করোনার থাবা ॥ মনোযোগ দিতে হবে শ্রমিকদের প্রতি

7

মিলু শামস :

দেশে বিদেশে করোনা পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি ভয়াবহতার শিকার হচ্ছেন শ্রমিকরা। অভিবাসন খাতে এরই মধ্যে কাজ হারিয়েছেন আট লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার শ্রমিক। তারা দেশে ফিরে এসেছেন। ফেরার অপেক্ষায় আছেন আরও অনেকে। যারা ছুটিতে এসেছিলেন তারাও ফিরতে পারছেন না প্লেনের টিকেট, ফ্লাইট জটিলতা ইত্যাদির কারণে। প্রথম দফা লকডাউনের প্রকোপ একটু কমার পর কেউ কেউ কাজে যোগ দিলেও পরিস্থিতি আবার সঙ্কটময় হচ্ছে। করোনাপরবর্তী কেমন ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে তাদের জন্য? বিশেষ করে শ্রমিকদের প্রতি কেমন আচরণ হবে মালিক পক্ষের? বিষয়টি অনেককে ভাবাচ্ছে।
রাজনীতিবিদরা যত হাঁকডাক, গলাবাজি করেন না কেন, পরিবর্তনের চালিকা হিসেবে কাজ করা শ্রমজীবী শ্রেণীই ভেতর থেকে বদলায় দেশের অর্থনীতির চিত্র। দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস পোশাক শিল্প। শতকরা আশি ভাগের বেশি রফতানি আসে শুধু এই খাত থেকে। দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে যারা অবদান রাখছেন, তারা প্রবাসী শ্রমিক। সাতষট্টি লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন বিভিন্ন দেশে। তাদের পাঠানো আয়ের ওপর নির্ভর করে দেশে আর্থিক লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রয়েছে। অথচ শ্রমিকদের জীবনই এদেশে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন। স্বাস্থ্যহীনতার ঝুঁকি সঙ্গে রয়েছে মৃত্যুঝুঁঁকি। প্রবাসী শ্রমিকরাও যথেষ্ট নিরাপদ নন। যে সব দেশে তারা যান, সে সব দেশের আইনকানুন ভাল করে বুঝে চলার মতো শিক্ষা তাদের অনেকেরই থাকে না। যে জন্য প্রবাসে প্রায়ই বিপদে পড়তে হয় তাদের। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন ঝুঁকিমুক্ত না হলে সামনের সময়ে দেশের অর্থনীতি প্রবল ঝুঁকির মুখে পড়বে। একটি দেশের মূল শক্তি অর্থনৈতিক ভিত নড়ে গেলে পুরো দেশই নড়বড়ে হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়নকে যতই বলুক ‘দিস ইজ দ্য ক্রাকস অব দ্য সারপ্রাইজ’ কিংবা ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন) অথবা আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠান জেপি মরগানের ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’ বা এগিয়ে চলা পাঁচ দেশের একটি ‘বাংলাদেশ’ বলার মূল ভিত্তি শ্রমিকরা। করোনার আগে অর্থনৈতিক উন্নতির যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তার প্রায় পুরোটাই ছিল শ্রমিকদের অবদান। এই সত্যটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। ভুলে যান সবচেয়ে বেশি শিল্প উদ্যোক্তারা। তারা সহানুভূতিশীল হলে শ্রমিকরা ন্যূনতম সুবিধা নিয়ে জীবনযাপন করতে পারেন। শ্রমিকদের মানবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করতে পারলে চূড়ান্ত অর্থে লাভবান হবে গোটা ইন্ডাস্ট্রি।
বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার ভয়াবহ অবকাঠামো ও মালিক পক্ষের হঠকারিতার কথা আমাদের মনে আছে। ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই সঙ্কেত বাজে। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরোতে চাইলে আগুন নেভানোর মহড়া চলছে জানিয়ে শ্রমিকদের কাজ করার নির্দেশ দিয়ে কলাপসিবল গেটে তালা লাগায় দায়িত্বে থাকা লোকজন। আগুন ছড়িয়ে গেলে ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে সরু সিঁড়ি বেয়ে শ্রমিকরা নিচে নামেন। কিন্তু একটু পরে বুঝতে পারেন মুক্তির পথ ভেবে তারা আসলে এগিয়েছেন মৃত্যু ফাঁদের দিকে। ভেতরের দরজা-জানালাবিহীন গুদাম ঘর তখন আগুনের কু-লীতে ভরা। আর তাতে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে এক শ’ এক কিংবা তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রমিককে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারী দেশ হয়েও দেশের শ্রমিকদের এখনও উদ্যোক্তাতার উদাসীনতায় জীবিত দগ্ধ হতে হয়। করোনাপরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা তাই ঘনীভূত হয়।
