জোবায়ের জুবেল :
ফারুক সাহেব। প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বছর দশেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন। এলাকার স্বনামধন্য সম্মানী ব্যক্তি। উচ্চ শিক্ষিত হলেও গ্রাম এবং গ্রামের মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাকে গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয় নি। যদিও চাইলেই শহরে ভালো চাকরি নিতে পারতেন। সংসারে তার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। ছেলের নাম রাজু এবং মেয়ের নাম মিলি। সুযোগ পেলেই তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেন তিনি। বাইরে ঘুরতে নিয়ে যান এবং আনন্দে আনন্দে জ্ঞান দান করেন। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে ছেলেকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যেন তার একটা রুটিন। তো এ সপ্তাহে বাবা-ছেলের শহরে যাওয়া এবং ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত হল। তিনি ছেলেকে বললেন, যেকোন সময় যেকোন জায়গায় যেতে হলে তোমার যা যা প্রয়োজন, তার একটা লিস্ট করে নিবে এবং যাওয়ার সময় দেখবে সবকিছু ঠিকঠাক মতো নিয়ে যাচ্ছ কি না। সেটা বেড়ানো বা পরীক্ষা যাই হোক না কেন। আজ সেই শুক্রবার। রাজুর যেন তর সইছে না। জুমার নামাজের পর বাবা-ছেলে বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করলেন এবং শহরে যাওয়ার ট্রেন ধরতে রওনা হলেন। নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন আসার পর মানুষ হুড়োহুড়ি শুরু করে দিল। ফারুক সাহেব ছেলেকে এরকম করতে বারণ করলেন আর বললেন, আগে নামতে দিবে পরে তুমি উঠবে এবং অপরিচিত মানুষের দেয়া কোন কিছু কখনোই খাবে না। সে মাথা নাড়িয়ে বাবার কথায় সায় দেয়। তারপর ট্রেনে উঠে নিজেদের সিটে বসে। কিছুক্ষণ পর ট্রেন যাত্রা শুরু করার জন্য হুইসেল দেয়। আচমকা তীব্র আওয়াজ শুনে রাজু কেঁপে উঠে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বাবাকে। ফারুক সাহেব বুঝালেন ভয়ের কিছু নেই, ট্রেন যাত্রা শুরু করবে তাই হুইসেল দিয়েছে। বাবার কথা শুনে প্রাণ ফিরে পায় সে। কিছুদুর যাওয়ার পর ট্রেন একটি জায়গায় স্টপেজ দেয়। ফারুক সাহেব রাজুকে স্টপেজের নিয়ম-নীতিও বুঝিয়ে দিলেন এবং সবুজ পতাকায় ট্রেনের আবার চলা শুরু হওয়াটাও দেখালেন। প্রায় দেড় ঘন্টার যাত্রা শেষে তারা গন্তব্যে এসে পৌঁছান। শহরের এত কর্মব্যস্ততা, কর্মব্যস্ত মানুষ এবং বড় বড় দালান দেখে শিউরে উঠে সে। বিশাল মানুষের জনসমাগম আর লাল-নীল বাতির দিকে তাকাতে থাকে। ফারুক সাহেব তাকে নিয়ে প্রথমে একটি হোটেলে ঢুকলেন। খাওয়ার আগে হাতমুখ ঠিকমতো ধুয়ে নিতে নির্দেশ দিলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাবা-ছেলে শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়লেন। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম দেখা দিল।সারি সারি গাড়ির লাইন। তিনি বলে উঠলেন, রাজু ঐ যে দেখছো লাল বাতি জ্বলছে, যখন ওটা জ্বলবে তখন তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে, সামনে অগ্রসর হতে পারবে না এবং যখন সবুজ বাতিটা জ্বলবে তখন তুমি চলা শুরু করবে। আর হ্যা, ঐ যে একজন পুলিশের পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে লাঠি আর বাঁশি নিয়ে; তিনি হচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশ। তারপর তারা পার্কে ঘুরতে গেলেন। পার্কে ঘুরতে হলে টিকিট কাটতে হয়। কিভাবে কাটতে হয় ফারুক সাহেব তাকে সবকিছু দেখিয়ে দিলেন। শুরু হলো রাজুর নাচানাচি। এটা ধরে ওটা ধরে। কি যে আনন্দ, বলার বাইরে। পার্ক থেকে বের হয়ে তারা সোজা চলে গেলেন চিড়িয়াখানায়। সেখানের বাঘ-সিংহ দেখেতো তার ভয়ে চুপসে যাওয়ার অবস্থা। ফারুক সাহেব অভয় দিলেন। বাবার হাত ধরে ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখে সে আর বোন টাকে খুব মিস করে। ফেরার পথে ফারুক সাহেব রাস্তার পাশের ওভারব্রিজ ব্যাবহার করলেন এবং যেখানে ওভারব্রিজ থাকবে সেখানে রাস্তা দিয়ে পারাপার না হওয়ার জন্য রাজুকে সাবধান করে দিলেন। খানিক দূরে পথশিশুদের দল ঘুরাফেরা করছিল। তাদের দুঃখের কথাও ছেলেকে কিছুটা শোনালেন তিনি। রাস্তার পাশে বিভিন্ন জায়গায় ময়লার স্তুপ পড়ে থাকতে দেখে কখনোই এরকম না করতে বোঝালেন। হঠাৎ একটা পোস্ট বক্স লক্ষ করা গেল। পোস্টবক্সের মাধ্যমে কিভাবে বিভিন্ন জায়গায় চিঠি-পত্র পাঠানো হয় রাজুকে তার ফিরিস্তিও শুনালেন তিনি। বুঝলে রাজু? মানুষজন এখানে এসে তাদের নির্দিষ্ট চিঠি ফেলে যায় এবং পরে তা পোস্ট অফিসে নিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে পিওনের মাধ্যমে যথাস্থানে পাঠানো হয়। রাজু বাবার দিকে হা করে তাকিয়ে মন দিয়ে শুনতে থাকে । শুরু হল ফিরতি ট্রেন ধরার জন্য স্টেশন যাওয়ার পালা। স্টেশন থেকে বাড়ি আসা পর্যন্ত ফারুক সাহেব যেভাবে বলে দিয়েছিলেন রাজু ঠিক সেইভাবেই সবকিছু পালন করে।কাজেই, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রত্যেকটি সন্তানকেই যদি তার অভিভাবকরা শিশুকাল থেকে সঠিকভাবে গড়ে তুলেন তাহলে সবাই হয়ে উঠবে দেশের এক একটি সম্পদ। কেউ বোঝা হবে না। সমাজে অন্যায়, সন্ত্রাসবাদ বলতে কিছুই থাকবে না।