ড. সাজ্জাদ হোসেন :
করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় পর্যুদস্ত সারা পৃথিবী। এই দুঃসময়ে আমাদের আশাহত না হয়ে সকলেরই উচিত সহনশীলতার সঙ্গে বিপদের মোকাবেলা করা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো/এ নহে মোর প্রার্থনা,/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
আমরা জাতি হিসেবে লড়াকু এবং দল-মত নির্বিশেষে এক হয়ে যে কোন কঠিন বিপদের মোকাবেলা করতে পারি। আমরা সকল বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারি। মহান মুক্তিযুদ্ধই আমাদের গর্বের অনুপ্রেরণা। ১৯৭১ সালে আমাদের ছিল না আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র, পর্যাপ্ত ট্রেনিং আর প্রস্তুতি। তারপরও আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…. ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা অর্জন করি কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কেউ ধর্ম, বর্ণ বা গোত্রভেদে যুদ্ধ করেনি, সকলেই এক জোট হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরও কিন্তু বিপদ শেষ হয়ে যায়নি। পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী দেশের অনেক ক্ষতি করে দিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধ পরবর্তী নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলা সহজ ছিল না। তবুও আমরা দমে যাইনি। কারণ আমাদের দেশকে নতুনভাবে গড়ার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের দিন ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও একবার বাঙালী জাতিকে তাঁর বক্তব্যে নতুনভাবে দেশ গড়ার দিকনির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ‘টাকা নাই, পয়সা নাই, চাল নাই, ডাল নাই, রাস্তা নাই, রেলওয়ে ভেঙ্গে দিয়ে গেছে, ফেরাউনের দল, সব শেষ করে দিয়ে গেছে। কিন্তু আছে আমার মানুষের একতা আছে তাদের ইমান, আছে তাদের শক্তি। এই মনুষ্যশক্তি নিয়ে বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলতে চাই ……এই এক বছর তোমাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ করে আমার দেশের গঠনমূলক কাজে তোমাদের আত্মনিয়োগ করতে হবে। তোমরা করবা ? … আমি জানি তোমরা করবা। যখন আমি ছিলাম না তখন যেহেতু তোমরা আমার কথামত করেছ, তোমরা নিশ্চয়ই করবা। এ বিশ্বাস না থাকলে আমি বাঁচতে পারতাম না।’ যুদ্ধ পরবর্তী কঠিন সময়ে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বাঙালী জাতিকে নতুনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে। তার ফলশ্রুতিতেই আজকের এই বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের জাতির পিতার বিশ্বাস তখনও ছিল তাঁর দেশের মানুষের প্রতি। এখনও সেই বিশ্বাসের বলেই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালী জাতি সব বাধা ডিঙ্গিয়ে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলছে। সব বাধার মতোই করোনা নামক এই শত্রুর মোকাবেলা করতে আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
করোনাকালীন দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন সকল পেশার মানুষের সহযোগিতা। বর্তমান পরিস্থিতে যেখানে দৈনিক করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রায় ’শ খানেক মানুষ মারা যাচ্ছে আর হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এই মারণ ভাইরাসে, সেখানে ধৈর্যের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার বিকল্প নেই। সরকার মানুষের জীবন বাঁচিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে লকডাউনের পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা এবং অনুদান দিয়েছে। ২৫০০ টাকা করে ৩৪ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। আমাদের ডাক্তার, নার্স, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ব্যাংকার ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সম্মুখ সারির যোদ্ধার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। এরকম পরিস্থিতিতে একজন অপরজনকে দোষারোপ করা খুব সহজ, কিন্তু এই বিপদে আমরা সহনশীলতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ না করলে আরও বিপদে গভীরভাবে ডুবে যাব। করোনা একটি মহাযুদ্ধ থেকে কম নয়। যুদ্ধে যেমন লড়াই এবং শত্রুর মোকাবেলা করে জিততে হয়, তেমনি সব পেশার মানুষকে একজোট হয়েই এই দুঃসময়ে কাজ করতে হবে। ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতি নিজেদের জীবন বাজি রেখে একটি মাত্র লক্ষ্যে জাতির পিতার নেতৃত্বে যুদ্ধ করে শত্রুদের পরাস্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। এখন আমরা আরেকটি যুদ্ধে আছি। মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করে নিজের দেশের মানুষের কথা, নিজের দেশের উন্নতির কথাই ভাবতে হবে সবার আগে। তাহলেই এ যুদ্ধ জয় সম্ভব।
