সংসদে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী ॥ সেদিন আমরা দু’বোনের বিচার পাবার কোন অধিকার ছিল না

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বেঁচে থাকা আমরা দুই বোন-শেখ রেহানা ও আমার বিচার পাবার কোন অধিকার ছিল না। আমরা যারা স্বজন হারা, আমরা কেউ কিন্ত বিচার চাইতে পারতাম না, সেই অধিকার আমাদের ছিল না। যেটা ছিল আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করার পর সেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করি। আর সেই বিলটি উপস্থাপন করেছিল সদ্য প্রয়াত আবদুল মতিন খসরু। তাঁর সেই আবেগভরা বক্তৃতা এখনও আমার কানে বাজে।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার শুরু হওয়া বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিনে উত্থাপিত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ’৭৫ পরবর্তী বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পথ বন্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারিসহ খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর আমরা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করি। আমাদের দু’বোনের বিচার চাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনিসহ যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি বলেন, এই অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ সহজ ছিল না। প্রতি পদে বাধা দেয়া হয়েছে। তবুও মতিন খসরুসহ অন্যরা এ বিষয়ে দিনরাত নিরলসভাবে পরিশ্রম করেছেন। অদম্য শক্তি ও সাহস নিয়ে তাঁরা কাজ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, সরকারী দলের আলী আশরাফ, মুজিবুল হক, কামরুল ইসলাম, এ কে এম রহমতুল্লাহ, সাদেক খান, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বিএনপির হারুনুর রশীদ, বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের, জাতীয় পার্টির চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও কাজী ফিরোজ রশীদ। আলোচনা শেষে উত্থাপিত শোক প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
সংসদে যাঁদের নামে শোক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে সবার রুহের মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের বাজেট অধিবেশন শুরু করতে হচ্ছে। প্রয়াত নেতা আবদুল মতিন খসরু আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা ছিলেন। ছাত্রলীগ থেকে রাজনীতি শুরু করেন তিনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠনের পর আমি তাঁকে আইন প্রতিমন্ত্রী, পরে আইনমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং সবশেষ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য করি।
তিনি বলেন, চলমান সংসদে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে অনেক অনেক সাথীকে হারিয়েছে। সবশেষ সুপ্রীমকোর্ট বার কাউন্সিলের নির্বাচনে যখন সভাপতি পদে আবদুল মতিন খসরুকে নমিনেশন দেয়া হয়, আমি তাঁকে বলেছিলাম বেশি ঘোরাঘুরি না করতে। কিন্তু তাঁর আগ্রহ ছিল তাঁকে জিততেই হবে। সারাদেশ সফর করার পরই তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। আমি প্রতিদিন তাঁর স্বাস্থ্যের খবর নিতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁকে আর বাঁচানো গেলো না, আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
সংসদ সদস্য আসলামুল হক আমাদের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম সবকিছুতে সে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করেছে, এজন্য সে বারবার নির্বাচিত হয়েছে। আর এলাকার সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর অন্যরকম একটা টান ছিল, এলাকার উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই সেও চলে গেল। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।
সংসদ নেতা বলেন, আমরা কতজন গণপরিষদ সদস্য তাঁদেরকেও হারিয়েছি। আজকে আমরা যে সংবিধান পেয়েছি সেই সংবিধানে তাঁদের স্বাক্ষর রয়েছে। যেমন খন্দকার আব্দুল মালেক শহীদুল্লাহ, গণপরিষদ সদস্য আবুল হাশেম সাহেব। স্বাধীনতার পর যে সংবিধান এবং এটা তাঁদেরই অবদান। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সাবেক অনেক নেতাকর্মী, সাবেক এমপি সারাহ বেগম কবরী, মিরাজ মোল্লা, আমজাদ হোসেন মিলন- এরকম আমরা অনেককে হারিয়েছি। ফরিদা রহমান তিনিও আমাদের এমপি ছিলেন। ছাত্রলীগ আমরা একসঙ্গেই করেছি। তাছাড়া আরও অনেক সদস্যকে হারিয়েছি।
সদ্য প্রয়াত বাংলা একাডেমির সাবেক চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান খানের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন- প্রত্যেকটা বই লেখায় সবসময় আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। দুর্ভাগ্য বেবী মওদুদ এই সংসদের সদস্য ছিল তিনিও আমাদের মাঝে নেই। শামসুজ্জামান খানও চলে গেলেন। কয়েকজন মিলে আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম, একে একে সবাইকে হারিয়ে ফেললাম। বাংলা একাডেমির উন্নয়নের জন্য তিনি অনেক কাজ করেছেন। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান মর্যাদাপূর্ণ পরিচয় হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। এরপর হাবীবুল্লাহ সিরাজী তিনিও চলে গেলেন। আসলে সত্যি খুব দুঃখজনক এভাবে একজন একজন করে হারাচ্ছি, যেটা আমাদের জন্য সত্যি খুব কষ্টকর।
