দুই দশকে হাকালুকি হাওরে পাখির বিচরণ কমেছে ৪৫%

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কয়েক দশক আগেও পাখির কলতানে সর্বক্ষণ মুখর থাকত হাকালুকি হাওর এলাকা। বিশেষ করে শীতকালে গোটা এলাকা ছেয়ে যেত পরিযায়ী পাখিতে। হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বড় একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছিল নানা প্রজাতির পাখির বিচরণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় হাওরে পাখির পরিমাণ কমেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) এক জরিপ তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, গত দুই দশকে হাকালুকি হাওরে পাখির বিচরণ কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।
জলাভূমি ভরাট হয়ে ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে বিচরণস্থল। আবার একই সঙ্গে চলছে ইজারায় মত্স্য চাষ। রয়েছে চোরাশিকারির উৎপাতও। এসব কারণেই হাকালুকি হাওরে পাখির পরিমাণ দিন দিন কমছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে আইইউসিএনের জরিপ তথ্য বলছে, সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং খাল-বিল-ছড়া ভরাট ও দখলের কারণে ঝুঁকির মুখে পড়েছে হাকালুকির জীববৈচিত্র্য। গত ২০ বছরে হাকালুকি হাওরে পাখির আবাসস্থল কমেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। ফলে পাখির বিচরণও কমেছে। ২০০০ সালের আগেও হাওরে প্রতি বছর গড়ে বিচরণ করেছে প্রায় ৭৫-৮০ হাজার পাখি। প্রায় ২০০ প্রজাতির এসব পাখির সিংহভাগই থাকত পরিযায়ী। অন্যদিকে কয়েক বছর ধরে ক্রমেই কমছে বিচরণকারী পাখির সংখ্যা। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চার বছরে হাওরে বিচরণকৃত পাখির গড় সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৯ হাজার। দুই দশকে হাকালুকি হাওরে বিচরণকারী পাখির সংখ্যা কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।
সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকি। এ হাওরের ৮০ শতাংশই মৌলভীবাজারে। বাকি ২০ শতাংশ সিলেটে অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রধান চারটি ‘মাদার ফিশারিজ’ এলাকার অন্যতম হাকালুকি হাওর। বিভিন্ন আকারের ২৭৬টি আন্তঃসংযুক্ত বিল নিয়ে গড়ে উঠেছে হাওরটি। এছাড়া বিভিন্ন ছড়া ও খাল মিলিয়ে হাওরসংশ্লিষ্ট জলাধারের মোট সংখ্যা প্রায় ৩০০টি।
স্থানীয়রা জানালেন, হাকালুকির মৌলভীবাজার অংশে তলদেশে পলি পড়ে হাওরের খাল-বিলগুলো ক্রমেই ভরাট হচ্ছে। হাওরসংশ্লিষ্ট অনেক ছড়া, খাল-বিল এরই মধ্যে অস্তিত্ব হারিয়েছে। আবার হাওরে ইজারায় মত্স্য চাষের প্রথাও চালু রয়েছে। এ ইজারা গ্রহণকারীরা হাওরের বাস্তুসংস্থান নিয়ে তেমন একটা সচেতন নন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে মত্স্য নিধনও চলে নির্বিচারে। ফলে হাওরের পাখিদের বিচরণ ও আবাসস্থলের পাশাপাশি খাদ্য নিয়েও সংকট দেখা যাচ্ছে। এতে করে ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে পাখির সংখ্যা।
হাওরের বাস্তুসংস্থানও এখন অনেকটাই বিপন্ন হয়ে উঠেছে। হাকালুকি হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে বর্তমানে ১১২টি টিকে আছে। ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ও সরীসৃপ এখন বিলুপ্তপ্রায়। প্রতি বছর শীতকালে হাওরে প্রচুর বিরল প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসত। কিন্তু বিচরণস্থল কমে যাওয়ার পাশাপাশি চোরাশিকারির দৌরাত্ম্যে সে পাখির বিচরণও এখন খুবই কম। অন্যদিকে জলাধার ও পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় হাওরের জমিতে এখন শস্য আবাদ হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে হাকালুকির অনেক স্থানই এখন পাখি বিচরণের অনুকূল বাস্তুসংস্থান হারিয়েছে।
হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো ১০টি ছোট-বড় নদী। এ জলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। প্রতি বছর উজানের পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে প্রচুর পলি এসব নদী দিয়ে হাওরে প্রবেশ করছে। ড্রেজিং না হওয়ায় এসব পলি বিলগুলোকে ভরাট করে দিচ্ছে। অন্যদিকে নদী শীর্ণ হয়ে পরিণত হচ্ছে খালে।
