মোঃ আব্দুল মালিক :
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের অজপাড়াগা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের কোল আলোকিত করে যে শিশুপুত্র জন্ম নিলেন, মা-বাবা আদর করে ডাকলেন খোকা। নানা আদরের নাতির নাম রাখলেন মুজিবুর রহমান। বংশীয় উপাধি ‘শেখ’ যোগ করে পুরো নাম হলো শেখ মুজিবুর রহমান। মহাকালের অমোঘ নিয়মে সেই খোকা বা মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি সকল ভালো কাজে উৎসাহী ছিলেন। অন্যায়-অনিয়মের প্রতিবাদী ছিলেন। তাঁর নামের মধ্যেই চরিত্রের এই গুণাবলী লুকায়িত ছিল। ‘শেখ’ অর্থ ‘সম্মানিত’, ‘মুজিব’ অর্থ ‘সাড়াদানকারী’, ‘রহমান’ অর্থ ‘দয়াময়’। পুরো নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘সম্মানিত দয়াময় আল্লাহর ডাকে সাড়াদানকারী’। সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি মানুষের ডাকে সাড়া দিত শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হতে থাকে। তাই পাড়া-পড়শী, সতীর্থ, সহপাঠী কেউ ডাকেন মিয়া ভাই, কেউ ডাকেন মুজিব ভাই বলে। রাজনীতিতে শেখ মুজিব প্রথমে স্বদেশী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। তারপর পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তান আন্দোলনের সফল সমাপ্তির পর তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সমাবেশে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমদ, বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ পল্টনের জনসভায় ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আব্দুর রব বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা উপাধিতে ভূষিত করেন। ২০০৪ সালে বিশ^খ্যাত আর্ন্তজাতিক সংবাদ সংস্থা বৃটিশ ব্রড কাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) মাসব্যাপী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ বাঙালি নির্বাচন শুরু করে। সেই নির্বাচনে বাঙালিরা সর্বাধিক ভোট দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত করেন।
বাঙালি জাতি শেখ মুজিবুর রহমানকে একে একে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি উপাধিতে ভূষিত করলেন। প্রশ্ন হলো তিনি বাঙালি জাতির জন্য কী করেছেন ? কী রেখে গেছেন ? হ্যাঁ তিনি বাঙালি জাতির জন্য অনেক করেছেন। তিনি যা করেছেন তাঁর আগে বা পরে কোন বাঙালি তা করতে পারেন নি। সংক্ষেপে এগুলো হচ্ছেÑ
১) বঙ্গবন্ধু ৭ম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় সুভাষ বোসের স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়ে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এক পর্যায়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট বৃটিশরা এদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
২) ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ও বাণিজ্য মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে এলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সাহসিকতা ও নেতৃত্বগুণে-নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরই সূত্রধরে তিনি পরবর্তীকালে কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে দেখা করে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় নেতা-কর্মী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করেও মানুষের নিরাপত্তার জন্য কাজ করেছেন। তাঁর কাছে হিন্দু-মুসলিম কোন ভেদাভেদ ছিল না। তাইতো তিনি অহিংসবাদী নেতা মাহাত্মাগান্ধীর সঙ্গে দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় গিয়েছেন নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষকে সাহায্য করার জন্য। পাকিস্তান আন্দোলনের সফল সমাপ্তির পর তিনি স্বাধীন পাকিস্তানে আসেন।