ফিলিস্তিনে ইসরাইলী হামলার নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফিলিস্তিনের ঘটনা সত্যি খুব অমানবিক। ছোট শিশুদের কান্না, তাদের সেই অসহায়ত্ব, পিতা-মাতাকে হারিয়ে ঘুরে বেড়ানো- এটা দেখে সহ্য করা যায় না। ইসরাইল এর আগেও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। আমরা এই হত্যাযজ্ঞের তীব্র নিন্দা জানাই। যারা মারা গেছেন তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। তিনি বলেন, এই ধরনের ঘটনা জানি না যারা অনেক সময় মানবতার এত কথা বলেন, কিন্তু এই সময় তারা চুপ থাকেন কেন? আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন আর কথা বলে না কেন, সেটাই আমার প্রশ্ন। যাহোক আমরা ফিলিস্তিনী ভাইদের সঙ্গে সবসময় আছি। আমাদের সাধ্যমতো সবরকম সহযোগিতা অতীতেও করেছি, এখন আমরা করে যাচ্ছি। এটা আমরা অবশ্যই করে যাব এবং ইসরাইলের ঘৃণ্য আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাই।
দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ পুনর্বার জানিয়ে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, আসলে জীবনটাই হয়ে গেছে এমন যে, কখন কে আছে আর কে নেই তার কোন হিসাব নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু আমি সবাইকে বলব আমাদের স্বাস্থ্যবিধিটা যেন সকলে মেনে চলেন। টিকাদান থেকে শুরু করে সব রকম ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। কিন্তু তারপরও নিজেরা সুরক্ষিত থাকতে হবে এটাই চাই।
আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক শোক প্রস্তাবে উত্থাপিত সবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলেন, ৫০ বছর ধরে মরহুম আবদুল মতিন খসরুকে চিনি। প্রথমে চিনেছি ছাত্রনেতা হিসেবে, পরে চিনেছি আইনজীবী, জনপ্রতিনিধি এবং একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের প্রস্তাব উত্থাপন করে যে বক্তব্য রেখেছেন, সেই বক্তব্যই ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন বলিষ্ঠ সৈনিক হিসেবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন।
বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদের বলেন, করোনা সারাবিশ্বে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাণঘাতী করোনায় অনেক গুণীজনকে হারিয়েছি। পাঁচবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত, বিনয়ী ও জননন্দিত নেতা ছিলেন। সংবিধানবিরোধী কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, জন্ম হলে মৃত্যু হবেই, তবে অনেক মৃত্যু হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন খসরু শুধু একজন এমপি ছিলেন না, নির্বাচনী এলাকায় অসম্ভব জনপ্রিয়, ত্যাগী নেতা ছিলেন। রাষ্ট্র, দেশ ও নির্বাচনী এলাকার জন্য একজন দক্ষ নেতাকে আমরা হারালাম। ইনডেমনিটি বাতিলের পর একে একে আমরা বঙ্গবন্ধুসহ সব হত্যার বিচার করতে পারছি। আর ঢাকা মহানগরীতে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের অত্যন্ত সাহসী ও ত্যাগী নেতা ছিলেন আসলামুল হক।
জাসদের হাসানুল হক ইনু প্রয়াত সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু ও আসলামুল হকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী, দক্ষ আইনজ্ঞ ও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আবদুল মতিন খসরু। বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনীদের ইনডেমনিটি বাতিলের প্রস্তাব উত্থাপনের সময় তাঁর চমৎকার বক্তব্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তখন থেকে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। আমরা যখন দুর্নীতি ও জঙ্গি-সন্ত্রাসে জর্জরিত, তখন আবদুল মতিন খসরুর মতো একজন সাহসী যোদ্ধাকে হারালাম।
জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, প্রাণঘাতী করোনা অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। অত্যন্ত অমায়িক, বিনয়ী মানুষ আবদুল মতিন খসরু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আজীবন কাজ করেছেন। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের মাধ্যমে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। এ রকম একজন ত্যাগী, বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক অনুসারী সত্যিকার মানুষ বর্তমানে পাওয়া খুবই কঠিন। তাঁর মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হলো।
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আবদুল মতিন খসরু অত্যন্ত একজন সজ্জন মানুষ ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদের মতো এত সংখ্যক সংসদ সদস্য অতীতে কোনদিন মারা যাননি। মৃত্যুর পর আল্লাহ আমাদের জবাবদিহিতায় আনবে, কর্মের ওপর বিচার হবে।
মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, প্রয়াত আবদুল মতিন খসরু শুধু একজন জনপ্রিয় ও দক্ষ রাজনীতিবিদই ছিলেন না, একজন একনিষ্ঠ অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের প্রস্তাব উত্থাপনকারী হিসেবে তাঁর নাম জাতি চিরদিন মনে রাখবে। প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামে, বিশেষ করে ওয়ান/ইলেভেন পরবর্তী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলা পরিচালনাসহ মুক্তির আন্দোলনে আবদুল মতিন খসরুর নেতৃত্বে আমরা কাজ করেছি। প্রয়াত আসলামুল হকও ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ, সাহসী ও ত্যাগী নেতা।
বিরোধী দলের চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, এই সংসদে আমরা অনেক গুণী ও ত্যাগী নেতাকে হারিয়েছি। পাঁচবারের সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। ইনডেমনিটি বিল পাসের সময় তাঁর অসম্ভব আবেগময় বক্তব্য ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।