প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার পাবে ৩৬ লাখ পরিবার

15

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত স্বল্প আয়ের গরিব মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে দেশের ৩৬ লাখ পরিবারকে দেয়া হবে নগদ সহায়তা। উপকারভোগীরা ঘরে বসেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঈদ উপহার। এর মধ্যে ৩৫ লাখ স্বল্প আয়ের পরিবার প্রতি ঈদ উপহার হিসেবে দেয়া হবে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ১ লাখ কৃষক পরিবার ৫ হাজার টাকা করে পাবেন। এ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস বিকাশ, নগদ এবং রকেটের মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। আগামী ২ মে রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে নগদ সহায়তা কার্যক্রম উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। এতে সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ৯৩০ কোটি টাকা। তালিকা অনুযায়ী, সবার মোবাইল নাম্বারে এই সহায়তা পাঠিয়ে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে সুবিধাভোগীদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে এবারের তালিকা ত্রুটিমুক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তালিকায় আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের ঢুকানো হলে এর দায় সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে। পুরো বিষয়টি বাস্তবায়নে নজর রাখছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অর্থবিভাগ।
জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবার ১ লাখ কৃষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নিম্ন আয়ের মানুষ কাজ হারিয়েছেন করোনার কারণে। প্রথম ধাক্কা সামলানোর আগে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় চাপের মুখে পড়েছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। এই বাস্তবতায় আবার সামনে ঈদ। এ কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে নগদ সহায়তা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর আগে গত বছর প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়ার কার্যক্রম চালু করা হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার, থানা নির্বাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসকদের দুর্নীতির কারণে সেই সময় সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা যায়নি। আর এ কারণে ৩৫ লাখ পরিবারের মাঝে ওই সময় টাকা বিতরণ করা সম্ভব হলেও ১৫ লাখ পরিবারকে বাইরে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ অসচ্ছল ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে সচ্ছল ব্যক্তিদের তালিকায় ঢুকিয়ে দেয়া। এছাড়া এক ব্যক্তির একাধিক মোবাইল ফোন নাম্বার ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে। এ কারণে এবার সঠিক তালিকা করার ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া গতবার যারা টাকা পেয়েছিলেন তারাও এবারের তালিকায় রয়েছেন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, থানা নির্বাহী অফিসার, স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের আরও সজাগ থাকার জন্য বলা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- তালিকায় ত্রুটিপূর্ণ না হলে দায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সরকারের ব্যয় হবে ৯৩০ কোটি টাকা ॥ ঈদের আগে নগদ সহায়তা এ কার্যক্রমের বাস্তবায়নে সরকারের ব্যয় হবে ৯৩০ কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের প্রায় ৩৫ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। এ ছাড়া সম্প্রতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ কৃষক পরিবার পাবে পাঁচ হাজার করে। এ জন্য সরকারের ৯৩০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছেন। ঝড়ো হাওয়া, শিলাবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ৩৬টি জেলার ৩০ লাখ ৯৪ হাজার ২৪৯ হেক্টর ফসলি জমির মধ্যে ১০ হাজার ৩০১ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ এবং ৫৯ হাজার ৩২৬ হেক্টর ফসলি জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফরের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এতে এক লাখ কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
কোভিড-১৯ এর ফলে কর্মহীন ও ক্ষতিগ্রস্ত এসব কৃষককে পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনার সুপারিশ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ বাবদ ৫০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা (নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার ও মুঠোফোন নাম্বার) করছে। অন্যদিকে বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে যাচাই-বাছাই করে প্রায় ৩৭ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থসহায়তা প্রদান করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১২ মে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জিটুপি পদ্ধতিতে নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেছিলেন। এবারের নগদ আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অর্থ বিভাগের বাজেটের অধীন ‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় তহবিলে’ বরাদ্দ করা অর্থ থেকে নির্বাহ করা হবে।
