ভূমিকম্প ॥ ইসলাম ও বিজ্ঞানের দৃষ্টি

59

হাফিজ মাওলানা শাহিদ হাতিমী :

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মনুষ্যসমাজ যখন পাপাচারের নিকৃষ্ট শিখরে আরোহণ করে তখন সৃষ্টিকর্তা নানান দুর্যোগ প্রদর্শন করেন। এমনই এক প্রদর্শিত দুর্যোগের নাম ভূমিকম্প বা ভূ-কম্পন। ভূ-অভ্যন্তরে শিলাপীড়নের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হঠাৎ মুক্তি ঘটলে ভূপৃষ্ঠ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তি সৃষ্টি হয়, তা ভূ-কম্পন বা ভূমিকম্পের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এই তরঙ্গ ভূ-গর্ভের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং উৎসস্থল থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের নিকট প্রচন্ড ভূমিকম্প এক অত্যন্ত ভয়াবহ ঘটনা। এর ফলে সুউচ্চ প্রাসাদ মুহূর্তের মধ্যে ধূলিস্যাৎ হয়ে পড়ে। পৃথিবীর বহির্ভাগ চৌচির হয়ে ফেটে পড়ে ও অভ্যন্তরভাগের বিভিন্ন পদার্থ বের হয়ে আসে। ভূমিকম্পের আকস্মিকতা, উৎপত্তি, মানুষের অজানা এবং এর ধ্বংস করার ক্ষমতার ভয়াবহতা মানুষকে ভয়ে বিহ্বল করে দেয়। এ হলো পৃথিবীর সামান্য ভূমিকম্পের বিবরণ। কিন্তু কেয়ামতে যে ভূকম্পন হবে তার তীব্রতা ও ধ্বংসযজ্ঞ কল্পনা করাও মানুষের পক্ষে অসাধ্য। তবে পৃথিবীর সামান্য ভূমিকম্পন থেকে মানুষ কেয়ামতের দিনের ভূ-কম্পনের সামান্য কিছু ধারণা করতে পারে। সেদিনের ভয়াবহতা দর্শনে মানুষ হয়ে পড়বে হতভম্ব। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় তার কণ্ঠরোধ হওয়ার অবস্থা হবে। যদি ভূকম্পনের সাথে আগ্নেগিরির আগ্নেয়পাত ঘটে, তবে বড় বড় শিলাখন্ড ও গলিত উত্তপ্ত লাভার স্রোত ভূগর্ভ থেকে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে। এগুলির উৎক্ষেপণ থেকে মনে হয় যে, এগুলি বের করে দেয়ার জন্য পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ ব্যগ্র, এরা হচ্ছে পৃথিবীর জন্য বোঝা স্বরূপ। যাবতীয় খনিজ পদার্থ, অথবা ধনরতœ যা মানুষ গোপনে পুঁতে রেখেছিলো সব কিছু মাটির অতল থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু কেয়ামতে যে প্রচন্ড ভূ-কম্পন ঘটবে তাতে পৃথিবীতে অদ্যাবধি যত মৃতদেহকে কবর দেয়া হয়েছে, সব বের হয়ে আসবে এবং তাদেরকে কবরের অন্ধকার থেকে দিনের আলোতে প্রকাশ করা হবে। প্রকৃত সত্যের ভিত্তিতে তাদের বিচার অনুষ্ঠিত হবে। এ প্রসঙ্গ বুঝাতে পবিত্র আল কুরআনে যিলযাল নামক এক সূরাতে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছেÑ “পৃথিবীকে যখন ভীষণভাবে প্রকম্পিত করা হবে, যখন ভূমি তার বোঝা বের করে দিবে, আর তখন লোকেরা বলবে, তার কি হল? সে দিন তার সকল খবর বলবে। তা একারণে যে, তার রব তাঁকে এরূপ আদেশই দিবেন। মানুষ সে দিন দলে দলে বিভক্ত হয়ে বের হবে, যাতে নিজের আমলের প্রতিফলন দেখতে পায়। অতঃপর অণু পরিমাণ নেক আমলকারীও তা আবলোকন করতে পারবে, আর অণু পরিমাণ বদ কাজ করলেও তা দেখতে পাবে”, সূরা যিলযাল, আল কুরআন। ভূ-কম্পন, জল-কম্পন, শিলাবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগগুলো পাপের পথ থেকে ফিরে আসার জন্য সৃষ্টিকূলের প্রতি সৃষ্টা প্রদত্ত সতর্ক সংকেত বলে আমরা বিশ্বাস করি। নি¤েœ ভূকম্পন তত্ত্ব, ইসলামের দৃষ্টিকোন তথা কুরআন হাদিসের নির্দেশনা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোনসহ আরো বিস্তারিত আলোকপাত করা হচ্ছে।
ভূমিকম্প সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিকোন:-
