স্পোর্টস ডেস্ক :
সুযোগ ছিল ফলোঅন করানোর, প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কার থেকে ২৪২ রানের বড় ব্যবধানে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাগতিকরা চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করার ঝুঁকি নিতে চায়নি, তাই ফলোঅনও করায়নি টাইগারদের। বরং শেষ বিকেলে দ্বিতীয়বার ব্যাটিংয়ে নেমে যায় দিমুথ করুনারত্নের দল।
ব্যাটিংয়ে হতাশার এক দিন উপহার দেয়া বাংলাদেশ শেষ সময়ে এসে বোলারদের কল্যাণে একটু স্বস্তির বাতাস পেয়েছে। ১৫ রানের মধ্যেই যে লঙ্কান দুই ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে পাঠিয়েছে সফরকারিরা। তৃতীয় দিনশেষে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ২ উইকেটে ১৭ রান। লিড ২৫৯ রানের।
ইনিংসের তৃতীয় ওভারেই আঘাত হেনেছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। তার ঘূর্ণি ডেলিভারিতে এজ হয়ে স্লিপে নাজমুল হোসেন শান্তর ক্যাচ হয়েছেন প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান লাহিরু থিরিমান্নে (২)।
পরের ওভারে আরেক স্পিনার তাইজুল ইসলামকে বোলিংয়ে নিয়ে আসেন অধিনায়ক মুমিনুল হক। প্রথম বলেই উইকেট, ওসাদা ফার্নান্ডোর (১) ব্যাটের কানায় লেগে বল চলে যায় উইকেটরক্ষক লিটন দাসের গ্লাভসে। উৎসবে মাতে বাংলাদেশ শিবির।
তবে শেষ বিকেলে কিছুটা স্বস্তি পেলেও পাল্লেকেলে টেস্টে ব্যাকফুটেই আছে বাংলাদেশ। এর আগে ব্যাটসম্যানদের দায়সারা পারফরম্যান্সে ২৫১ রানেই অলআউট হয়ে যায় সফরকারিরা। অর্থাৎ প্রথম ইনিংসেই ২৪২ রান পেছনে পড়ে যায় মুমিনুল বাহিনী।
শ্রীলঙ্কার অভিষিক্ত প্রাভিন জয়াবিক্রমার ঘূর্ণিতেই বলতে গেলে শেষ হয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস। ৩২ ওভার বল করে ৯২ রান দিয়ে মোট ৬টি উইকেট নিয়েছেন তিনি। ২টি করে উইকেট নিলেন সুরাঙ্গা লাকমাল এবং রমেশ মেন্ডিস।
এই টেস্টের প্রথম দিন মনে হচ্ছিল প্রথম টেস্টের মত। দ্বিতীয় দিন কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছিল। বাংলাদেশ প্রথম দিন পেয়েছিল মোটে ১ উইকেট। দ্বিতীয় দিন পেয়েছিল ৪ উইকেট। তৃতীয় দিন এসে উইকেট ভাঙতে শুরু করে। স্পিনাররা তাতে প্রাধান্য বিস্তার করে। তাতেই দেখা যাচ্ছে, অভিষিক্ত জয়াবিক্রমার বাঁ-হাতি স্লো অর্থোডক্সে পুড়ে ছাই বাংলাদেশের ইনিংস।
ম্যাচের তৃতীয় দিন মাত্র ১৫ মিনিট ব্যাটিং করেই ইনিংস ঘোষণার সিদ্ধান্ত জানায় স্বাগতিকরা। তাসকিন আহমেদের বোলিংয়ে মুশফিকুর রহীমের দুর্দান্ত ক্যাচে আগেরদিনের অবিচ্ছিন্ন জুটি ভাঙতেই ৪৯৩ রানে ব্যাটিং ছেড়ে দেয় শ্রীলঙ্কা।
বৃষ্টির কারণে তৃতীয় দিন প্রায় দেড় ঘণ্টা খেলা হয়নি। ফলে আজ ১৫ মিনিট আগে শুরু হয় চতুর্থ দিনের খেলা। এই ১৫ মিনিটের মধ্যে ৩.৩ ওভার ব্যাটিং করে ২৪ রান যোগ করে শ্রীলঙ্কা, হারায় রমেশ মেন্ডিসের উইকেট। সবমিলিয়ে প্রথম ইনিংসে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ৪৯৩ রান।
