপরে। তাঁদের চিকিৎসা খরচ মাসে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। তাঁরা এই অর্থ কোথা থেকে পাবেন? ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও ভুক্তভোগী। আমরা তো অনেক আগে অবসর নিয়েছি। তাই আমাদের পেনশন অনেক কম। আমি যে পদ থেকে অবসরে এসেছিলাম, সেই পদ থেকে এখন যাঁরা অবসরে আসবেন, তাঁরা পেনশন পাবেন ৮৫ হাজার টাকা করে। আমার সমসাময়িকরা পান সাড়ে ১৫ হাজার টাকার পেনশন। সুতরাং আমার মতো প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত লোকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়গুলোও বাজেটে আসতে পারত। আমার মনে হয়েছে, তাঁদের অবস্থা কেউ উপলব্ধি করতে চান না।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের চেয়েও আলোচ্য বিষয় হয়ে গেছে স্বচ্ছতার অভাব। গত বছর স্বাস্থ্য খাত তাদের বরাদ্দের টাকা খরচ করতে পারেনি। অর্থ অপর্যাপ্ত ছিল; কিন্তু সেটাও খরচ করতে পারেনি। স্বাস্থ্য খাতে অদক্ষতা ও দুর্নীতি মারাত্মক দুই সমস্যা। এ বছর তাদের বাজেট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তাতে লাভ কী সেটাই সবার প্রশ্ন। বাজেটে টিকাদান, টিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা পেলাম না। ফাইজারের এক লাখ টিকা এসেছে। এ টিকা ঢাকার বাইরে নেওয়া যাবে না এবং ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রার নিচে সংরক্ষণ করতে হবে। ডাবল ডোজ দিলে মাত্র ৫০ হাজার মানুষকে এ টিকা দেওয়া সম্ভব। আর চীনা টিকা যেটা এসেছে, সেটাও তিন-চার লাখ লোককে দেওয়া যাবে। আমাদের এ পর্যন্ত ৩৩ লাখ লোককে ডাবল ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। টিকা দেওয়ার কথা রয়েছে দেশের ১৩ কোটি লোককে। সে হিসাবে সামান্য কিছু মানুষকেই টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আরো তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু দ্রুত টিকা প্রাপ্তির কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বাজেটে এ বিষয়ে একটা রূপরেখা থাকা দরকার।
করোনা পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের বড় একটা অংশের আয় কমে গেছে। তাই আমরা দাবি করেছিলাম ন্যূনতম করমুক্ত আয়সীমা আরো বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। আমাদের এখানে করমুক্ত আয়সীমা এবারও তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। মধ্যবিত্তের টিকে থাকার জন্য এই সীমা আরো বাড়ানো দরকার ছিল।
আমাদের অর্থনীতির বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক খাত। কিন্তু বাজেটে অনানুষ্ঠানিক খাতকে তেমন কিছু দেওয়া হয়নি। কুটির শিল্প, মাঝারি শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পের কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়নি। আমাদের অনানুষ্ঠানিক খাতে তারাই বেশি। আমাদের অনানুষ্ঠানিক খাত যেহেতু অনেক বড়, তাই তাদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা বাজেটে না থাকাটা চিন্তার। প্রস্তাবিত বাজেটে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা সহজ করা দরকার ছিল।
এই বাজেটে ধনী-গরিবে বৈষম্যও বাড়বে। এটা এই কারণে বাড়বে যে যারা গরিব বা যারা দারিদ্র্যসীমার বর্ডার লাইনে ছিল, তারা বর্ডার লাইনের নিচে নেমে গেছে। এখন তাদের এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না যে তারা এই অবস্থা থেকে ফিরতে পারে। এর বিপরীতে বাজেট ব্যবসাবান্ধব করায় বিত্তবানরা আরো ধনী হবে। সুতরাং বৈষম্য বাড়বেই। এমনিতে আমাদের সামজে বৈষম্য একটা বিরাট সমস্যা। আমাদের এখানে ডিস্ট্রিবিউশন জাস্টিস বলতে গেলে নেই।
বাজেটে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা বা স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান করাটা খুবই ইতিবাচক দিক। প্রস্তাবিত বাজেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্যে করছাড় দেওয়া হয়েছে এবং দেশি শিল্পোদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতে বিদেশি পণ্যে কর বাড়ানো হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে শিল্প বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। শিল্পে বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে। বাজেটে আরেকটা ইতিবাচক দিক হলো করপোরেট করহার কমানো। অনেক বছর ধরেই ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা করপোরেট কর কমানোর তাগাদা দিয়ে আসছিলেন। প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির জন্য করহার সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। আর তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ করা হয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য এটা ভালো উদ্যোগ।
এবারের বাজেটে আরেকটি ভালো দিক হলো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না দেওয়া। যদিও বাজেট চূড়ান্ত করার আগে বিষয়টি নিয়ে আরো চিন্তা-ভাবনা করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণা-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন। কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার বিপক্ষে আমরা অনেক বছর ধরেই সোচ্চার। অর্থনীতিবিদ, নাগরিক সমাজের সবাই এটার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। আমরা আশা করব, সরকার শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে অটল থাকবে।
অর্থনীতির জায়গা থেকে বলা যায়, এই বাজেট বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন হবে। কারণ রাজস্ব আদায় এবং বাজেট ঘাটতি মোকাবেলা দুটিই কঠিন হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, করোনা মহামারি কোন দিকে মোড় নেবে বোঝা যাচ্ছে না। ফলে এটা সহজেই বোঝা যায়, করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বাজেট বাস্তবায়ন আরো কঠিন হবে। তাই মহামারি নিয়ন্ত্রণে চূড়ান্ত বাজেটে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা দরকার।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।