এম নজরুল ইসলাম
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ গৌরব এই স্বাধীনতায় কিন্তু পরাজিত শক্তি থেমে থাকেনি। সদ্য স্বাধীন দেশে নানা রকম চক্রান্ত চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে আসে ১৯৭৫ সাল। ১৫ আগষ্ট রাতে সেনাবাহিনীর একটি অংশের সহায়তায় কিছু ‘বিপথগামী’ সেনা সদস্যকে দিয়ে সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নবেম্বর মধ্যরাতে কিছু সেনা সদস্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে। আজ আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই চার জাতীয় নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে।
একাত্তরের পরাজয় মেনে নেয়নি এবং নিজেদের অবস্থান থেকেও সরে আসেনি যে শক্তি, তারাই পরবর্তীকালে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে এবং নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা ছিল সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এই হত্যাকান্ড শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসেও এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারাগারের নিরাপত্তানীতি ভেঙে রাতের অন্ধকারে এভাবে জাতীয় নেতাকে হত্যার ঘটনা বিশ্বে বিরল। দুঃখের বিষয়, জেলহত্যার পর দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখলে রেখেছিল খুনীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষ। তারা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল হত্যা মামলার বিচার। সুপরিকল্পিতভাবে অনেক আলামত নষ্ট করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর মামলার প্রক্রিয়া আবার চালু করা হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর নিম্ন আদালত থেকে মামলার রায় পাওয়া যায়। রায়ে তিনজনের মৃত্যুদন্ডসহ ১৫ জনের সাজা হয়। এরপর মামলা যায় হাইকোর্টে, পাওয়া যায় হাইকোর্টের রায়; যদিও সাজাপ্রাপ্তদের অনেকেই এখনও পলাতক কিংবা বিদেশে অবস্থান করছে।
প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ৩ নভেম্বর ভোর ৪টার সময় বঙ্গভবনে ডিআইজি প্রিজন থেকে একটি ফোন আসে। ফোনটি রশিদ রিসিভ করেন এবং একপর্যায়ে তা খোন্দকার মোশতাকের হাতে দেন। মোশতাক ফোনে শুধু ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ বলতে থাকেন। এসব কথা রশিদ মাসকারেনহাসকে একটি সাক্ষাতকারে বললেও তিনি ঘটনার অর্ধেকটা বলেছিলেন। বাস্তবে দুই মাস আগে ফারুক আর রশিদ ষড়যন্ত্র করেন- যে কোন কারণে মোশতাক নিহত হলে অথবা কোন ধরনের পাল্টা ক্যু সংঘটিত হলে তারা কারাগারে বন্দী আওয়ামী লীগের চার গুরুত্বপূর্ণ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে খতম করে দেবেন। এর ফলে আওয়ামী লীগ আর কখনও ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। বঙ্গভবনে যখন ডিআইজি প্রিজন ফোন করেছিলেন তখন রিসালদার মুসলেহউদ্দিন কারাগারে হাজির হয়েছিল একদল ঘাতক নিয়ে এই চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করতে। কারাগারে যে কোন সময় অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তারা কারা কর্তৃপক্ষকে বলেছিল, তাদের কাছে রাষ্ট্রপতির অনুমতি আছে। ডিআইজি প্রিজন এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য শুনতে ফোন করেছিলেন। ৩ তারিখ ভোরে ঘাতকরা কারাগারে নিরাপত্তা হেফাজতে রক্ষিত চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ধরে নিলাম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য। ধরে নিলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান ও মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁরা বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ছিলেন বলে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদকে তাঁর বাসা থেকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে হত্যা করা হলো কেন? তিনি তো তখন আর মন্ত্রী ছিলেন না। এমনকি বঙ্গবন্ধুর নবগঠিত বাকশালের সাধারণ সম্পাদকের পদও গ্রহণ করেননি।’ আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী বলছেন, এই হত্যাকান্ডের ‘উদ্দেশ্যটি হলো, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোখা এবং তার রাজনৈতিক সংস্কৃতির সেক্যুলার ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়া।’ ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘জেলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বন্দী থাকলেও বঙ্গবন্ধুহীন দলের নেতৃত্ব দিতে পারতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারলে বঙ্গবন্ধুহীন আওয়ামী লীগকেও আবারও ক্ষমতায় আনতে পারেন তাঁরা। সে চিন্তাতেই খুনীরা ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে, যা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এ হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। তারা ধরে নিয়েছিল, দেশে আওয়ামী লীগ না থাকলে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তর করা সহজ হবে। ঘাতকরা একটি আদর্শকে হত্যা করতে চেয়েছিল।’ ‘১৫ আগষ্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে স্বাধীনতার শত্রুরা বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।’ অধ্যাপক আবদুল মান্নানের এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে বলতে চাই, জনমানুষের সমর্থনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। করোনা মহামারীর মধ্যেও দেশে প্রবাসী আয়ের রেকর্ড হয়েছে। করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে উন্নতি করে প্রবৃদ্ধিতে পেছনে ফেলছে প্রতিবেশী দেশগুলোকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, মহামারীর মধ্যেই চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। শুধু ভারতই নয়, চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং এশিয়ার মধ্যে চতুর্থ হতে চলেছে বাংলাদেশ। এসবই ঘটেছে নতুন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণে। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আবার উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের ভিত্তিতে সমৃদ্ধশালী হবে, এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।
লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক ও সাংবাদিক।