কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘আজ এই ঘোর রক্ত গোধূলীতে দাঁড়িয়ে/ আমি অভিশাপ দিচ্ছি তাদের/ যারা আমার কলিজায় সেঁটে দিয়েছে/ একখানা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ/’….কিংবা ‘একঝাঁক ঝাঁ ঝাঁ বুলেট তাদের বক্ষ বিদীর্ণ করুক/ এমন সহজ শাস্তি আমি কামনা করিনা না তাদের জন্য……’। দেশের প্রধান কবি প্রয়াত শামসুর রাহমান জাতির বীরসন্তানদের হন্তারক দেশদ্রোহী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের এভাবেই শাস্তি কামনা করেছেন।
আজ চৌদ্দই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নিধনের মর্মন্তুদ স্মৃতিঘেরা এক দিন। বাঙালির মেধা-মনন-মনীষা শক্তি হারানোর দিন আজ। ইতিহাসের পাতায় কালো আখরে উৎকীর্ণ বেদনা বিধূর কালবেলা। পথে পথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল বাঙালির কণ্ঠে আজ উচ্চারিত হবে- ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে, ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই…’।
দীর্ঘদিন পরে হলেও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারহীনতার দায় থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশ। সকল রক্তচক্ষু ও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের পরও সাহসিকতার সঙ্গে জাতিকে দেয়া ওয়াদা রক্ষা করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে শীর্ষ প্রায় সকল ঘাতকদের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায়ও কার্যকর করা হয়েছে অনেকের।
শত চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে একাত্তরের শীর্ষ ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাসিম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আমৃত্যু জেলের ঘানি টানতে টানতে কারাগারেই মারা গেছে রাজাকার শিরোমনি গোলাম আযম ও আবদুল আলীম। একাত্তরের ঘাতক আরও ১৮ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী এখন কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। বুদ্ধিজীবী পরিবারগুলোর বিচার প্রাপ্তির স্বস্তি আর সবগুলো রায় কার্যকর করে দেশকে আরেকটি কলঙ্ক থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত করার দাবি নিয়ে বছর ঘুরে আবার এসেছে বুদ্ধিজীবী দিবস।
১৯৭১ সালের নয় মাস রক্তগঙ্গা পেরিয়ে গোটা জাতি যখন উদয়ের পথে দাঁড়িয়ে, পূর্ব দিগন্তে টগবগিয়ে বিজয়ের লাল সূর্য উদিত হচ্ছে, দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে- ঠিক তখনই বাঙালীর কৃতী সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করে পরাজয়ের গ্লানিমাখা পাক হানাদার আর তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা। বধ্যভূমিতে বড় অসহায় দশায় নিঃশেষে প্রাণ দেন আমাদের সেরা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা।
রণক্ষেত্রে বীর বাঙালির হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে শেষে এ জাতিকে মেধাশূন্য করতে সুদূরপ্রসারী ঘৃণ্য নীলনকশা আঁকা হয়েছিল। ঘাতকরা চেয়েছিল জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে। স্বাপদীয় জন্তুর মতো আঁধারে নেমেছিল দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। এ রাতেই তালিকা ধরে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। হত্যা করে ফেলে রাখা হয় নিস্তব্ধ ভুতুড়ে অন্ধকারে। জাতি হারায় তার অসংখ্য মেধাবী সন্তানকে। পরদিন ঘুম থেকে জেগে প্রায় ছুঁই ছুঁই স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল মানুষ জানতে পারেন এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা। মুহূর্তে স্থবির হয়ে যায় সব আনন্দ-কোলাহল। অন্যদিকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে উল্লাসে ফেটে পড়ে এ দেশীয় নরঘাতকরা।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও গোটা বাঙালি জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে দেশের শহীদ কৃতি সন্তানদের। করোনার কারণে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শোকাহত মানুষের ঢল নামবে সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিবিজড়িত রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিস্তম্ভে। সেখানে অর্পণ করা হবে পুষ্পার্ঘ্য। শোকে আপ্লুত বাঙালি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে প্রয়াত বুদ্ধিজীবীদের। বেদিমূল ঘিরে থাকবে তাদের পরিবারের সদস্য, ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীদের চাপা কান্না ও অশ্রুতে ভিজে উঠবে স্বজনের আনা ভালবাসার অর্ঘ্য। দেশের সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। শোকের প্রতীক কালো পতাকাও উড়বে।
একাত্তরের ডিসেম্বরে হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরুপণ করা হয়নি। তবে রবিবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জনের একটি তালিকা অনুমোদন দিয়েছে সরকার। চলতি মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে এ তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে গঠিত কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এদের মধ্যে রয়েছেন- ড. জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডাঃ ফজলে রাব্বী, ডাঃ আলীম চৌধুরী, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দিন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, জহিরুল ইসলাম, শহীদ সাবের, সৈয়দ নাজমুল হক, আলতাফ মাহমুদ, নতুন চন্দ্র সিংহ, আর পি সাহা, আবুল খায়ের, রশীদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, ফজলুল মাহি, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সায়ীদুল হাসান, হাবিুবর রহমান, মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভীনসহ আরও অনেকে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় শোকের আবহে আজ সোমবার সারাদেশে পালিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এ উপলক্ষে রায়ের বাজার বধ্যভূমি ও মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্তান এলাকায় নেয়া হয়েছে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয়ভাবেও বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ দেশ মাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের।
তবে এবার করোনা মহামারীর কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বুদ্ধিজীবী দিবসের কর্মসূচী পালিত হবে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- জাতীয় ও কালো পতাকা অর্ধনমিতকরণ, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়ের বাজার বাধ্যভূমিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ। সকাল ৯টায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সকাল সাড়ে ৯টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে এবং সকাল সাড়ে ১০টায় রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।