৩) শেখ মুজিব মনে প্রাণে পাকিস্তান আন্দোলন করলেও বুঝতে পারেন বৃটিশ ভারতে হিন্দুরা যেভাবে মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার দিতে রাজী ছিল না, তেমনিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ন্যায্য অধিকার দিবে না। তাই তিনি বাঙালিকে সচেতন করার জন্য, নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য প্রথমে যুবলীগ ও পরে ছাত্রলীগ গঠন করেন। পশ্চিমারা প্রথমেই আমাদের ভাষার উপর আক্রমন করে। জিন্নার ঘোষনার পর না না ধ্বনি দিয়ে শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন এবং ছাত্রলীগকে দিয়েও আন্দোলন করালেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলে থেকেও ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেলে বসে অনশন করেছেন। জীবনের বিনিময়ে বাংলা ভাষা পাকিস্তানী শকুনিদের হাত থেকে রক্ষা পেল, দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেল। বাঙালিরা ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করতে থাকেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ মুজিব সর্বকনিষ্ট মন্ত্রী হয়েও বাংলা ভাষার উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখেন। তারপর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৪ সালে অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে তিনি বাংলা ভাষাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেন। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে আমাদের একুশ হয়ে গেল বিশে^র একুশ। এটি বিশে^ বাংলাদেশ ও বাঙালির মর্যাদা বহুগুণে-বৃদ্ধি করেছে। এর ভিত্তি রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৪) পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক নীতি যখন কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না তখন ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালি জাতির ম্যাগনাকার্টা ৬ দফা দিলেন। এই ছয় দফার অপরাধে মামলার পর মামলা দিয়ে বছরের পর বছর জেলে রেখেও যখন জান্তা সরকার তাঁকে তাঁর দাবী থেকে সরাতে পারলোনা তখন তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে বিচারের নামে ফাঁসিকাষ্ঠে-ঝোলানোর বন্দোবস্ত করে। তথাপিও তিনি আপোষ করেন নি। এমনকী গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য সরকার তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিতে চাইলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর আইয়ুব সরকার তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালির আত্মবিশ^াস বহুগুণ বেড়ে যায়। এই আত্মবিশ^াসের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াস রেখে তিনি ‘এফএলও’ এর তোয়াক্কা না করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন।
৫) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভের পর পশ্চিম পাকিস্তানীরা যখন ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যান। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে তিনি রেসকোর্স ময়দানে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দশলক্ষাধিক জনতার সামনে তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ট ভাষণটি দান করেছিলেন। এই ভাষণে তিনি পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাঙালি জাতিকে প্রয়োজনীয় সকল নির্দেশনা দিয়ে দেন। কিন্তু সেজন্য কেউ তাঁকে দায়ী করতে পারে নাই। এই ভাষণ বাঙালি জাতিকে এতোটা উজ্জীবিত করেছিল যে, পরবর্তীতে তাঁর অনুপস্থিতিতে ৩০ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়ে, কয়েক লক্ষ মা-বোন ইজ্জত দিয়ে মাত্র ৮ মাস ২০ দিনে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। ঐতিহাসিকদের মতে বাঙালি জাতির ইতিহাস আড়াই/তিন হাজার বছরের পুরাতন ইতিহাস। এই দীর্ঘ সময়ে বাঙালিরা কখনো স্বাধীন ছিলো না, শাসক ছিলো না, ছিলো শাসিত। রবীঠাকুর লিখেছেন, ‘সাতকোটি বাঙালিরে হেমুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাঙালি জাতিকে বিশে^র দরবারে একখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, একটি জাতীয় পতাকা, একটি জাতীয় সংগীতের গর্বিত মালিকানা উপহার দিয়ে মানুষের মর্যাদায় উন্মীত করেন। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে অচিরেই উন্নত দেশের মর্যাদা পাবে ইনশাআল্লাহ।
