কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে প্রাণঘাতী করোনার তৃতীয় ঢেউ চোখ রাঙ্গাচ্ছে। আগামী মাস নাগাদ তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনার ভারতীয় ধরণ নিয়ে চিন্তিত সরকার। এই ধরনটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে একজন থেকে ৪০০ জন পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারেন। দেশে ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তখন সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। বিশ্বজুড়েই এখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ভারতীয় ধরন। সীমান্তের বৈধ অথবা অবৈধ পথে ভারত থেকে আসা যাত্রীরা এখন করোনার ভারতীয় ধরণের জন্য অশনি সঙ্কেত। ভারত পাশের দেশ হওয়ায় সতর্ক পদক্ষেপ না নিলে দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে বেশ কিছুদিন ধরে দাবি করে আসছেন সরকার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। দ্বিতীয় ঢেউয়ের তান্ডবে শনাক্ত ও মৃত্যু প্রথম আঘাতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। একের পর এক শনাক্ত হচ্ছে করোনার নতুন ধরন। যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজিরিয়া ও ভারতীয় ধারার নতুন করোনা শনাক্ত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে লকডাউন। শুরুতে লকডাউনে কঠোরতা ছিল। ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার হার কিছুটা কমে স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু দাবির প্রেক্ষিতে অনেক বিধি-নিষেধই এখন শিথিল করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুটি কারণে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা এড়ানো সম্ভব নাও হতে পারে। প্রথমত, কোভিডের ভারতীয় ধরনটি ইতোমধ্যে দেশে শনাক্ত করা হয়েছে। তাও এমন সময়ে যখন ফেরি, পরিবহন এবং শপিংমলে সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে পাগলের মতো সবাই ভিড় করছেন। দ্বিতীয়ত, ভ্যাকসিন সঙ্কটের কারণে দেশে টিকাদান কর্মসূচিও সন্তোষজনক নয়। উপদেষ্টা কমিটি কোভিডের ভারতীয় ধরনগুলো বিবেচনা করে সরকারকে দেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিষয়ে তাদের পূর্বাভাস জানিয়েছিল। সরকারকে দেয়া এক চিঠিতে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল যে কোন মূল্যে ঈদে ঘরমুখী মানুষের ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঈদের সময়ে ফেরি, লঞ্চ টার্মিনাল এবং শপিংমলগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত জনসমাবেশ কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের কারণ হয়ে উঠবে এবং এর প্রভাব ঈদের দুই সপ্তাহ পর অর্থাৎ জুনের শুরুতে দৃশ্যমান হবে।
জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ সহীদুল্লা বলেছেন, ভারতীয় ধরণ দেশে ছড়িয়ে পড়লে জুনে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। দ্বিতীয় যে ঢেউটা কমিয়ে আনা হয়েছে তা আবার ইউটার্ন নিতে পারে। এর মধ্যে করোনার ভারতীয় ধরণ ছড়িয়ে পড়লে নেপালের মতো পরিস্থিতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণের দাবি, বিশ্বজুড়ে এখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ভারতীয় ধরন। পাশের দেশ হওয়ায় সতর্ক পদক্ষেপ না নিলে দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। যেমনটি হয়েছে নেপালে। কিছুদিন আগেও নেপালে ভাল পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু হঠাৎই পরিস্থিতির অবনতি হয়।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের মোবাইল সিমের হিসাবের ভিত্তিতে ঈদের আগে ১২ দিনে (গত ৪ মে থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) ঢাকা ছেড়েছেন এক কোটিরও বেশি মানুষ। এ হিসাবে একজন সিম ব্যবহারকারীকে ইউনিক ব্যবহারকারী হিসাবে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স এ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইদেশি) যৌথভাবে প্রায় ২০০ কোভিড-১৯ এর নমুনা সিকোয়েন্সিং করেছে। সেই গবেষণায় উঠে এসেছে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজিরিয়া ও ভারতীয় ধারার নতুন করোনা ধরন। লকডাউন শিথিলের ফলে করোনা সংক্রমণ ফের বেড়ে যেতে পারে। ঈদে সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে যারা গ্রামে ফিরেছে তারা নিজেরা হয়ত সংক্রমিত হয়েছেন, নয়ত নিজের অজান্তে অনেকেই অন্যদের সংক্রমিত করেছেন। এখন আবার গাদাগাদি করে নগরীতে ফিরছেন। এতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। নির্দেশনা উপেক্ষা করে ঈদ উদ্যাপনে যারা গ্রামে গিয়েছেন জরুরী প্রয়োজন ছাড়া তারা যেন ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন করেই রাজধানীতে ফেরেন এমন অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু কে শোনে কার কথা?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত রোগী দেশে প্রথম শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ, আসে প্রথম ঢেউ। এরই মধ্যে ভাইরাসটির দ্বিতীয় ঢেউ বয়ে যাচ্ছে দেশের ওপর দিয়ে। এমন অবস্থায় আগামী মাসেই করোনার ‘তৃতীয় ঢেউ’ আছড়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের শীর্ষ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ভাইরোলজিস্টরা জুনের শুরুতে দেশ করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন। করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একজন থেকে ৪০০ জন পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারেন। দেশে এই ধরন ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তখন সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ৭ মে পর্যন্ত ৩৪ লাখ মানুষ ভ্যাকসিনের দুটি ডোজই গ্রহণ করেছেন। যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ। আর ৫৮ দশমিক ২ লাখ জনেরও কম মানুষ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়েছেন। যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর দেয়া তথ্যানুযায়ী, একটি দেশে কোন রোগের বিরুদ্ধে জনগণের শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দেশটির মোট জনসংখ্যার অন্তত ৭০ শতাংশকে টিকা দেয়া প্রয়োজন। যেহেতু দেশে টিকা দেয়ার পর্যাপ্ত আদর্শ কোন ব্যবস্থা নেই, তাই কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গ মোকাবেলায় আইসিইউগুলোতে অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করে আবারও হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করা উচিত।
পুলিশের ইমিগ্রেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, সীমান্ত বন্ধ থাকার পরেও দ্রুত ছড়ানো করোনার ভারতীয় ধরণে আক্রান্ত কয়েকজন রোগী শনাক্ত হয়েছে দেশে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হাইকমিশনারের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নিয়ে ভারতে আটকা পড়া যাত্রীরা বাংলাদেশে এসেছে। সীমান্ত বন্দর দিয়ে আসা আটকেপড়া যাত্রীদের পরীক্ষায় ভারতীয় ধরণ ধরা পড়ার খবর দেয়া হয়েছে। সীমান্ত বন্ধ থাকলেও অবৈধপথে চিরাচরিতভাবেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যাত্রী যাওয়া আসা করছে, যা করোনাভাইরাসের মধ্যে অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের চার দিকের তিন দিক থেকে ভারত ঘেরা থাকায় ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা চোরাই পথের যাত্রীদের কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। জনগণ এখনই সচেতন ও সতর্ক না হলে সেটিও বিস্তারের আশঙ্কা থাকছে। যে হারে ভারতীয় ধরনগুলো ছড়িয়ে পড়েছে তা করোনাভাইরাসের অন্যান্য ধরনের তুলনায় ৪২ শতাংশ বেশি। ইতালি, ইংল্যান্ড থেকে এসে যদি দেশে করোনা সৃষ্টি হতে পারে তাহলে আমাদের পাশের দেশ ভারত থেকে ভারতীয় ধরন সংক্রমণ ছড়াতে পারে বা ছড়াবে তা ধরেই নিয়েই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।