কেন এত ভূমিকম্প সংঘঠিত হয় এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, তাঁর ইচ্ছা এবং তিনি যা কিছু প্রেরণ করবেন সে সকল বিষয়ে তিনিই সবকিছু জানেন। তিনি সর্বাধিক জ্ঞানী এবং সর্বাধিক অবহিত। তাঁর আইন-কানুন ও আদেশের রদবদল কেউই করতে পরেনা। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাহদেরকে সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের নিদর্শন সৃষ্টি করেন এবং বান্দাহর উপর প্রেরণ করেন যাতে করে তারা মহান আল্লাহ কর্তৃক তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও ভীত হয়। বান্দাহ কর্তৃক মহান আল্লাহর সাথে যখন শিরক করা হয় (অর্থাৎ, ইবাদত করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সাথে অংশিদারিত্ব করে) তখন আল্লাহ তাআলা ভূমিকম্পের ন্যায় ভয়াবহ নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করেন, যাতে করে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং তাদের বোধদয় হয়। ভূমিকম্প সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা তথা কুরআন হাদিসের দৃষ্টিকোন তুলে ধরা হল। মহান আল্লাহ বলেন- “(আসলে) আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আযাবের) নিদর্শনসমূহ পাঠাই” (সূরা বনি ইসরাঈল ১৭:৫৯)। “অচিরেই আমি আমার (কুদরতের) নিদর্শনসমূহ দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও (তা আমি দেখিয়ে দিবো), যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে পরিষ্কার না হয়, এটা (কুরআনই মূলত) সত্য; একথা কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার মালিক সবকিছু সম্পর্কে অবহিত?” (সূরা হা-মীম আস সিজদা : ৫৩) “বল- আল্লাহ তাআলা তোমাদের নিকট, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে) অথবা তোমাদের পায়ের নীচ (জমিন) থেকে আযাব পাঠাতে সক্ষম, অথবা তিনি তোমাদের দল-উপদলে বিভক্ত করে একদলকে আরেক দলের শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাতেও সম্পূর্ণরূপে সক্ষম।” (সূরা আল আনআম : ৬৫)। শায়খ আল-ইস্পাহানি এ আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেন, “বল: আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর, তোমাদের উপর থেকে (আসমান থেকে)” যার ব্যাখ্যা হলো, তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; “অথবা তোমাদের পায়ের নীচ (জমিন) থেকে আযাব পাঠাতে সক্ষম”, যার ব্যাখ্যা হলো, ভূমিকম্প এবং ভূমিধসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া। নিঃসন্দেহে বর্তমানে যে সকল ভূমিকম্পগুলো ঘটছে তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি, যা দিয়ে তিনি তাঁর বান্দাহদের ভয় দেখিয়ে থাকেন। এই ভূমিকম্প এবং অন্যান্য সকল দুর্যোগগুলো সংঘঠিত হওয়ার ফলে অনেক ক্ষতি হচ্ছে, অনেকে মারা যাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে; এই দুর্যোগগুলো আসার কারণ হচ্ছে, শিরকী কার্যকলাপ (অন্য কাউকে মহান আল্লাহর অংশীদার বানানো) এবং মানুষের পাপ (মহান আল্লাহ যে কাজগুলো করতে নিষেধ করেছেন সে কাজগুলো করার কারণে)। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ বলেনÑ “(হে মানুষ) যে বিপদ আপদই তোমাদের উপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই, এবং (তা সত্ত্বেও) আল্লাহ তাআলা তোমাদের অনেক (অপরাধ এমনিই) ক্ষমা করে দেন।” (সূরা আশ সূরা : ৩০)। “যে কল্যাণই তুমি লাভ কর না কেন, (মনে রেখো) তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, আর যেটুকু অকল্যাণ তোমার উপর আসে তা আসে তোমার নিজের থেকে”। (সূরা আন নিসা : ৭৯)।
অতীত ইতিহাস ও শিক্ষা:-