জবাবে খেলতে নেমে টানা তৃতীয়বারের মতো ইনিংসের প্রথম ওভারেই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে শুরু করেন তামিম, বুঝিয়ে দেন চেপে বসতে দেবেন না বোলারদের। আগের ম্যাচের আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুরু থেকেই লঙ্কান বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকেন তিনি।
তামিমের সাবলীল ব্যাটিংয়ে সাহস পান প্রথম ম্যাচে ব্যর্থ হওয়া সাইফ হাসানও। দুজনের ইতিবাচক ব্যাটিংয়ে ১৩ ওভারেই চলে আসে জুটির ৫০ রান। যেখানে তামিমের অবদানই ছিল ৪১ রান। রান কম করলেও, প্রথম ম্যাচের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিং করছিলেন সাইফ।
রমেশ মেন্ডিসের করা ইনিংসের ১৫তম ওভারের প্রথম দুই বলে জোড়া বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ৪৯ রানে পৌঁছে যান তামিম। সেই ওভারের পঞ্চম বলে ১ রান নিয়ে পূরণ করেন ক্যারিয়ারের ৩১তম হাফসেঞ্চুরি। যেখানে ছিল ৮টি চারের। এটি তামিমের টানা চতুর্থ ইনিংসে হাফসেঞ্চুরির কীর্তি।
তবে তামিমের জন্য এটিই প্রথম টানা চার ইনিংসে ফিফটি নয়। ২০১০ সালে টানা পাঁচ ইনিংসে পঞ্চাশোর্ধ্ব রান করার নজির রয়েছে তামিমের। সেবার শেষের দুইটি ইনিংস ছিল সেঞ্চুরি। কিন্তু এবার চার ইনিংসের একটিকেও সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে পারলেন না তামিম।
যে ওভারে পঞ্চাশ পূরণ করেন তামিম, সেই ওভারের শেষ বলে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে লং অন দিয়ে ইনিংসের প্রথম ছক্কা হাঁকান সাইফ। পরের ওভারের প্রথম বলেই আবার বাউন্ডারি হাঁকান তামিম। অভিষিক্ত প্রবীণ জয়াবিক্রমার পরের ওভারে হাঁকান জোড়া চার।
উইকেটে টার্ন ও বাউন্সের দেখা মিললেও তাতে তামিমের ব্যাটিংয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। সাইফও খেলছিলেন আগের চেয়ে বেশি সাহস ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে। বিশেষ করে রমেশ মেন্ডিসের করা ২৩তম ওভারে অফসাইডে অসাধারণ দুইটি ড্রাইভ খেলেন সাইফ।
মনে হচ্ছিল উদ্বোধনী জুটি অবিচ্ছিন্ন থেকেই মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাবে বাংলাদেশ। কিন্তু বিধিবাম! বিরতির আগে দুই ওভারে সাজঘরের পথ ধরেন সাইফ ও নাজমুল হোসেন শান্ত। অভিষিক্ত জয়াবিক্রমের বলে সেকেন্ড স্লিপে ধরা পড়েন ২৫ রান করা সাইফ।
রমেশের করা পরের ওভারের শেষ বলে প্রথম স্লিপে ক্যাচ তুলে দেন নাজমুল শান্ত। প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ক্যারিয়ার সেরা ১৬৩ রানের পর টানা দুই ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হলেন শান্ত। টেস্ট ক্রিকেটে যা বিরল নজিরই বটে।
দিনের দ্বিতীয় সেশনে নতুন করে ইনিংস গড়ায় মনোযোগ দেন তামিম ও মুমিনুল। দুজন মিলে রান যেমন নিচ্ছিলেন নিয়মিত, তেমনি নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে বারবার মনে ভয় ঢোকাচ্ছিলেন জয়াবিক্রম ও রমেশ। যার ফল তারা পেয়ে যায় ৪৪তম ওভারে। তামিমের বিদায়ে ভাঙে ৫২ রানের তৃতীয় উইকেট জুটি।
সিরিজে আরও একবার নড়বড়ে নব্বইয়ের বৃত্তে আটকা পড়ে যান তামিম। টেস্ট ক্যারিয়ারের আগের ১১৯ ইনিংসে যেখানে মাত্র একবার আউট হয়েছিলেন নব্বইয়ের ঘরে, সেখানে গত তিন ইনিংসের দুইবার নব্বইয়ের ঘরে থামলেন দেশসেরা এ ওপেনার।
