স্টাফ রিপোর্টার :
নগরীর কাষ্টঘরে রায়হান আহমেদ (৩৪) নামে এক যুবককে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল রবিবার ভোররাতে মেথরপট্টির সামনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রায়হান নগরীর আখালিয়া ধানুহাটারপাড় এলাকার মৃত রফিকুল ইসলামের পুত্র। তিনি রিকাবিবাজার স্টেডিয়াম মার্কেটে শাহজালাল ল্যাবে কাজ করতেন।
গতকাল বিকেল পৌনে ৫ টার দিকে রায়হানের ময়না তদন্ত শেষে নিহতের
লাশ তার আত্মীয় স্বজনের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। এর পর এশার নামাজের পর জানাযা শেষে তার লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে বলে নিহতের স্বজন সূত্রে জানা গেছে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করার খবর পাওয়া যায়নি।
পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। তবে নিহতের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, পুলিশ ধরে নিয়ে নির্যাতন করে রায়হানকে হত্যা করেছে। ভোরে নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়ি থেকে রায়হানের পরিবারের কাছে ফোন করে টাকা দাবি করা হয়েছিলো বলেও অভিযোগ নিহতের স্বজনদের।
এদিকে, পুলিশি নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও স্থানীয় লোকজন গতকাল রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের আখালিয়া মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের সামনে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে সড়ক অবরোধ করেন। প্রায় আধাঘন্টা সড়ক অবরোধের পর পুলিশ গিয়ে তাদেরকে শান্ত করে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুলিশ হেফাজতে খুন হয়েছেন রায়হান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানায়, গতকাল সকালে ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হন রায়হান। তাকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, গতকাল রবিবার ভোর রাত সাড়ে ৪ টার দিকে নগরীর কাষ্টঘর এলাকার মেথরপট্টির সামনে কে বা কারা ছিনতাইকারী বলে রায়হানকে গণপিটুনি দিয়ে আহত করে ফেলে যায়। এ ঘটনার খবর পেয়ে বন্দরবাজার ফাঁড়ির সিরা-৪ টিউটিতে থাকা এএসআই আশিক এলাহি, এএসআই কুতুব উদ্দিন, কনষ্টেবল সাইদুল ইসলাম, কনষ্টেবল টিটু, কনষ্টেবল শহীদ ও কনষ্টেবল রফিক ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছে আহত অবস্থায় রায়হানকে উদ্ধার করে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়। এক পর্যায়ে তার অবস্থা আশংকাজন হওয়ায় পুলিশ তাকে দ্রুত সিলেট ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। সেখানে আড়াই ঘন্টা চিকিৎসাধীন থাকার পর রায়হান মৃত্যুবরণ করেন।
রায়হানের পরিবারের সদস্যরা জানান, নগরীর মিরের ময়দান এলাকায় শাহজালাল ডায়াগনেস্টিক সেন্টারে এক চিকিৎসকের সহকারি হিসেবে কাজ করতেন রায়হান। প্রতিদিনের মতো গত শনিবার রাত ১০টার দিকে তিনি অফিস শেষে বাসায় ফেরেন। খাওয়া দাওয়ার পর ১১টার দিকে বাসার সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে বের হন। এরপর তিনি আর বাসায় ফেরেননি।
অভিযোগ রয়েছে, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ডিউটিকালীন পুলিশরা প্রতিদিন ভোররাতে ভালো মানুষজনকে ফাঁড়িতে ধরে এনে হাজার হাজার টাকা দীর্ঘদিন থেকে আদায় করে আসছিল। মামলার ঝামেলার কারণে কেউ এ ব্যাপারে কোন প্রতিবাদ করেননি। আর প্রতিবাদ করলেই তাকে অন্য মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো। ফলে অনেকেই মামলার ভয়ে থানায় অভিযোগ করতে যেতেন না। এছাড়া অপরাধীদের ধরে এনে কোর্টে চালান না দিয়ে টাকার বিনিময়ে পরদিন সকালে ছেড়ে দেয়া হতো।
এদিকে নিহত যুবকের সৎ বাবা হাবিবুল্লাহ বলেন, রায়হানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভোরে রায়হান ফোন করে বলছিল, তাকে বাঁচাতে ১০ হাজার টাকা নিয়ে কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসতে। কোনো মতে ৫ হাজার টাকা নিয়ে এলেও ডিউটিতে থাকা পুলিশ সদস্যরা দেখা করতে দেননি এবং ফজর নামাজ পড়ে আসতে বলেন। নামাজ পড়ে এসে দেখি পুলিশ সদস্যরা কানাঘুষা করছেন। পরে আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন রায়হানের শরীর খারাপ মেডিক্যালে যেতে। মেডিক্যালে গিয়ে দেখি তার লাশ মর্গে রাখা।
নিহতের মামাতো ভাই আব্দুর রহমান অভিযোগ করেন, গণপিটুনিতে মারা গেলে তার দেহের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন থাকতো। কিন্তু তার হাতের নখগুলো দেখলে অনুমান করা যায় তা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। পুলিশ ফাঁড়িতে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করার অভিযোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে গতকাল রাতে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হানকে নির্যাতনের অভিযোগটি অস্বীকার করে বলেন, ঘটনার সময় আমি ফাঁড়িতে ছিলাম না। ভোরে খবর পেয়ে ফাঁড়িতে ছুটে যাই। সেখান থেকে ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে দেখি মুমূর্ষু অবস্থায় রায়হানের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসার আড়াই ঘন্টার পর তার মৃত্যু হয়। পরে সেখান থেকে লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য হিমাগারে রাখা হয়। তিনি জানান, রায়হানের বিরুদ্ধে মাদক ও ছিনতাইর প্রায় ৫টি মামলা রয়েছে। তবে কে বা কারা তাকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে তা তদন্ত চলছে।
কোতোয়ালী থানার ওসি (তদন্ত) সৌমেন মৈত্র জানান, এখনো নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় লিখিত কোনো অভিযোগ করা হয়নি। অভিযোগ পেলে ঘটনা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) জ্যোতির্ময় সরকার বলেন, ছিনতাইর চেষ্টাকালে রায়হান গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হন। তাকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, গতকাল ভোরে নগরীর কাস্টঘর এলাকায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে রায়হান আহমেদকে আটক করে স্থানীয়রা। পরে লোকজন তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে রায়হানকে উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যায়। জ্যোতির্ময় সরকার আরও বলেন, রায়হান আহমেদের নামে সিলেটের বিভিন্ন থানায় ছিনতাইসহ একাধিক মামলা রয়েছে।