আগামী ২ মে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ॥ কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধকল্পে গত ১৪ এপ্রিল থেকে কাজ ও চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দিনমজুর, কৃষক, শ্রমিক, গৃহকর্মী, মোটর শ্রমিকসহ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের পুনরায় আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। তাদের তখন আড়াই হাজার করে টাকা দেয়ার সুপারিশ করা হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের ছয় লাখ পরিবার আগামী ২ মে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অনুদানের ২ হাজার ৫১৫ টাকা করে পাবে। এ অর্থ মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস বিকাশ, নগদ এবং রকেটের মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। এর আগে বুধবার অর্থ বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান খান স্বাক্ষরিত ছয় লাখ পরিবারের জন্য ১৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকার সরকারী ব্যয় মঞ্জুরির এক চিঠি চীফ এ্যাকাউন্টেন্ট বরাবর পাঠানো হয়েছে। ব্যয় মঞ্জুরির চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কর্মহীন দরিদ্রদের জন্য নগদ সহায়তা কার্যক্রম সম্পাদনের লক্ষ্যে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অর্থ বিভাগের অধীন ‘মুজিব শতবর্ষে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান’ শীর্ষক কোডের আওতায় ‘বিশেষ অনুদান’ খাতে ৭৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এ বরাদ্দ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের মোবাইল এ্যাকাউন্টে জনপ্রতি ২ হাজার ৫১৫ টাকা হারে দ্বিতীয় ধাপে ছয় লাখ পরিবারের অনুকূলে ১৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ের জন্য সরকারী মঞ্জুরি জ্ঞাপন করা হয়েছে। আগামী ২ মে থেকে ছয় লাখ পরিবারকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২ হাজার ৫১৫ টাকা করে পাঠানো শুরু হবে। এর বাইরে নতুন করে শুধু কৃষকদের জন্য ৫ হাজার টাকার অনুদানের যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি করা হচ্ছে। গত ৪ এপ্রিল বিভিন্ন জায়গায় শিলাবৃষ্টি, ঝড়ো হাওয়া, তাপপ্রবাহ ও ঘূর্ণিঝড়ে অনেকেরই ফসল ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ কৃষককে ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। এতে ব্যয় হবে ৫০ কোটি টাকা। কঠোর নজরদারিতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরাই নগদ সহায়তা পাবেন ॥ গত বছর ত্রুটিপূর্ণ তালিকার কারণে ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা দেয়া যায়নি। ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এবার এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারি করবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঈদ উপহারের নগদ অর্থ বরাদ্দ দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এজন্য যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থবিভাগ থেকে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এবার স্বল্প আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। করোনা থেকে জীবন বাঁচাতে লকডাউন দিতে হয়েছে।
জানা গেছে, গত অর্থবছরে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবার ও কাজ হারানো শ্রমিকদের সহায়তা দিতে তৈরি করা হয় ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার তহবিল। শুধু ৫০ লাখ পরিবারের জন্য বরাদ্দ ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৯১ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৬ লাখ ৭ হাজার ৮৭২ পরিবারের কাছে আড়াই হাজার করে টাকা পৌঁছানো গেছে। এর মধ্যে ১০১ কোটি টাকা ফেরত এসেছে। শেষ পর্যন্ত দেয়া হয়েছে ৮১১ কোটি টাকা। ৪৩৯ কোটি টাকা দিতে পারেনি সরকার। এ ছাড়া শ্রমিকদের প্যাকেজে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে সরকার দিতে পেরেছে ৫ কোটি টাকা। এই দুই তহবিল মিলিয়ে সরকারের কাছেই থেকে গেছে ১ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এক চিঠিতে অর্থ বিভাগকে জানিয়েছে, অর্থ পাঠানো হলেও ৪ লাখ ২ হাজার ১৬৮টি পরিবারের কাছে কোন টাকা পৌঁছায়নি। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে চলে যাওয়া ১০১ কোটি ১৫ লাখ টাকা পড়ে আছে বিকাশ, নগদ, রকেট, শিউর ক্যাশ এই চার মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের কাছে। তাদের কাছ থেকে টাকাগুলো ফেরত নিতে হবে। গত বছর ৫০ লাখ পরিবারের তালিকা তৈরি করেন জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা মিলে। অর্থ বিতরণ শুরু হওয়ার পর দেখা যায়, তালিকায় ঢুকে পড়েছেন তুলনামূলক সচ্ছল মানুষেরা। তবে এবার প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নগদ সহায়তা দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।