কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে এ প্রকল্পেও বিদেশ ভ্রমণের সংস্থান রাখা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণ করবেন ৬২ সরকারি কর্মকর্তা। এতে খরচ হবে ১ কোটি টাকা। এছাড়া, আইডিইএ দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের আওতায় প্রবাসে নিবন্ধন টিম পাঠানো এবং প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের নিবন্ধন সংক্রান্ত খাতেও খরচ করা হবে ১০০ কোটি টাকা। কেবল বিদেশ নয়, দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণের জন্যও খরচ করা হবে ২ কোটি টাকা।
এর মধ্যে স্মার্ট কার্ড কেনা, উৎপাদন, পারসোনালাইজেশন ও উপজেলা পর্যায়ে পাঠানোর জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৫৫৪ কোটি টাকা, যা মোট খরচের ৩০ শতাংশ। উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছার পর ৫ কোটি স্মার্ট কার্ড বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় খরচ করা হবে ৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ উপজেলা পর্যায়ে প্রতিটি স্মার্ট কার্ড বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় ১৫ টাকা করে খরচ করবে ইসি।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বুধবার (২৫ নভেম্বর) জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
নির্বাচন কমিশন প্রকল্পটির উদ্যোগী ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান। মোট ১ হাজার ৮০৫ কোটি ৯ লাখ টাকা খরচে প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে একনেক।
প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হলো- ডাটা সেন্টার ও ডিজাস্টার রিকভারি সাইটের বিদ্যমান সার্ভারকে অধিকতর দক্ষতাসম্পন্ন নতুন সার্ভারের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনের জন্য ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব নাগরিককে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করে ইসিকে সহায়তা করা। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বর্তমান জাতীয় পরিচয়পত্র শনাক্তকারী ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ ও বিস্তৃত করা। ইসির কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়গুলোয় ছবিসহ ভোটার নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচিতি সেবা বাস্তবায়নের উপযোগী আইসিটি অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। জনবান্ধব জাতীয় পরিচিতি সেবা দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্ষমতা বাড়ানো।
আরও যত খরচ
সূত্র বলছে, এ প্রকল্পে ৯৭ জন কর্মকর্তার বেতনের পেছনে ১২ কোটি ৩৫ লাখ ৮৯ হাজার, বাড়িভাড়া ৬ কোটি ৭১ লাখ ৫১ হাজার, শান্তি বিনোদন ভাতা ৪১ লাখ ২০ হাজার, উৎসব ভাতা ২ কোটি ৫ লাখ ৯৮ হাজার, শিক্ষা ভাতা ৫৮ লাখ ৩০ হাজার ও নববর্ষ ভাতা হিসেবে ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ করা হবে।
৫০ জন কর্মকর্তার যাতায়াত ভাড়া ৯ লাখ, ১৪ জনের মোবাইল বিল ১২ লাখ ৬০ হাজার, ১৪ জনের আবাসিক টেলিফোন নগদায়ন ভাতা ২৫ লাখ ২০ হাজার, ৫০ জন কর্মকর্তার টিফিন ভাতা ৬ লাখ, ৭৫ জন কর্মকর্তার পোশাক ভাতা সাড়ে ৭ লাখ, ৭৫ জনের প্রতিরক্ষা সার্ভিস ভাতা সাড়ে ৭ লাখ, ১৮ জনের ব্যাটম্যান ভাতা ৫ লাখ, ১৮ জনের ক্ষতিপূরণ ভাতা ৩ লাখ টাকা।
আরও যেসব ভাতা রয়েছে তার মধ্যে অধিকাল ভাতা ৩৫ লাখ, আপ্যায়ন ভাতা ৩ লাখ, অন্যান্য ভাতা ও ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার ৫০ লাখ, অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা চারজনের সাড়ে ৭ লাখ, সম্মানী ৩৫ লাখ টাকা।
আপ্যায়ন খরচ ১ কোটি, পরিবহন সেবা ১১ জনের ১১ কোটি ৪৩ লাখ, আইন সংক্রান্ত ব্যয় ১ কোটি টাকা, ৭৫টি মিটিং, সেমিনার ও কনফারেন্স ব্যয় আড়াই কোটি টাকা, ইউটিলিটি সেবা ২ কোটি, ডাক/কুরিয়ার ৫০ লাখ, ইন্টারনেট/ফ্যাক্স/টেলেক্স খরচ ১ কোটি ৮০ লাখ, আবার টেলিফোন খরচ ৫০ লাখ, প্রচার ও বিজ্ঞাপন খরচ ৪ কোটি, ২০টি অডিও ভিডিও/চলচ্চিত্র নির্মাণ খরচ ১ কোটি, ২ হাজার ৩১১ জনের আউটসোর্সিং সেবায় ৩৫৬ কোটি ৫১ লাখ ৫১ হাজার টাকা খরচ করা হবে।
