পাঁচ মাস পর টিকফা বৈঠকের প্রস্ততি নিচ্ছে বাংলাদেশ, টিকার ওপর বেশি জোর

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পাঁচ মাস পর টিকফা বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। জুলাই মাসে দেশের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটনের এই বৈঠকে যোগদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতর (ইএসটিআর) নিজ নিজ দেশের পক্ষে টিকফা বৈঠকের আলোচ্য সূচী প্রস্তুত করছে। বৈঠকে মহামারী করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাওয়া হবে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে জীবন বাঁচাতে দ্রুত টিকা আমদানি, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি বাড়ানো এবং দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা জিএসপি সঙ্কটের সমাধান চাইবে বাংলাদেশ সরকার।
করোনার কারণে এবারের টিকফা বৈঠকটি প্রায় পাঁচ মাস পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হওয়ায় আবার বৈঠকের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কারণে সেখানে দুদেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সশরীরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বৈঠক যোগ দেবেন। বাংলাদেশ সরকার এই সময় মানুষের জীবন বাঁচাতে করোনার টিকা আমদানি ও উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। মহামারী করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। আগামী টিকফা (যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তি) বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা ও টিকা উৎপাদনে দেশটির সহযোগিতা চাওয়া হবে। আগামী জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিতব্য টিকফার ষষ্ঠ বৈঠকে বাংলাদেশ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর আগের বৈঠকগুলোতে টিকফা বৈঠকের কার্যসূচীতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হতো রফতানি ও জিএসপি ইস্যুতে। এবার করোনা বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। বৈঠকের বিষয় নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশটির বাণিজ্য দফতর (ইউএসটিআর) টিকফা বৈঠকের বিষয়ে আগ্রহী। করোনার কারণে পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। আগামী বৈঠকে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার।
উল্লেখ্য, করোনা নিয়ন্ত্রণে ভারত, চীন ও রাশিয়ার পর এবার যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পেতে চেষ্টা করা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১০ থেকে ২০ মিলিয়ন (দুই কোটি) টিকা চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৬০ মিলিয়ন ডোজ এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সংরক্ষিত রয়েছে। তবে তারা সেটি ব্যবহার করছে না। আর আমাদের এখানে দ্বিতীয় ডোজ সম্পূর্ণ হচ্ছে না। সে কারণেই জরুরী ভিত্তিতে টিকা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া টিকা উৎপাদনে রাশিয়া একটি প্রস্তাব দিয়েছে। সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এছাড়া চীনের টিকার প্রয়োগ শুরু করা হয়েছে।
জানা গেছে, ভারত থেকে আমদানি করা অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দ্রুত শেষ হওয়ার পথে। এ অবস্থায় কোভিড-১৯ টিকা পেতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাড়ার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টিকার জন্য আমরা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে লিখেছি। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দফতর ও ইউএস চেম্বার অব কমার্সের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। যদি যুক্তরাষ্ট্র এই টিকা অনুদান হিসেবে দেয়, তাহলে খুব ভাল হয়। আর দ সেটা না হয়, তাহলে সেখান থেকে কিনার জন্যও বাংলাদেশের প্রস্তুতি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, টিকফা বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টিকা আমদানি ও উৎপাদনে সহযোগিতা চাওয়া হবে। মানুষের জীবন বাঁচাতে এ মুহূর্তে করোনা প্রতিরোধে টিকা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ভারতের পাশাপাশি চীনের টিকার ব্যবহার শুরু হয়েছে। রাশিয়া থেকে টিকা আসবে। এছাড়া অন্যান্য দেশের মতো করোনার টিকা উৎপাদন করা হবে। তিনি বলেন, করোনার টিকা আমদানির পাশাপাশি টিকা উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার বিষয়টি নিয়ে টিকফা বৈঠকে আলোচনা করা হবে। এবার কার্যসূচীর প্রথমে করোনার টিকার বিষয়টি রাখা হয়েছে। তিনি আরও জানান, করোনার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে এবার সশরীরে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল উপস্থিত থাকতে পারবেন।
জানা গেছে, করোনার টিকা আমদানি ও উৎপাদনে সহযোগিতা চাওয়ার পাশাপাশি টিকফা বৈঠকের আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মার্কিন বিনিয়োগ চাওয়া হবে। এছাড়া রফতানি বাড়ানো এবং দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা জিএসপি ইস্যুতে কথা বলা হবে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল অর্থনীতির উন্নয়ন, এছাড়া সমুদ্র আহরণ বা ব্লু ইকোনমিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ চাওয়া হবে। কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পেও দেশটির বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পরও যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাজার সুবিধা বহাল রাখে সে বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল দিতে চায় সরকার। এদেশের ব্যবসায়ীরাও চান টিকফা বৈঠকের মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের নবনির্বাচিত সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, জিএসপি ইস্যুতে দেশের প্লাস্টিক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দ্রুত প্লাস্টিক পণ্যসহও সব ধরনের রফতানিতে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
জানা গেছে, এবারের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বিনিয়োগ পরিবেশ, ব্যবসা সহজীকরণ, মার্কেট এক্সেস, ট্যারিফ পুনর্র্নিধারণ মেধাস্বত্ব, ডিজিটাল ইকোনমি, আঞ্চলিক যোগাযোগ, জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়ন, সরকারী ক্রয়ে স্বচ্ছতা এবং শ্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ সভায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশাধিকার সম্প্রসারিত করার বিষয়ে অনুরোধ জানানো হবে। বিশেষ করে নার্স, মিডওয়াইফসহ অন্যান্য সেবা খাতে মোড-৪ এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ সহজীকরণে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশে বিরাজমান বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন চুক্তি বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য অনুরোধ করা হবে। বাংলাদেশী পণ্য বিশেষ করে গার্মেন্টস পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ওপর জোর দিবে বাংলাদেশ।
একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি হয় বাংলাদেশ থেকে। বাণিজ্য ঘাটতি বরাবরই বাংলাদেশের অনুকূলে। তবে জিএসপি সুবিধা বাতিল, পোশাকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না করা, তৈরি পোশাক রফতানিতে উচ্চহারে শুল্ক আরোপসহ নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাধার মুখে পড়েছে। তবে সম্প্রতি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। বাংলাদেশ ও যুত্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত ট্রেড এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট (টিকফা)’র পঞ্চম সভা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও পাঁচ বছর আগে করা এ ফোরামের অগ্রগতি নিয়ে হতাশাও রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। কারণ এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোন বিনিয়োগ পাওয়া যায়নি।