২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের জাতীয় সংগীতের তুলনামূলক বিচারে দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার ভাষ্যমতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বিশে^র দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। বাঙালি জাতি আজ সর্বক্ষেত্রে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। আমরা ছিলাম তালাবিহীন ঝুড়ি এখন হয়েছি উন্নয়নশীল দেশ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ‘বিশ^ ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংস্থাটির মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’ এ অর্ন্তভূক্ত করেছে। এর ফলে বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ স্বাধীনের প্রেরণাকারী ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ^ব্যাপী মানবজাতির মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত হলো। স্বাধীনতার জন্য আত্মৎসর্গকৃত ৩০ লক্ষ শহীদ আর সম্ভ্রম হারানো কয়েক লাখ মা-বোন সহ বাঙালি জাতির জন্য এটি এক মহা আনন্দ ও বিরল সম্মানের ঘটনা। যা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে আমরা পেয়েছি।
৬) ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে যখন পশ্চিম পাকিস্তানীরা অতর্কিতে বাঙালি জাতির উপর ঝাঁিপয়ে পড়ে, নির্বিচারে গণহত্যা করতে থাকে তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াস এবং বাঙালি জাতির উপর ভরসা করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাঙালি জাতি তাঁরই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অতি অল্প সময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। বাঙালি জাতি মহান এই মুক্তিযোদ্ধে ৩টি বিশ^রেকর্ড সৃষ্টি করে। রেকর্ডগুলো হচ্ছে-
১) বিশে^র বহুজাতি যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু মাত্র ৮ মাস ২০ দিনের যুদ্ধে আর কোন জাতি স্বাধীনতা লাভ করতে পারে নি। এই গৌরব একমাত্র বাঙালি জাতির।
২) বিশে^র ইতিহাসে বহুযুদ্ধে বহু জেনারেল পরাজিত হয়েছে, আত্মসমর্পণ করেছে কিন্তু তিরানব্বই হাজার নিয়মিত সৈন্য নিয়ে কোন জেনারেল আজ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেনি। টাইগার নিয়াজীকে তিরানব্বই হাজার সৈন্য সহ আত্মসমর্পনে বাধ্য করে, বাঙালি জাতি যে বিশ^ রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল তা আজো কেউ ভাঙ্গতে পারে নি।
৩) দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে হিটলারের নাৎসীবাহিনী বিশে^র বুক থেকে ইহুদি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নির্বিচারে ইহুদী নারী, শিশু, বৃদ্ধকে হত্যা করতে থাকে। তারপরও মাত্র ৮ মাস ২০ দিনে পাকিস্তানীরা ৩০ লক্ষ বাঙালিকে শহীদ করে কয়েক লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করে যে বিশ^রেকর্ড সৃষ্টি করেছে সেই রেকর্ড নাৎসী বাহিনীও করতে পারে নি। এরকম আত্মত্যাগ বিশে^ একমাত্র বাঙালিরাই করেছেন। আর এসবের মূলে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী শক্তি ও আত্মত্যাগের প্রেরণা।
৮) বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জন্য রেখে গেছেন তাঁর জীবনাদর্শ। তাঁর জীবনাদর্শ কী ছিল ? তাঁর জীবনাদর্শ ছিল-
১) অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়া।
২) অন্যায়ের কাছে মাথানত না করা।
৩) ভয়ে পালিয়ে না যাওয়া।
৪) অকপটে সত্য স্বীকার করা।
৫) আত্মসম্মান বজায় রাখা।
৬) লোভ না করা।
৭) জাতিকে ভালোবাসা।
৮) মানুষের উপর আস্থা ও বিশ^াস স্থাপন।
৯) নিজের ও পরিবারের চিন্তা না করা।
১০। মহান স্রষ্টার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াস স্থাপন।
১) অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়া : বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই অধিকার সচেতন। তিনি যখন মাত্র সপ্তম শ্রেণির ছাত্র তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও বাণিজ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে এলে তরুণ শেখ মুজিব তাঁদের পথ আগলে স্কুলের হোস্টেলের ছাদের সমস্যার বিষয়টি উত্থাপন করেন। তারপর তিনি স্বদেশী আন্দোলনে যোগদেন ভারতবাসীর অধিকার আদায়ের জন্য। যখন মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নটি সামনে চলে আসলো তখন তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগদেন। পাকিস্তান আন্দোলনের সফল সমাপ্তির পর তিনি যখন দেখলেন বাঙালিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তখন তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ে আজীবন সংগ্রাম করে বাঙালি জাতির পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে তিনি বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন।
২) অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করাঃ অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার আদর্শ তিনি সেই ছোট বেলা থেকেই লালন করে আসছেন। তাঁর বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি অনিয়ম করলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। একে কেন্দ্র করেই মূলত তিনি জীবনের প্রথম জেল খাটেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তাঁকে যখন মুচলেকা ও জরিমানা দিতে বলা হয়, তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে স্বেচ্ছায় বহিস্কারাদেশ মেনে নেন। তবুও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেন নি। তিনি ফিলিস্তিনি মুসলমানদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন যখন প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানরা চুপ করে বসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,‘ আমার অবস্থা যদি চিলির আলেন্দের মতো হয় তবুও আমি সাম্রাজ্যবাদীর কাছে মাথা নত করবনা।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘বিশ^ আজ দুই শিবিরে বিভক্ত শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’
৩) ভয়ে পালিয়ে না যাওয়া : ভয়ে পালিয়ে না যাওয়ার আদর্শ বঙ্গবন্ধু সেই ছোট বেলায়ই অর্জন করেন। হিন্দুদের সাথে মারামারি করার জন্য প্রভাবশালী হিন্দু নেতারা যখন তাঁর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। পুলিশ তাঁকে ধরে নিতে এসে, পালিয়ে যাবার সুযোগ দিয়েছিল কিন্তু তিনি পালিয়ে যান নি। এইভাবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ইচ্ছা করলে আত্মগোপনে যেতে পারতেন কিন্তু তিনি প্রাণের ভয়ে আত্মোগোপনে বা পালিয়ে যান নি। অথচ সৈনিক মেজর জিয়া ২৭ শে মার্চের প্রথম প্রহরে শত্রুর কোন হুমকি ছাড়াই চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে তার বাহিনী নিয়ে পটিয়ার দিকে পালিয়ে যান।
৪) অকপটে সত্য স্বীকার করা : বঙ্গবন্ধু যা সত্য তা অকপটে স্বীকার করতেন, কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতেন না। হিন্দু ছেলেদের সাথে মারামারির বিষয়টি বাবা শেখ লুৎফর রহমান যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন তখন তিনি চুপ থেকে বাবাকে বুঝাতে চাইলেন হ্যাঁ মারামারি করেছি। এভাবে তিনি যখন স্বাধীন বাংলাদেশের কর্ণধার তখন বললেন, ‘মানুষ পায় স্বর্ণের খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ আমার সামনে চোর, ডানে চোর, বামে চোর, পিছনে চোর, এভাবে তিনি সারাজীবন অকপটে সত্য স্বীকার করে গেছেন।
৫) আত্মসম্মান বজায় রাখাঃ বঙ্গবন্ধু সারাজীবন আত্মসম্মান বজায় রেখে চলেছেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী যখন তাঁকে ঘড় নড়ফু বলেন, তখন তিনি এর তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন আমি প্রমাণ করব ‘আমি ঝড়সব নড়ফু.’ পরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁকে স্বসম্মানে ফিরিয়ে নেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার জবানবন্দী প্রদানের সময়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে যখন গ্রেফতার করে বিমান বন্দরে নিয়ে রাখে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট যখন ঘাতকরা তাঁর বাড়ি আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করে তখনো তিনি তাঁর আত্মসম্মান বজায় রেখে কথা বলেছেন। দেশ স্বাধীনের পর স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি, সউদি আরবের বাদশার সাথে কথা বলার সময় নিজের ও দেশের আত্মসম্মান বজায় রেখে কথা বলেছেন। এভাবে তিনি সবসময় নিজের, দেশের ও জাতির আত্মসম্মান বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন।
