ডা. রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ
ইসলামী পরিভাষায় নিজের ইলম-আমল ধন সম্পদ ইজ্জত সম্মান ইত্যাদি যেকোন বিষয়ে নিজেকে বড় মনে করা এবং সেই সাথে অন্যকে তুচ্ছ ও নগন্য মনে করাই অহংকার। অহংকার সর্বাবস্থায় হারাম। আর অহংকারী ব্যক্তিরাই নিজেকে সবচেয়ে বড় মনে করে। অহংকারীদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, (মুসলিম হাদি-২৭৫)। বর্তমানে এই রোগটি সমাজে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত যারা নিজেকে বেশী শিক্ষিত, বেশী বড় আলেম, বেশী আমলদার, বেশী টাকার মালিক, বেশী ক্ষমতাধর মনে করে তাদের মাঝেই এই রোগটি বেশী পরিলক্ষিত হয়। তারা মানুষের কাছে একটু চাহিদা পেলে বা তারা সামান্য ক্ষমতা পেলে তখন আর তারা জমিন দিয়ে হাটে না বরং তাদের চলাফেরা দেখলে মনে হয় তারা বাতাসে উড়ছেন। এই সকল অহংকারীদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, সুতরাং দুনিয়াতে তুমি দম্ভ ভরে বিচরণ করে নাও। কেননা তুমি কখনও ভু-পৃষ্টকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং কখনও পবর্তসম উঁচুও হতে পারবে না। এর মধ্যে যা কিছু আছে মন্দ তা তোমার প্রভুর নিকট অপছন্দনীয়, (সূরা বনি ইসরাইল ৩৭-৩৮)। আজ পুরো জাতি অহংকারে জর্জরিত। বিশেষত দ্বীনদার ও উচ্চ শ্রেণির লোকদের মধ্যে শুধু আমি বড়, আমি বড় আলেম, বড় বক্তা, বড় হুজুর, বড় উচ্চ শিক্ষিত, বড় ধনি, বেশী আমলদার- এই আমি শব্দই আজ পুরো জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যার ছোট্ট একটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে পেশ করলাম- আমি গত কয়েকদিন আগে দেশের একজন প্রখ্যাত আলেম যার দেশী বিদেশী অনেক উচ্চ সম্পন্ন ডিগ্রি রয়েছে। তার ৭ মিনিটের ভিডিওতে একটি বয়ান শুনলাম যেখানে রাসূল (সা.) এর প্রিয় সাহাবী হযরত সাইয়্যিদিনা আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস এর নাম ৮ বার উচ্চারণ করেছেন। অথচ একটি বারের জন্যও হযরত সাইয়্যিদিনা আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) শব্দটি উচ্চারণ করেননি। মহান আল্লাহ পাক রাসূল (সা.) এর প্রিয় সাহাবীদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে পবিত্র কোরআনুল কারীমে এরশাদ করেন, রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রাদ্বু’আনহু যা-লিকা লিমান খাশিয়া রাব্বাহ। অর্থাৎ আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটি তার জন্যই যে, আল্লাহ ভয় করে, (সূরা বাইয়্যিনাহ আয়াত ৯)। যেখানে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়ে রাজি খুশি হয়ে গেলেন সেখানে একজন আলেম সাহেব সাহাবীদের সানে (রা.) না বলে ফতোয়া দিয়ে নিজেকে বড় উচ্চ শিক্ষিত জাহির করতে চাইলেন।
নিজের উচ্চশিক্ষা ও জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে মুসলমানদের জীবন চলতে পারে না মুসলমানদের জীবন চলবে কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে ব্যক্তিগত বা কোন দার্শনিক মতবাদের ভিত্তিতে নয়, কারণ- একটি প্রবাদ আছে অহংকার পতনের মূল।
যাদের মধ্যে এই আমি বড় রোগ আছে তাদের জন্য অভিজ্ঞ কোন রুহানী ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়া ফরজ। কারণ অহংকারী ব্যক্তি নিজেকে খুব ভাল মানুষ মনে করলেও দুনিয়ার মানুষের চোখে কুকুর ও শুকরের চেয়েও ঘৃণিত। হযরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি অহংকার করে আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করে সে মানুষের দৃষ্টিতে ছোট ও নিকৃষ্ট অথচ মনে মনে নিজেকে অনেক বড় মনে করে এমনকি শেষ পর্যন্ত মানুষের চোখে সে কুকুর ও শুকরের চেয়েও অধিক ঘৃণিত ও নিকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয় (বায়হাকী) মিশকাত-৪৩৪ পৃষ্ঠ)। অথচ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কেও ছোট হলে আল্লাহ পাক তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, দান সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি অন্যকে ক্ষমা করে দেন আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন আর যে কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনীত হলে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (সহিহ মুসলিম- ৬৭৫০)। অহংকারী হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হল কোন মুসলমান ভাইয়ের প্রতি কু ধারণা রাখা বিশেষত আল্লাহ ওয়ালাদারে প্রতি কু-ধারণা করা আরও বেশী মারাত্মক। কু-ধারণা পরিত্যাগ করা প্রতিটি মানুষের জন্য জরুরী। কু-ধারণা কখনও অহংকারী থেকে হয়, কখনও প্রতিহিংসা থেকে হয়, কখনও সম্মানের মোহ থেকে হয় কখনও শত্র“তা থেকে হয়। আবার কখনও মনের সংকীর্ণতা থেকে সৃষ্টি হয় যেভাবেই হোক কারো প্রতি কু-ধারণা সম্পূর্ণ হারাম। যেমন পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনেক কু-ধারণা থেকে বেঁচে থাকো কেননা কর্তৃক ধারণা গুনাহ আর তোমরা একে অন্যের দোষ ত্র“টি অনুসন্ধান করোনা এবং পরের গীবত করোনা তোমাদেরমধ্যে কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো তা ঘৃণা করবে সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাহ কবুলকারী-পরম দয়ালু। সূরা হুজরাত-১২।
বর্তমানে কোন মুসলমান যদি বিপদে পড়ে তাহলে দেখা যায় অন্য এক মুসলমান ভাই তৃপ্তির ঢেকুর ছাড়ে এবং আরো বিদ্বেষ ছড়ায় অথচ রাসূল (সা.) এর হাদিস অনুযায়ী এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। কোন মুসলমান ভাইয়ের বিপদ দেখে আনন্দিত হলে সে নিজেই সেই বিপদে পতিত হবে। হযরত ওয়াসিলা ইবনে আশকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, তুমি তোমার ভাইয়ের বিপদ দেখে আনন্দ প্রকাশ করো না। যদি এরূপ করো তবে আল্লাহ তার উপর রহম করবেন এবং তোমাকে সেই মসিবত দিয়ে পাকড়াও করবেন (তিরমিযি- ২৫০৬)। মূলত এই হাদিসে অন্যের হীত কল্যাণ কামনার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তুমি কখনও অন্যের বিপদ দেখে হাসবে না, তাহলে তোমাকেও সেই বিপদে পাকড়াও করা হবে।
অহংকার তাকাবুর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চেয়ে ওলামায়ে কেরামগণই এর ভয়াবহতা বেশী ভাল জানেন আর কোরআন হাদিসে অহংকারের কঠিন পরিণতির সতর্কবাণী জানার পরেও কিছু আলেমদের মধ্যেই তা পরিলক্ষিত হয়। ভাল কাপড় চোপড় পরিধান করা ভাল, দামি গাড়িতে চড়া ভাল, বিমানে চড়াও দূষনীয় নয় কিন্তু দামি গাড়ি ব্যবহারের সময় বিমানে চড়ার পর যদি মনে অহংকার আসে নিজেকে অনেক বড় এবং অন্যকে তুচ্ছ ও নগন্য মনে হয় থবে তা সর্বাবস্থায় হারাম ও কবীরাহ গুনাহ। নিজের মাহফিলে বেশী মানুষ হলে তাতেও কোন দোষ নেই কিন্তু ওয়াজ মাহফিলে বেশী বেশী মানুষ হওয়া ও জনগণের কাছে বেশী চাহিদার কারনে নিজের দিলের মধ্যে অহংকার আসা দোষ। কেননা সামান্যতম অহংকার থাকলেও জান্নাতে যাওয়া যাবেনা। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) এরশাদ করেন যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না (মুসলিম- ২৭৫-১৬৯)।
অহংকার এত বড় অপরাধ যে, কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তায়ালা বিচার কার্য শুরু করার পূর্বে রাগান্বিত অবস্থায় তিনি ঘোষণা করবেন ‘আইনাল মুতাকাব্বিরুন’ অর্থাৎ দুনিয়াতে যারা অহংকার করে চলতো তারা কোথায়? এরপর তিনি অহংকারীদেরকে পাকড়াও করার নির্দেশ দিবেন। তখন ফেরেশতাগণ তাদেরকে পাকড়াও করবেন।
হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) এরশাদ করেন কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তায়ালা আকাশমন্ডলী গুটিয়ে নিবেন অত:পর তিনি আকাশমন্ডলীকে ডান হাতে ধরে বললেন আমিই বাদশাহ। কোথায় জবরদস্ত লোকেরা, কোথায় অহংকারীরা? এরপর তিনি বাম হাতে সমস্ত জমিন গুটিয়ে নিবেন এবং বললেন, আমিই বাদশাহ। কোথায় জবরদস্ত লোকেরা, কোথায় অহংকারীরা? (সহিহ- মুসলিম- ৭২২৮-৬৯৪৪)।