মহান আল্লাহ অতীত জাতির উপর প্রেরিত আযাব সম্পর্কে বলেন:- “অতঃপর এদের সবাইকে আমি (তাদের) নিজ নিজ গুণাহের কারণে পাকড়াও করেছি, এদের কারো উপর প্রচন্ড ঝড় পাঠিয়েছি (প্রচন্ড পাথরের বৃষ্টি) {যেভাবে লূত জাতির উপর প্রেরণ করা হয়েছিল}, কাউকে মহাগর্জন এসে আঘাত হেনেছে {যেভাবে শুআইব (আ.) এর জাতির উপর আঘাত হেনেছিল}, কাউকে আমি যমীনের নীচে গেড়ে দিয়েছি {যেভাবে ক্বারুন জাতিদের উপর এসেছিল}, আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি {নূহ জাতি ও ফেরাউন ও তার লোকদেরকে যেভাবে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল}, (মূলত) আল্লাহ তাআলা এমন ছিলেন না যে তিনি এদের উপর যুলুম করেছেন, যুলুম তো বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর করেছে”। (সূরাতুল আনকাবুত: ৪০) এখন মুসলামানদের এবং অন্যান্যদের খুবই আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর নিকট তওবা করা উচিত, আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট একমাত্র দ্বীন ইসলামকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরা এবং আল্লাহ তাআলা যেসব শিরকী কার্যকলাপ ও পাপ কাজ করতে নিষেধ করেছেন (যেমন: নামাজ পরিত্যাগ না করা, যাকাত আদায় করা থেকে বিরত না হওয়া, সুদ-ঘুষ না খাওয়া, মদপান না করা, ব্যাভিচার না করা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা না করা, গান ও বাদ্যযন্ত্র না শোনা, হারাম কাজ সমূহ ভঙ্গ না করা প্রভৃতি) তা থেকে বিরত থাকা। এসব নির্দেশ পালনকারীদের বিষয়ে আসা করা যায়, তারা এই দুনিয়া ও পরবর্তীতে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি পাবে এবং আল্লাহ তাদের আযাব থেকে নিরাপদ রাখবেন এবং তাদের উপর রহমত বর্ষণ করবেন। আল্লাহ আহলে কিতাবধারীদের সম্পর্কে বলেন:- “যদি তারা তাওরাত ও ইনজিল (তথা তার বিধান) প্রতিষ্ঠা করতো, আর যা তাদের উপর তাদের মালিকের কাছ থেকে এখন নাযিল করা হচ্ছে (কুরআন) তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতো, তাহলে তারা অবশ্যই রিযিক পেতো তাদের মাথার উপরের (আসমান) থেকে এবং তাদের পায়ের নীচের (যমীন) থেকেও”। (সূরাতুল মায়িদা: ৬৬)।
ভূমিকম্প সম্পর্কে হাদিসের দৃষ্টিকোন:-
ভূমিকম্প সম্পর্কে হাদিসের দৃষ্টিকোন তুলে ধরা হচ্ছে। আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারী (রহ.) তাঁর সহীহ বর্ণনায় জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন “তোমাদের উপর মাথার উপর থেকে আযাব (আসমান থেকে)” নাযিল হলো তখন রাসূল (সা.) বললেন, “আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”, অথবা “ যখন তোমাদের পায়ের নীচ (জমিন) থেকে আযাব নাযিল হলো” তখন তিনি (সা.) বললেন, “আমি তোমার সম্মুখ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি”। (সহীহ আল বুখারী, ৫/১৯৩)। হাদিসে আরো বর্ণিত হয়েছে:- যখন কোথাও ভূমিকম্প সংগঠিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষদের উচিত মহান আল্লাহর নিকট অতি দ্রুত তওবা করা, তাঁর নিকট নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা এবং মহান আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা যেভাবে রাসূল (স) সূর্য গ্রহণ দেখলে বলতেন, “যদি তুমি এরকম কিছু দেখে থাক, তখন দ্রুততার সাথে মহান আল্লাহকে স্মরণ কর, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো।” (আল-বুখারী ২/৩০ এবং মুসলিম ২/৬২৮)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে- কিন্তু তার খিয়ানত করা হবে (অর্থাৎ যার সম্পদ সে আর ফেরত পাবে না), জাকাতকে দেখা হবে জরিমানা হিসেবে, দ্বীনী শিক্ষা ব্যতীত বিদ্যার্জন করা হবে, একজন পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে কিন্তু তার মায়ের সাথে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নেবে আর পিতাকে দূরে সরিয়ে দেবে, মসজিদে উচ্চস্বরে শোরগোল (কথাবার্ত) হবে, জাতির সবচেয়ে দূর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসকরূপে আবির্ভূত হবে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি জনগণের নেতা হবে, মানুষকে তার অনিষ্টতা থেকে রক্ষার জন্য সম্মান প্রদর্শন করা হবে, বাদ্যযন্ত্র এবং নারী শিল্পীর ব্যাপক প্রচলন হয়ে যাবে, মদ পানকরা হবে (বিভিন্ন নামে মদ ছড়িয়ে পড়বে), শেষ বংশের লোকজন তাদের পূর্ববর্তী মানুষগুলোকে অভিশাপ দেবে, এমন সময়ও আসবে যখন তীব্র বাতাস প্রবাহিত হবে তখন একটি ভূমিকম্প সেই ভূমিকে তলিয়ে দিবে (ধ্বংস স্তুপে পরিণত হবে বা পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাবে)। [তিরমিযি কর্তৃক বর্ণিত, হাদিস নং-১৪৪৭]
ভূমিকম্প সম্পর্কে বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন:-
ভূমিকম্প সম্পর্কে বিজ্ঞানিদের অনেক কথা রয়েছে। এখানে সংক্ষেপে ভূমিকম্প বিষয়ক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন তুলে ধরা হলো। ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে ভূপৃষ্ঠের নীচে একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় রয়েছে কঠিন ভূত্বক। ভূত্বকের নীচে প্রায় ১০০ কি.মি. একটি শীতল কঠিন পদার্থের স্তর রয়েছে। একে লিথোস্ফেয়ার (খরঃযড়ংঢ়যবৎব) বা কঠিন শিলাত্বক নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের পৃথিবী নামের এই গ্রহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, কঠিন শিলাত্বক (লিথোস্ফেয়ার)সহ এর ভূ-পৃষ্ঠ বেশকিছু সংখ্যক শক্ত শিলাত্বকের প্লেট (চষধঃব) এর মধ্যে খন্ডখন্ড অবস্থায় অবস্থান করছে। ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানের আলোকে এই প্লেটের চ্যুতি নড়াচড়ার দরুণ ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানিরা আরও বলেছেন, পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেখান থেকে ভূকম্প-তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে কম্পন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শিলার পীড়ন-ক্ষমতা সহ্যসীমার বাহিরে চলে গেলে শিলায় ফাটল ধরে ও শক্তির মুক্তি ঘটে। তাই প্রায়ই ভূমিকম্পের কেন্দ্র চ্যুতিরেখা অংশে অবস্থান করে। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬ কিলোমিটারের মধ্যে এই কেন্দ্র অবস্থান করে। তবে ৭০০ কিমি. গভীরে থেকেও ভূ-কম্পন উত্থিত হতে পারে। ভূমিকম্প সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে এক-দুই মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝে মাঝে কম্পন এত দুর্বল হয়, যা অনুভব করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালী ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিজ্ঞান, আবিষ্কার ও হাদিস গবেষক ইবনে আল-কাইয়ূম (রহ.) বলেন:- “মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে উঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড়ধরণের ভূমিকম্প সংগটিত হয়; এটা মানুষগুলোকে ভীত করে, তারা মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়”। আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হতো তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলতেন:- “মহান আল্লাহ তোমাদেরকে সতর্ক করছেন”। মদীনায় একবার ভূমিকম্প হয়েছিল, তখন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তার