সিরিজে দ্বিতীয়বারের মতো সেঞ্চুরির কাছে গিয়েও খালি হাতেই ফিরতে হলো তাকে। দলীয় সংগ্রহ দেড়শ পেরুতেই তামিমের উইকেট তুলে নেন শ্রীলঙ্কার অভিষিক্ত বাঁহাতি ওপেনার প্রবীন জয়াবিক্রম।ইনিংসের ৪৪তম ওভারের দ্বিতীয় বলে প্রথম স্লিপে দাঁড়ানো দিমুথ করুনারাত্নের হাতে ধরা পড়েন তামিম।
আউট হওয়ার আগে ১২ চারের মারে ১৫০ বলে ৯২ রান করেছেন তিনি। অবশ্য এর আগে ব্যক্তিগত ৯১ ও ৯২ রানে শর্ট লেগের হাত থেকে জীবন পেয়েছিলেন তামিম। দুইবারই বোলার ছিলেন জয়াবিক্রম। শেষপর্যন্ত তিনিই তুলে নিয়েছেন তামিমের উইকেট।
দলীয় ১৫২ রানে তামিমের বিদায়ের পর জুটি বাঁধেন মুমিনুল ও মুশফিক। দুজন মিলে যোগ করেন ৬২ রান। ব্যাটিংয়ের শুরুতে একটি আউটসাইড এজ বাদ দিলে বাকি ইনিংসে দুর্দান্ত ব্যাটিং করেছেন মুশফিক। অপরপ্রান্তে থাকা মুমিনুলকে রীতিমতো দর্শক বানিয়ে ফেলেছিলেন মুশফিক।
তিনি যখন নামেন, তখন ৩০ রানে অপরাজিত ছিলেন মুমিনুল। এরপর মুমিনুল আর ৮ রান করতে করতে ৩৭ রান তুলে ফেলেন মুশফিক। সুইপ, রিভার্স সুইপ, ড্রাইভ আর পুলের সংমিশ্রণে দুর্দান্ত ইনিংসই খেলছিলেন মুশফিক। কিন্তু বিরতির আগের ওভারে জয়াবিক্রমের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে যান তিনি।
প্রথমে সেটিতে আউট দেননি আম্পায়ার। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সিদ্ধান্তটি রিভিউ করে শ্রীলঙ্কা। টিভি রিপ্লেতে জ্বলে ওঠে তিন লালবাতি, বিদায়ঘণ্টা বাজে ৪০ রান করা মুশফিকের, ভাঙে ৬২ রানের চতুর্থ উইকেট জুটি।
অন্যদিকে মুমিনুল আউট না হলেও, অন্তত তিনবার বেঁচে গেছেন সৌভাগ্যবশত। ব্যক্তিগত ১, ১১ ও ৩৬ রানে ক্যাচ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রথমবার স্কয়ার লেগে, পরেরবার শর্ট মিডউইকেটে ও শেষবার শর্ট লেগের ফিল্ডার তার ক্যাচ ধরতে পারেননি। যা বাঁচিয়েছে বাংলাদেশ অধিনায়কের উইকেট।
লিটন দাসের ওপর অনেক আস্থা এবং ভরসা টিম ম্যানেজমেন্টের। দলের মধ্যে নাকি সবচেয়ে টেকনিক্যাল ব্যাটসম্যান তিনি। কিন্তু মাত্র ১১ বল উইকেটে টিকে ছিলেন। জয়াবিক্রমার বলে স্লিপে ক্যাচটা দিয়ে ফিরে গেলেন তিনি মাত্র ৮ রান করে।
প্রতিষ্ঠিত সব ব্যাসম্যানই বিদায় নিলেন ২২৪ রানের মধ্যে। এরপর বোলারের কোটায় খেলতে নামা অলরাউন্ডার মিরাজ এবং তাইজুল জুটি বাঁধার চেষ্টা করেন। ১৭ রান অবিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন তারা। ১৬ রান করে সাজঘরের পথ দেখলেন মিরাজ, সেই জয়াবিক্রমার বলে।
তাসকিন আহমেদ ১১ বল খেলে কোনো রান করতে পারেননি। অবশেষে তিনিও বিদায় নেন জয়াবিক্রমার ৬ষ্ঠ শিকারে পরিণত হয়ে। অভিষিক্ত শরিফুল খেললেন আট বল, রান শূন্য। শেষ উইকেট হিসেবে লাকমালের বলে বিদায় নেন তাইজুল ইসলাম। তার নামের পাশে শোভা পাচ্ছিল ৯ রান।
তবে দুর্ভাগ্য তাইজুলের। সুরাঙ্গা লাকমালের বলে কভার পয়েন্টে ঠেলে দিতে গিয়ে নিজের ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেন। পরে দেখা গেলো তার জুতা গিয়ে আঘাত করেছে স্ট্যাম্পে। সুতরাং, হিট উইকেটে আউট হয়ে ফিরলেন তাইজুল।