যেখানে বৈশ্বিক অর্থনীতি নাজুক পরিস্থিতিতে সেখানে করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে। তার প্রমাণ মেলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করলেই। ওয়াশিংটনভিত্তিক কনজারভেটিভ থিংক ট্যাঙ্ক দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের তালিকা অনুযায়ী অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশেরই স্কোর কমেছে এ বছরের সূচকে। ২০২০ সালের জুলাই-এ প্রবাসীরা প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলার দেশে প্রেরণ করে যা কিনা ২০১৯-এর জুলাই-এ প্রেরণ করা রেমিটেন্সের মোট পরিমাণ থেকে ১ বিলিয়ন বেশি। গার্মেন্টস খাতেও প্রবৃদ্ধির হার ২০২০ সালের আগস্টে পূর্বের বছরের তুলনায় প্রায় ২.৫৮% বেশি দেখা যায়। সারা বিশ্বের অর্থনীতি যখন করোনার থাবায় ক্ষতবিক্ষত সেই সময়ে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান জিডিপি ধরে রেখেছে। ঞযব ঈবহঃবৎ ভড়ৎ ঊপড়হড়সরপং ধহফ ইঁংরহবংং জবংবধৎপয (ঈঊইজ) ডিসেম্বর ২০২০-এ একটি রিপোর্টে উল্লেখ করে যে, ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের ভেতরে বাংলাদেশের জিডিপি গড়ে ৬.৮% বৃদ্ধি পাবে। ঈঊইজ-এর তথ্যমতে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বিশ্বে ২৮তম দেশ হিসেবে অবস্থান করবে। শুধু তাই নয়, ঞযব টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঈড়সসরঃঃবব ভড়ৎ উবাবষড়ঢ়সবহঃ চড়ষরপু (টঘঈউচ) ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশকে বর্তমানে স্বল্প উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করার সুপারিশ প্রদান করেছে। এটা বাঙালী জাতির জন্য একটি গর্বের বিষয়। এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণে। এই করোনার প্রাদুর্ভাবেও দেশে খাদ্যের অভাব এখন পর্যন্ত দেখা দেয়নি। এই দুঃসময়ে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়ে যেমন বেকার হয়েছে ঠিক তেমনি অনেক মানুষই পুনরায় চাকরি পেয়েও গেছে। পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজও এগিয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুফল পাচ্ছে সবাই। শিক্ষার্থীগণ অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছে। যার ফলে তারা অনেক ক্ষেত্রেই লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পেরেছে। করোনাকালীন অনলাইনভিত্তিক অনেক উদ্যোক্তাও বেড়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন করোনার থাবায় দারুণভাবে বিপর্যস্ত সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনেকটাই সফলভাবে এই বিপদ মোকাবেলা করে যাচ্ছে। করোনার ভ্যাকসিন সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যা অনেক উন্নত দেশে এখনও পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানে সকল ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে একত্রে বসবাস করে। ধর্মীয় উগ্রবাদের কোন স্থান নেই এদেশে। তবুও কিছু সংখ্যক মানুষ ধর্মকে পুঁজি করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য দেশে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করার গভীর ষড়যন্ত্র করছে। আমরা দেখেছি হেফাজতে ইসলামি দলটির কিছু বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালিয়েছে। জাতির পিতার ম্যুরালসহ সরকারী স্থাপনা ভাংচুর করেছে। এ অপকর্মের জন্য তাদের গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিছু কুচক্রী দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের এই উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে ব্যবহার করছে। করোনার ভ্যাকসিন সম্পর্কে নানা গুজব ছড়াচ্ছে। অসাধু চক্র থেমে নেই। দেশের শান্তি ভঙ্গ করার জন্য প্রতিনিয়তই মিথ্যা-অপপ্রচার করে যাচ্ছে তারা। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর পিতার মতোই সমস্ত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে নির্ভীকভাবে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আমাদেরও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সজাগ থাকতে হবে।
করোনা একটি মহাপ্রলয়ের নাম, যা সারা বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। উন্নত দেশগুলও এই প্রলয়ের কাছে কুপোকাত। বাংলাদেশকে এই অতিমারী মোকাবেলায় সবাইকে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। নয়ত এই যুদ্ধে আমরা জিততে পারব না। যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। করোনার কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে, হয়ত আরও হবে, কিন্তু আমাদের ধৈর্যের সঙ্গে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। করোনাকালে উপনীত মুজিব জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের আরও একবার মুক্তিযুদ্ধের দৃপ্ত শপথে উজ্জীবিত হয়ে এ বিপদ মোকাবেলা করতে হবে। আমরা ভাগ্যবান আমাদের বঙ্গবন্ধুকন্যার মতো একজন মমতাময়ী এবং দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী আছেন। তাঁর ওপর আমাদের ভরসা রাখতে হবে। বিপদ একদিন কেটে যাবেই। ইংরেজ কবি শেলীর ভাষায় If Winter comes, can Spring be far behind?
স্বাধীনতাবিরোধী, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে নির্মূল করেই অদম্য বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে। এখন রেষারেষি-হিংসার সময় নয়, মানবিকবোধে জাগ্রত হবার সময়। তাই সবাইকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আধুনিক সোনার বাংলা গড়তে দেশের স্বার্থে মহান মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র বুকে ধারণ করে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)।