জনগণকে ভাষণদানকালে বললেন:- “যদি আরো একবার ভূমিকম্প সংগঠিত হয় তাহলে আমি এখানে তোমাদের সাথে থাকবো না।” সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকদের কাছে এরকম আরো অনেক ঘটনার বিবরণ রয়েছে। উল্লেখ করতে হয় যে, গত ২৯ মে সিলেট শহরে একইদিনে ৫বার ভূ-কম্পন অনুভূত হয়েছে। এটি সিলেট তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর আগে ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল নেপালের কাঠমান্ডুসহ আশপাশে দেশ-প্রদেশে আঘাত হানে এক শক্তিশালী ভূমিকম্প। এতে শুধু নেপালেই নিহত হন ৩ হাজারেরও অধিক মানুষ। সিলেটসহ লালসবুজের প্রিয় এ বাংলাদেশের ভেতর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার বিগত প্রায় ২০০ বছরের ভূমিকম্পের যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, ১৯০০ সালের পর থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে ১০০’রও বেশি ভূমিকম্প; তার মধ্যে ৬৫টিরও বেশি ঘটেছে ১৯৬০ সালের পরে। এ থেকে এই বিষয়টা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের মাত্রা বেড়েছে। সিলেট অঞ্চলে র্সবশষে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ছেলি ১৮৯৭ সালরে ১২ জুন। ঐদিন ৮ দশমিক ৭ মাত্রার সেই ভয়াবহ ভূমকিম্পে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ র্বগ কি.মি. এলাকার পাকা দালান-কোঠার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। শুধু সিলেট অঞ্চলেই ৫৪৫টি ভবন ভেঙে পড়ে। মারা যান অসংখ্য মানুষ। প্রাণহানী ঘটে হাজার হাজার প্রাণীর। ওইদিনের বিকাল সোয়া ৫টার দিকে প্রলংয়কারী ভূমিকম্পকে ‘গ্রটে ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক’ নামে ইতহিাসে পরচিতি। সে হিসেবে সিলেট অঞ্চলে ভয়ানক ভূমিকম্প হওয়ার সময় এখন, কেননা এক শতাব্দি তথা ১শ বছর পেরিয়ে গেলে ঝুকিপূর্ণ এলাকায় আবারও তা হতে পারে। আর তাই ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোনে পড়া সিলেট অঞ্চলে যে কোনো সময় বড়ধরণের ভূকম্পন ঘটতে পারে। কেননা, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ১শ বছর পরপর বেশি মাত্রার ভয়াবহ ভূকম্পন হয়ে থাকে বলে বিশষেজ্ঞদের অভিমত। ১৯১৮ সালে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে হয় ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্প। ২০১৫ সালে পরপর তিনদিন ৫.০ মাত্রার মৃধ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। এতে নিহতের সংখ্যা অল্প হলেও আহতের সংখ্যা বিপুল। অনেক ভূতাত্ত্বিক ও বিশেষজ্ঞর মতে ছোট ছোট ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়া বড়ধরণের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। অতীতের এসব রেকর্ডকে প্রাধান্য দিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত হল, যে কোনো সময় বাংলাদেশে বিশেষত সিলেটে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। সুতরাং আমাদেরকে নিজ নিজ উদ্যোগসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেনতার পাশাপাশি যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন, ডাউকি ফল্টে যদি ৮ মাত্রার ভূকম্পন হয়, তাহলে সিলেট অঞ্চল জনশূন্য হয়ে যেতে পারে। মনে রাখবেন, আপনার উত্তেজনা কিংবা ভয় আপনার জন্য সবচেয়ে বেশী ক্ষতির কারন হতে পারে। তাই যত বিপদেই পড়–ন- কখনোই সাহস হারাবেন না। আল্লাহ সহায়। আসুন! আমরা সকলেই সচেতন হই।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট ও শিক্ষক শায়খুল ইসলাম জামেয়া, সিলেট।