যানবাহন নিবন্ধন নবায়ন, ট্যাক্স-টোকেন, ফিটনেসে ৬০ লাখ, ব্যাংক চার্জে ৫০ লাখ, ব্যবস্থাপনায় (অফিস ভাড়া, বিদ্যুৎবিল, স্ক্যান) ১৬ কোটি ৫৮ লাখ, ৫ হাজার ৯০০ জনের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে খরচ ৪ কোটি, পেট্রোল, ওয়েল, ডিজেল, লুব্রিকেন্ট খরচ ৩ কোটি ৬৩ লাখ, গ্যাস ৩৫ লাখ, স্ট্যাম্প ও সিল খরচ ৫০ লাখ, অন্যান্য মনোহরি ১ কোটি, পরামর্শ সেবা ২৮ কোটি ৭০ লাখ, কম্পিউটার সামগ্রী ও কম্পিউটার কনজিউমেবলস ১ কোটি, মটরযান মেরামত ৬০ লাখ, আসবাবপত্র রক্ষণাবেক্ষণ ৩ লাখ, কম্পিউটার রক্ষণাবেক্ষণ ২ কোটি, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণ ২৩ কোটি, অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ৫ লাখ, মটরযান রক্ষণাবেক্ষণ (প্রাধিকার ভুক্ত কর্মকর্তাদের) ৪ কোটি ২০ লাখ, মূল্য সংযোজন কর ২ কোটি ৫০ লাখ, অফিস সরঞ্জমাদি ১ কোটি ৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক খরচ ৩ কোটি ৮০ লাখ, আসবাবপত্র কেনা ৩ কোটি ৪৪ লাখ, ৬টি ডাটাবেজ খরচ ১৭৩ কোটি, তথ্য, কম্পিউটার ও আইসিটি সরঞ্জাম ৫ কোটি ৫০ লাখ, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ৩৮ কোটি ৬৮ লাখ, কম্পিউটার সফটওয়ার, বিবিধ সফটওয়ার ৩২৭ কোটি ৫০ লাখ, অনাবাসিক ভবনগুলো (ভাড়া) ২ কোটি ও মূলধন থোক বরাদ্দ ২ কোটি টাকা খরচ করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়।
প্রকল্পের যৌক্তিকতায় ইসি বলেছে, ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য প্রায় ৮ দশমিক ৫ কোটি ভোটারের ডেমোগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করে একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার মাধ্যমে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রস্তুত এবং নিবন্ধিত সব ভোটারকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হয়। এছাড়া নিবন্ধিত ভোটারদের ডেমোগ্রাফিক ও বায়োমেট্রিক তথ্যের সমন্বয়ে নাগরিক নিবন্ধন তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়। ২০১০ সালে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন ২০১০ প্রণয়নের মাধ্যমে ইসিকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কার্যক্রমের দায়িত্ব দেয়া হলেও অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য কমিশন ২০১১ সালে ৭১ জনবল বিশিষ্ট জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ চালু করে।
এছাড়া জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ ও মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়গুলোয় আইটি অবকাঠামো প্রস্তুত করা, পরিচিতি যাচাই সেবা প্রচলন ও নাগরিকদের স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের লক্ষ্যে ২০১১ সালে সরকারের অনুদান ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহেন্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ)’ প্রকল্প নেয়া হয়, যা চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যাবে।
আইডিইএ প্রকল্পের আওতায় নিবন্ধিত নাগরিকদের তথ্য সংরক্ষণ, ভোটার তালিকা, ৯ কোটি স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত ও বিতরণ, নাগরিকদের পরিচিতি সেবা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়াও দুটি সরকারি ও দুটি বেসরকারিসহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠানকে পরিচিতি যাচাই সেবাদানের লক্ষ্য নির্ধারণ ও সে উপযোগী তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা হলেও বর্তমানে ১৩৭টি প্রতিষ্ঠানকে সার্বক্ষণিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এটিকে একটি চলমান প্রক্রিয়া, ভবিষ্যতে এ সেবার চাহিদা আরও বাড়বে।
এনআইডি উইংয়ের জনবল কাঠামোতে মাত্র ৭১ জনের সংস্থান রয়েছে, এ জনবল নিয়ে দেশব্যাপী পরিচিতি সেবা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বিধায় চলমান আইডিইএ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১ হাজার ৪৫৩ জন জনবলের সাহায্যে দেশব্যাপী সার্বিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে চলমান আইডিইএ প্রকল্পের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষাসহ ভবিষ্যতে অধিকতর দক্ষতার সাথে সুচারুরূপে সেবা প্রদান কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের ২০১৭ সালের নভেম্বরের এক সভায় প্রস্তাবিত প্রকল্পটি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।