৬) লোভ না করা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একমাত্র পাকিস্তানী ও বাঙালি রাজনীতিবিদ যিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে পার্টির সেক্রেটারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর বাঙালির অধিকারের সাথে আপোষ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় তিনি তাঁর দুই ছেলেকে সাধারণ ঘরের মেয়েদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হয়েও নিজের সাধারণ বাড়িতেই থাকতেন। এভাবে তিনি সকল জাগতিক লোভ লালসার ঊর্ধ্বে ছিলেন।
৭) জাতিকে ভালোবাসা : তিনি সব সময় তাঁর জাতিকে ভালোবাসতেন। তাইতো ভারতবাসীর স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনে তারপর মুসলমান জাতির পক্ষে পাকিস্তান আন্দোলনে, পরে বাঙালি জাতির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি কখনো স্বজাতি-স্বভূমির বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। ১৯০৬ সালে যখন মুসলিম লীগ গঠিত হয় তখন পাকিস্তানের জনক খ্যাত তরুণ ব্যারিস্টার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেসে যোগদান করেছিলেন। স্বাধীনতার পর এক বিদেশী সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা আমি আমার মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি।”
৮) মানুষের উপর আস্থা ও বিশ^াস স্থাপন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মানুষকে ভালবাসতেন, মানুষকে বিশ^াস করতেন। এই বিশ^াষে তিনি জিতেছেন আবার হেরেছেনও। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, ‘তোমরা বন্ধ করে দিবে।” হ্যাঁ বাঙালিরা ঠিকই বন্ধ করে দিয়েছিল, স্বাধীন করেছিল। আবার তিনি যাদেরকে বিশ^াস করেছিলেন তাদের হাতেই শহীদ হয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দরা গান্ধী তাঁকে সতর্ক করেছিলেন কিন্তু তিনি বিশ^াস করেন নি। আর বিশ^াস না করেই স্ব-পরিবারে তাঁকে শাহাদাৎ বরণ করতে হয়েছে। তবে তাঁর এই বিশ^াস ও আত্মত্যাগ বৃথা যায় নি। তিনি বীরের মতো বাঙালি জাতির হৃদয়ে, বিশ^বাসীর হৃদয়ে অবস্থান করছেন। আর ঘাতক ও তাদের সহযোগিরা মীরজাফর উপাধি পেয়েছে।
৯) নিজের ও পরিবারের চিন্তা না করা : বঙ্গবন্ধু সারাজীবন তাঁর নিজের ও পরিবারের চিন্তা কখনো করেন নি। তিনি সব সময় মানুষের চিন্তা, জাতির চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
১০) মহান স্রষ্টার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াস : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন একজন খাঁটি বাঙালি তেমনি একজন খাঁটি মুসলমানও। ছয় দফা আন্দোলন থেকে তাঁকে বিরত রাখতে শাসক গোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে ফাঁসি কাষ্টে ঝুলাতে চাইলেও তিনি ছয় দফা থেকে সরে আসেন নি। ২৫ মার্চ ’৭১ প্রাণের ভয়ে তিনি বাসা থেকে পালিয়ে যান নি। এমনকি পাকিস্তানী করাগারে তাঁর জন্য যখন কবর খোড়া হয় তখনও তিনি ভয়ে ভীত হন নি বা যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সতর্ক করেন তখনও তিনি নিজের বাসা ছেড়ে সরকারী সুরক্ষিত বাসায় উঠেন নি। এর থেকে প্রমাণ হয় তিনি শুধু মুখে ইসলাম লালন করতেন না, তিনি অন্তর দিয়ে ঈমান ও ইসলাম লালন করতেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এই যে জীবনাদর্শ বাঙালি জাতির জন্য, বিশ^বাসীর জন্য রেখে গেছেন এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সম্পদ। স্বাধীন বাংলাদেশ বার বার পথ হারিয়েছে আবার বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথেই দিশা পেয়েছে। যতদিন বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করবে ততদিন বাংলাদেশ বিশে^র বুকে গৌরবের সাথে টিকে থাকবে।