প্রতি বছর বর্ষাকালে হাকালুকি হাওরসংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে। বর্ষায় পানির গভীরতা হয় দুই থেকে ছয় মিটার। এক সময় হাওরে ছোট-বড় ২৩৮টি বিল ছিল। এসব বিলের মধ্যে সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে হারিয়ে গেছে ২১টি। বর্তমানে কোনো রকম অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে ২১৭টি বিল। অধিকাংশ বিলই আংশিক ভরাট হয়ে গেছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে খাল ও বিলের বড় অংশই ভরাট হয়ে যেতে পারে। এসব বিলের পানি না থাকায় মাছের উৎপাদন কমে গেছে। আর জলজ উদ্ভিদসহ অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব কমে যাওয়ার কারণে পাখির খাদ্য সংকট তীব্র হচ্ছে। পাশাপাশি সংকট রয়েছে বাসস্থানের। গত ১০ বছরে গবাদি পশুর খামার বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। এছাড়া হাওরের ইজারাগ্রহীতারা অনেক বিল পানিশূন্য করে তাতে চুন প্রয়োগ করে। এর ধারাবাহিকতায় এসব বিলসংলগ্ন এলাকাও পাখির আবাসস্থল হিসেবে অনিরাপদ হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে আইইউসিএনের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন বলেন, পরিযায়ী ও আবাসিক পাখির জন্য অন্যতম উপযুক্ত স্থান হাওর এলাকা। কিন্তু এসব অঞ্চলে পাখিদের বাসস্থান ধ্বংস করা হচ্ছে। হাকালুকি হাওরে পাখির সংরক্ষণ ও রক্ষায় কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ নেই। ফলে নিরাপদ আবাসস্থলের খোঁজে পাখিরা বিকল্প স্থানে চলে যাচ্ছে। উপযুক্ত বাসস্থান ও খাদ্য সংস্থান না করতে পারলে এরা এক সময় দেশ থেকেও চলে যেতে পারে। প্রতিবেশ রক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করা পাখিদের আবাসস্থল রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশ পাখি সংরক্ষণের উদাহরণ হতে পারে। হাওরের পাখিদের রক্ষা করতে হলে এখান থেকে ইজারা প্রথা বাতিল করতে হবে। হাকালুকিকে টাঙ্গুয়ার হাওরের মতো সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। পাশাপাশি শস্য আবাদে দূষণ ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে।
জানা গিয়েছে, বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখি আসে প্রধানত আটটি দেশ থেকে। দেশগুলো হলো মঙ্গোলিয়া, চীন, তিব্বত, ভারত, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান ও রাশিয়া। প্রতিটি পরিযায়ী পাখি গড়ে আট হাজার মাইল ভ্রমণ করে থাকে। বাংলাদেশে ২০০-২৩০ দিন বাংলাদেশে অবস্থান করে এসব পরিযায়ী পাখি। এসব পাখির অবস্থানের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত এলাকা হলো হাওর অঞ্চল। প্রতি বছর গড়ে হাওরগুলোয় দেড় লাখ থেকে দুই লাখ পরিযায়ী পাখি আসছে। আগে এর সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের বেশি। মূলত হাওর এলাকায় বাসস্থান ও খাদ্য সংকটের পাশাপাশি চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্যে পরিযায়ী পাখি আসা এখন অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়া বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় চার-পাঁচ লাখ পাখি, নদী এলাকায় ১০-১৫ হাজার পরিযায়ী পাখি আসছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার মৌলভীবাজারের সভাপতি আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, হাকালুকি হাওর মিঠাপানির অন্যতম প্রজননকেন্দ্র। প্রতি বছর শীত মৌসুমে সুদূর সাইবেরিয়া ও ইউরোপ থেকে বাঁচার তাগিদে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এসে আমাদের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করছে। এসব পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও মানুষের সচেতনতা প্রয়োজন। খাল ও বিল ভরাটের পাশাপাশি নদী এভাবে ভরাট দখল হয়ে যাওয়ার কারণে হুমকিতে পড়বে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য। এখনই ব্যবস্থা না নিলে হাওরের প্রাণ প্রতিবেশ বেশিদিন টিকবে না।
আইইউসিএনের জরিপ তথ্য বলছে, দেশে প্রায় ৭১১ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি রয়েছে। এর মধ্যে পরিযায়ী পাখির প্রজাতি ৩৮৮টি। সংকটাপন্ন পাখির সংখ্যা এখন প্রায় ৩৯ প্রজাতির। এর মধ্যে ২১ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি রয়েছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে বিপন্নপ্রায় ১২টি প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে সংকটাপন্ন অবস্থায় টিকে রয়েছে। ২০১৫ সালেও দেশে সংকটাপন্ন পাখির প্রজাতি ছিল ২৯টি। গত বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯টি। এছাড়া দেশ থেকে ১৯ প্রজাতির পাখি এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।