সমীর কান্তি পুরকায়স্থ :
দীর্ঘদিন পর হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলায় সর্বাচ্চ বিদ্যাপীঠ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন হতে যাচ্ছে। যেমন- সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, সুনামগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল কলেজ, সুনামগঞ্জ নার্সিং ইনস্টিটিউট ও সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয় যোগাযোগ ক্ষেত্রেও আনা হচ্ছে বড় বড় প্রকল্প। যেমন- সুনামগঞ্জের লাখো মানুষের স্বপ্নের ৭০২ মি: দৈর্ঘ্য রানীগঞ্জ সেতু যা সিলেট বিভাগের দীর্ঘ সেতু (নির্মাণধীন), সুনামগঞ্জ হাওর এলাকায় উড়াল সড়ক নির্মাণ, হাওরবাসী মানুষের রাজধানী শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ভাটি বাংলার দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকা মানুষের জন্য উন্নয়নের ভান্ডার উজার করে দিয়েছেন। আর সেই উজার করে দেয়া ভান্ডার থেকে যার প্রচেষ্টার আমরা এগুলো পেতে যাচ্ছি তিনি হলেন সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে জন্ম নেওয়া এক ক্ষণজন্মা পুরুষ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. এ. মান্নান (এম. পি.), পড়াশুনা শেষ করে তিনি কর্মজীবনে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করেন। চাকুরী জীবনে লোভ-লালসা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অবসর জীবনে আরাম আয়েশ করে তাঁর জীবন কাটানোর কথা। কিন্তু এই আরাম আয়েশের জীবন শান্তিগঞ্জের মানুষটিকে হয়ত শান্তি দিতে পারেনি। তাই ভাটি বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা তাকে রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসে। এমনি সময়ে ২০০৮ সালে আসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা দক্ষিণ সুনামগঞ্জ-জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ-৩) এই আসনটি জাতীয় নেতা মরহুম আব্দুস সামাদ আযাদের। সামাদ-আযাদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সহ প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্বজনমত আদায়ের জন্য তিনি দেশে দেশে ঘুরে বেরিয়েছিলেন। তাঁর প্রয়াণে এই মর্যাদাপূর্ণ আসনটি কার দ্বারা পূর্ণ হবে লোকমুখে তখন শুধু এই কথাটিই ছিল। আওয়ামীলীগ নেত্রীও এই মর্যাদাপূর্ণ আসনটি নিয়ে ভাবতে থাকেন। তখনই এম. এ. মান্নান তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই দৃষ্টি আকর্ষনের পিছনে কারো কোন আশীর্বাদ ছিল না বা নিজের কোন চাটুকারিতাও ছিল না। মূলত চাকুরী জীবনের সততাই জননেত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণে সহায়তা করেছিল। ফলে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বচনে আওয়ামীলীগ নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুনামগঞ্জ-৩ থেকে নৌকা প্রতীক তাঁর হাতে তুলে দেন। নৌকা প্রতীক পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকর মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ে এবং মাননীয় প্রথানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানায়। নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে আসেন। এরপর তিনি নিজ এলাকার উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করেন। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার নৌকা প্রতীক পান এবং নির্বাচনে বিজয়ী হন। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন। তখনও তিনি সততা, নিষ্টা ও দক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালন করেন। তখন তিনি এলাকার মাটি ও মানুষের প্রতি টানে সুযোগ পেলেই চলে আসতেন তার নির্বাচনী এলাকায়। চেষ্টা করতেন এলাকার মানুষের কাছাকাছি থাকতে। তাদের অভাব অভিযোগ শুনতে। সবশেষে ২০১৮ সালেও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। বার বার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা এবং বিজয়ী হওয়া এটাই প্রমাণ হয় যে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের কাছে পরীক্ষিত এক সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এ ধরনের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আজকের রাজনীতির জগতে খুবই অভাব। এবারের মন্ত্রী পরিষদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন। ভাটি বাংলার গ্রাম থেকে আগত যে মানুষটি আজ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন তার কাছে ভাটি বাংলার দূরাবস্থার কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি এমনিতেই জ্ঞাত। তাই ভাটি বাংলারা বিভিন্ন অঞ্চলে আজ উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু হয়েছে। আমাদের সুনামগঞ্জও এ উন্নয়ন থেকে বাদ পড়েনি মন্ত্রী মহোদয়ের আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় যা আমি লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে সুনামগঞ্জে এ ধরনের উন্নয়নের প্রবাহ আমরা দেখতে পাইনি। বিগত ১২ ডিসেম্বর ২০২০ইং মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী করোনা থেকে মুক্ত হয়ে তার নির্বচনী এলাকাসহ জেলা শহরে এক সংবর্ধনা সভায় আসেন। অনেকদিন পর মন্ত্রী মহোদয়ের আগমনে সারা সুনামগঞ্জে আনন্দের জোয়ার বয়েছিল। সিলেট সুনামগঞ্জ জুড়ে সড়ক পথে নির্মাণ করা হয়েছিল শতাধিক তোরণ। পথে পথে মন্ত্রীকে বরণ করে নেওয়ার জন্য রাস্তার দু-পাশে ছিল হাজার হাজার সর্বস্তরের মানুষ। জনগণের মুখে শ্লোগান ছিল “মান্নান ভাই যেখানে আমরা আছি সেখানে”, “মান্নান ভাই এগিয়ে যাও আমরা আছি তোমার সাথে”, “মান্নান ভাই এর জন্য সুনামগঞ্জ ধন্য” ইত্যাদি। সুধী সমাবেশের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন এক সময়ের তুখোড় ছাত্র নেতা বর্তমানে সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট। সভায় আওয়ামীলীগের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। মন্ত্রী মহোদয় তার বক্তব্যে সরকারের উন্নয়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। কিন্তু ব্যতিক্রমধর্মী একটা জিনিস দেখা গেল তা হল সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা অনুপস্থিত। সুনামগঞ্জ-২ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জয়া সেন গুপ্তের কথা বাদই দিলাম। একদিকে কোভিট-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ অপরদিকে শারীরিক অসুস্থাতা এই উভয়বিধ কারণে হয়ত ঢাকা থেকে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি। কিন্তু বাকি তিন জন অর্থাৎ সুনামগঞ্জ-১ থেকে নির্বচিত সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সুনামগঞ্জ-৪ থেকে (সদর) নির্বাচিত সংসদ সদস্য এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এবং সুনামগঞ্জ-৫ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মুুহিবুর রহমান মানিক এর উপস্থিতি অবশ্যই কাম্য ছিল যেহেতু তারা সুস্থ শরীর নিয়ে দেশেই অবস্থান করছেন। বিষয়টি নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন উত্তাপিত হয়। জন সমক্ষে যা আলাপ হচ্ছিল তাহলে কি তাদের করোনা ভীতি পেয়ে বসল? আবার কেহ কেহ বলছেন তাদের নিজ নিজ এলাকায় বিগত দুই বছরে উন্নয়নের জন্য যা বরাদ্দ হয়েছিল তার সঠিক হিসাব হয়ত জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারবেন না এটা ভেবে। তবে পত্রিকা মারফতে যা জানা যায় তা হল সুনামগঞ্জ শিক্ষা ক্ষেত্রে মেগা প্রকল্পগুলোর স্থান নির্ধারণ নিয়ে তারা মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে একমত হতে পারেন নি। তবে মন্ত্রী মহোদয় যা করেছেন তা ঠিকই করেছেন। কারণ তিনি গ্রাম ও শহরের মধ্যে যে উন্নয়নের বৈষম্য রয়েছে তার নিরসন চেয়েছেন। এটা তো বঙ্গবন্ধুরই স্বপ্ন ছিল যে গ্রাম বাংলার উন্নয়ন হলেই সোনার বাংলার বাস্তবায়ন হবে। তাই মন্ত্রী মহোদয় জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকেই হৃদয়ে ধারণ করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। তাই এ হিসেবে তাদের প্রত্যেকেরই এক এক জন উন্নয়নের সৈনিক হিসেবে মন্ত্রী মহোদয়ের সহিত একমত পোষণ করে এগিয়ে আসা উচিত ছিল। সংসদ সদস্যরা উপস্থিত থাকলে তাদের নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নের কথা তুলে ধরতে পারতেন এবং যে সকল খাতে এখন পর্যন্ত উন্নয়ন হয়নি তাও মন্ত্রী মহোদয়েকে অবগত করাতে পারতেন। এতে সেই খাত গুলোরও উন্নয়ন হতো। ফলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ¦ল হতো এবং রাজনৈতিকভাবেও আওয়ামীলীগ লাভবান হতো। সেদিন তাঁরা সরকারের উন্নয়নের প্রচার, প্রচারণায় না থেকে নিজেদেরকে আত্মগোপনে রেখেছেন। তাঁদের এ ধরনের কর্মকান্ড দলের জন্য নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সুধী সমাবেশটি জেলা সদরের মাঠেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ হিসেবে জেলা সদরের সংসদ সদস্যকে নিজে উপস্থিত থেকে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়কে সুনামগঞ্জ বাসীর পক্ষ থেকে স্বাগত জানিয়ে স্বাগতিক বক্তব্য রাখাই ছিল তার নৈতিক দায়িত্ব, কিন্তু তা তিনি করেননি। এতে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। সংসদ সদস্যদের এ ধরণের ভূমিকায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এটা হল অপরাজনীতির বহি:প্রকাশ। এ ধরণের রাজনীতিতে বিভিন্ন বলয় সৃষ্টি হয় যা উন্নয়ন কর্মকান্ডে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অতীতের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের সুনামগঞ্জ সহ বৃহত্তর সিলেটে দুইটি বলয় সৃষ্টি হয়েছিল যে কারনে বৃহত্তর সিলেটবাসী তাদের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।
পরিেেশষে বক্তব্য হলো এ ধরণের অপরাজনীতির পেছনে কেহ যদি কল-কাঠি নেড়ে থাকে তাহলে তাকে প্রত্যাখ্যান করে সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসা উচিত। তাতেই উন্নয়ন আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যবে এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।