কাসমির রেজা :
‘আগে সারা বাইস্সায় (বর্ষায়) চল্লিশ, পঞ্চাশটা টিপ দিতাম। এইবার মাত্র পাঁচটা টিপ দিছি। আমরারতো সারা গায়েই লস। আমরা যারা নাও (নৌকা) বাই, তারা তো নাওর উপরেই নির্ভর। দেরিয়া (বাড়তি) কোনো ইনকাম নাই। নাও বাইলে খাইতাম, না অইলে খানি নাই। এই বছর পরিবার লইয়া বড় কষ্টত আছি।’ করোনা মহামারীর কারণে বেকার হয়ে পরা টাঙ্গুয়ার হাওরের নৌকার মাঝি হাদিস আলী এভাবেই নিজের দুর্দিনের কথা তুলে ধরেন। সাত সদস্যের পরিবার নিয়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এই ব্যক্তি। হাদিস আলীর মতো পর্যটন খাতের সাথে জড়িত অনেকেরই এখন একই অবস্থা। করোনা মহামারীর কারণে দেশী ও বিদেশি পর্যটক না আসায় এই খাতের উপর নির্ভরশীল প্রায় ৭০ ভাগ লোক বেকার হয়ে পড়েন। শুধু শ্রমিকরাই নন এই খাতের বিনিয়োগকারীরাও বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকেই বন্ধ করেছেন প্রতিষ্ঠান। এতে সিলেটের পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে।
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের তথ্যমতে দেশে পর্যটন খাতে কাজ করছেন প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ মানুষ। পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত সিলেট বিভাগে এ খাতে কাজ করছেন প্রায় ২ লাখ মানুষ। এরা শুধু নিজেদের পরিবারের জন্য ভূমিকা রাখছেন না, ভূমিকা রাখছেন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও। পর্যটকদের আগমনে আয় বাড়ে অন্যান্য খাতের লোকেরও।
তাহিরপুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি আবিকুল ইসলাম জানান, এ বছর তাহিরপুরে গতবছরের তুলনায় প্রায় ৭০ ভাগ পর্যটক কম এসেছে। পর্যটকরা মুদী দোকান থেকে শুরু করে কসমেটিক্সের দোকার পর্যন্ত সব ধরনের দোকান থেকে কেনাবেচা করেন। পর্যটক কম আসায় বাজারে ব্যবসায়ীদের আয় অনেকাংশে কমে গেছে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু তাহের মোহাম্মদ শোয়েব জানান, করোনা মহামারীর কারণে সিলেটের পর্যটন শিল্পে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় একশ’ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সহায়ক শিল্পেও এর প্রভাব পড়ছে। সেই হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হবে বলে তিনি জানান।
হিলভিউ ট্যুরিজমের স্বত্ত্বাধিকারী ও ট্যুর অপারেটর অব বাংলাদেশ, সিলেটের নেতা খতিবুর রহমান জানান, ‘করোনা মহামারীর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ট্যুর অপারেটর কোম্পানিগুলো। দীর্ঘদিন থেকে ক্ষতির বোঝা কাঁধে নিয়ে অনেক ট্যুর অপারেটর ব্যবসা গুটিয়ে বিকল্প পথে হাঁটার চিন্তা করছে। সাথে সাথে কর্মহীন হয়ে পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই দেশের পর্যটন খাত বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। দেশের পর্যটন খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখতে হলে কেবল প্রণোদনার স্বপ্ন দেখালেই হবে না। সঠিক বাস্তবাায়ন ও সার্বিক সহযোগিতার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।’
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমেদ জানান, ‘করোনার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতসমূহের একটি পর্যটন খাত। করোনার টিকা আবিষ্কার হলেও কিছুদিন মানুষ সতর্কতা মেনেই চলাফেরা করবে। তাই সহসা আমরা এ খাতের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারব না। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছেনি। যারা দুই লাখ, তিন লাখ টাকা ঋণ নেয় তাদের ব্যাপারে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখায় না। সুতরাং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কিভাবে সহযোগিতা করা যাবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। নীতি ঠিক আছে, কর্মসূচি ঠিক আছে কিন্তু যারা বাস্তবায়ন করেন সেখানে ঘাটতি আছে।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট মাহবুব আলী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘করোনা মহামারীর কারণে পর্যটন খাতটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মহামারীর শুরুতেই আমরা ক্রাইসিস ম্যানেজম্যান্ট কমিটি করেছি। প্রতিটি জেলায় আলোচনা করার পর আমরা উপজেলা পর্যায়ে ওয়েবিনার করে আলোচনা করছি। ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রণোদনার সুবিধা পাচ্ছেন না-এমন অভিযোগ অর্থনীতিবিদদের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রী জানান, এটা সত্য ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তবে আমরা ব্যাংকগুলোর সাথেও বসেছি। তাদেরকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।’
পর্যটন খাতে ধসের প্রসঙ্গ আসলে প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, দেশে এখন বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ আছে। পর্যটন খাতে বড় বড় বিনিয়োগকারীরা আসতে চাচ্ছে। তাঁর কাছেই ছয় দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব আছে। চলছে পর্যটন মহাপরিকল্পনার কাজ। করোনা মহামারী শেষে আমাদের পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াবে বলে মন্ত্রী আশা পোষণ করেন।
করোনা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এজন্য আমরা অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হচ্ছি না। যাচ্ছি না বেড়াতে। আসছেন না বিদেশি পর্যটকরাও। এতে বিপাকে পড়ে দেশের পর্যটন খাত। সিলেট বিভাগে গত কয়েক বছর ধরে অন্তত বিশটি পর্যটন স্পটে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ঘটছিল। গড়ে উঠছিল বেশকিছু নতুন পর্যটন স্পটও। সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে জাফলং, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর, ডিবির হাওর, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, যাদুকাটা নদী, সারি নদী, লালাখাল, শহীদ সিরাজ লেক, হযরত শাহজালাল (রহ.) এবং হযরত শাহপরাণ (রহ.) এর মাজার, শ্রীপুর, তামাবিল, লাক্কাতুরা চা বাগান, খাসিয়াপুঞ্জি, জৈন্তার রাজবাড়ী, শ্রী চৈতন্যের জন্মস্থান, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, হামহাম জলপ্রপাত, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, লাউয়াছড়া উদ্যান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান উল্লেখযোগ্য। এই পর্যটন কেন্দ্রগুলোর উপর অনেক মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল। তাই পর্যটন স্পটগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব মানুষের বেশির ভাগ হারিয়েছেন চাকরি। বিনিয়োগকারীরা মুনাফা তো পাচ্ছেনই না উল্টো বইতে হচ্ছে বাড়তি খরচের বোঝা। সার্বিকভাবে এ খাতের শ্রমিক ও উদ্যোক্তারা অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। লকডাউন উঠে যাওয়াতে মাস তিনেক ধরে গৃহবন্দি পর্যটকরা খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে এসব পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়া শুরু করেছেন। তবে তাও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম। তাই পর্যটন খাতে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে উঠতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। এজন্য সহজ শর্তে ঋণ ও বীমার দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে ভালোভাবে উৎরে উঠতে পারলে আবার জমে উঠবে এসব পর্যটন কেন্দ্র। তার আগ পর্যন্ত আমাদের চলতে হবে সতর্কতা মেনেই। বাঁচাতে হবে জীবন ও জীবিকা দুই-ই।