গত শতকের সত্তর দশকের শেষ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শতভাগ রফতানিমুখী ‘দেশ গার্মেন্টস’। উদ্যোক্তা নুরুল কাদির খান গার্মেন্টস পরিচালনায় সহায়তা নিয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ো কর্পোরেশন থেকে। প্রথম পদক্ষেপের মাত্র তিন বছর পর গার্মেন্টসের সংখ্যা দাঁড়ায় সাতচল্লিশটিতে। পরের তিন বছরে তা দ্রুত বেড়ে হয় পাঁচ শ’ সাতাশটি। তিরাশি-চুরাশি সালে পোশাক রফতানি করে আয় হয়েছিল নব্বই কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার এখন দু’হাজার কোটির ঘর ছাড়িয়েছে। উদ্যোক্তার সংখ্যাও স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাড়েনি শুধু শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান। সন্তুষ্টচিত্তে না হলেও নির্ধারিত বেতন মেনে নিয়েই কাজ করছেন তারা। কিন্তু কোটি কোটি ডলার আয় করা মালিকরা তাদের জীবনের নিরাপত্তাটুকু দিতে পারেন না। মাত্র তিন দশকের কিছু বেশি সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পাওয়া একটি শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের আরও বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। যাদের ওপর নির্ভর করে এমন ফুলে-ফেঁপে ওঠা, শোষণের সূত্র মেনেই না হয় সেই শ্রমিকদের প্রতি মনোযোগী হলেন তারা। শেষ বিচারে তাতে তাদেরই লাভ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা চীনের পাশাপাশি এখন বাংলাদেশের দিকে চোখ রাখছেন। দক্ষ ও সস্তায় প্রচুর শ্রমিক পাওয়া যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনার যে দ্বার অবারিত তা যেন অব্যাহত থাকে সেদিকে সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি রাখতে হবে। সে জন্য অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দূর করার পাশাপাশি শ্রমিকদের সুবিধা দেখা শুধু জরুরী নয় অবশ্য করণীয়।
কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তার ওপর মহামারীর ছোবল সামলানো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হলেও মালিক পক্ষের সহানুভূতিশীল মানসিকতা একে সহজ করে তুলতে পারে। গত এক দশকে নিহতের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবহেলাজনিত দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না করা, শ্রমিকদের নামমাত্র ক্ষতিপূরণ, আগে ঘটে যাওয়া বড় দুর্ঘটনাগুলোর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও শাস্তি নিশ্চিত না করা, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও আইন অনুযায়ী কারখানা তৈরি না হওয়া ইত্যাদি।
বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার যে ইতিবাচক সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, তার গতি স্বচ্ছ রাখতে দেশের ভিত্তি যারা মজবুত করছেন তাদেরও সুস্থ ও সবল রাখতে হবে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এরাই বড় অংশ। বাকি মধ্যবিত্ত অংশ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। শিক্ষিত বিকশিত মেধাবী প্রজন্মের পক্ষেই রাজনীতি ও অর্থনীতির দুষ্টচক্র থেকে দেশকে বের করে আনা সম্ভব। তাদের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণীর চেতনার স্তরও বাড়বে। এই দুদিকের ভারসাম্য নিপুণভাবে ধরতে পারলে করোনা মোকাবেলা করেও দেশ সত্যিই সমৃদ্ধির পথে এগোবে।