আল্লামা শাহ আহমদ শফি আর নেই ॥ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক

41

কাজিরবাজার ডেস্ক :
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও আমির, হাটহাজারী দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদ্রাসার সদ্য সাবেক মহাপরিচালক (মুহতামিম), বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা শাহ আহমদ শফী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০৪ বছর বয়সে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এর আগে গুরুতর অসুস্থতাজনিত কারণে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে হেলিকপ্টারযোগে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকায় নেয়ার তিন ঘণ্টা পর তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। মৃত্যুর আগে তিনি হার্ট, কিডনি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মৃত্যুর আগে তার পরিচালিত মাদ্রাসায় তিনি ও তার পুত্রকে নিয়ে একটি অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মাদ্রাসার একটি অংশের ছাত্র-শিক্ষক পিতা-পুত্রের বিরুদ্ধে উত্তাল পরিবেশের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত তাদের দু’জনকেই নিজ নিজ পদ থেকে সরে যেতে হয়।
রাষ্ট্রপতির শোক : রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ হেফাজতে ইসলামের আমির বিশিষ্ট আলেম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, আল্লামা শফী দেশে-বিদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার মৃত্যুতে দেশ একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদকে হারাল।
রাষ্ট্রপতি মরহুম আল্লামা শফীর রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর শোক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
আল্লামা শফী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়ায় ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও আমিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাড়াও একইসঙ্গে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যানও ছিলেন।
বৃহস্পতিবার হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম পদ থেকে পদত্যাগ করার পর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। তার শারীরিক অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটায় চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হলেও চিকিৎসকদের সিদ্ধান্তক্রমে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে জরুরী ভিত্তিতে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় পাঠানো হয়। শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে তাকে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। সন্ধ্যায় প্রায় ৬টা ২০ মিনিটের দিকে তার মৃত্যু হয়। বিশিষ্ট ইসলামী এই চিন্তাবিদের মৃত্যুর খবরে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন মহলে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার মৃত্যুপরবর্তী জানাযা, দাফনসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি কখন কোথায় হবে তা নিয়ে হেফাজত ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পক্ষে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আলোচনা চলছিল। তবে তার প্রধান জানাযার নামাজ হবে দীর্ঘদিনের কর্মস্থল হাটহাজারী দারুল উলুম মইনুল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে এবং দাফন হবে রাঙ্গুনীয়ায়। এ তথ্য জানিয়েছেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষীয় একটি সূত্র।
প্রসঙ্গত, হাটহাজারী মাদ্রাসায় গত কয়েকদিন ধরে হেফাজত ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীকে মহাপরিচালক পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করে সম্মানজনক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ এবং তার পুত্র পরিচালক আনাস মাদানীকে স্থায়ীভাবে অপসারণসহ ৬ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল শিক্ষার্থীরা। সে আন্দোলন একপর্যায়ে খুবই অশান্তরূপ ধারণ করে। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার মিলে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা অনেকটা অবরুদ্ধ ছিলেন হেফাজত আমির আহমদ শফী। বিভিন্ন অফিস কক্ষের পাশাপাশি তার কক্ষেও ব্যাপক ভাংচুর হয়। তিনি বেশ হেনস্থা হন। এ অবস্থায় তিনি অনেকটা বিমর্ষ এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। দাবির মুখে হেফাজত আমীরের পুত্র আনাস মাদানীকে বুধবার রাতেই পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপরও আন্দোলন অব্যাহত থাকে। পুলিশ মোতায়েন এবং মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণার পরও বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনেই থেকে যায়। অতপর বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মহাপরিচালক পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন আহমদ শফী। তখন তিনি বেশ অসুস্থ অনুভব করেন।
হেফাজত আমির আহমদ শফী শারীরিক গুরুতর অসুস্থ বিধায় বৃহস্পতিবার রাতেই তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ তাতে আপত্তি জানায়। তাই বাইরে প্রশাসন এবং ভেতরে মাদ্রাসা ছাত্ররা মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। রাত পৌনে ১১টার দিকে মজলিসে শূরার পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়। এ ছাড়াও, মাওলানা আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করে এবং আগের সব সিদ্ধান্ত বলবৎ রেখেছে শূরা কমিটি। শূরা কমিটি ছাত্র আন্দোলনের ইন্দন দেয়ার অভিযোগে মাওলানা নুরুল ইসলাম কক্সবাজারীকে সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফী, আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মাওলানা শেখ আহমদ, মাওলানা নোমান ফয়েজি, মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরী, মুফতী নুর আহমদ, মাওলানা শোওয়াইব, মাওলানা ওমর, মওলানা কবির আহমদ, মাওলানা আহমদ দিদার, মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরীসহ ১১ জন। এর আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে করোনাকালীন আরোপিত শর্তভঙ্গের কারণে সন্ধ্যায় হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে ছাত্ররা আন্দোলন অব্যাহত রাখে এবং মাদ্রাসা বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। শাপলা চত্বরের মতো রাতের যে কোন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে অভিযান চালাতে পারে এ ভয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা মাদ্রাসার সবগুলো ফটকে তালা দিয়ে রাখে। এ পরিস্থিতিতে রাতভর বাইরে মোতায়েন ছিল বিপুলসংখ্যক পুলিশ এবং ভিতরে ছিল কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্রের অবস্থান। যার কারণে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ ছিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে। বিক্ষোভের শুরু থেকেই ছাত্ররা মাদ্রাসার মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দিলে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় মাদ্রাসার বাইরে প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেয় র‌্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার রাতভর বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা উৎকণ্ঠায় থাকলেও ভোরের আলো দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। শুক্রবার জুমার নামাজের আগে মুসল্লিদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে প্রধান ফটকের পকেট গেটটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। শুক্রবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মাদ্রাসায় পরিস্থিতি শান্ত ছিল। তবে অনাকাক্সিক্ষত কোন পরিস্থিতি যেন না ঘটে সে ব্যাপারে প্রশাসন ও পুলিশ সতর্ক রয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় তার মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর এ সতর্ক অবস্থা আরও জোরদার করা হয়। বিশেষ করে হাটহাজারী দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদ্রাসাকে ঘিরে সশস্ত্র পুলিশের অবস্থান বৃদ্ধি করা হয়। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদারকিও অব্যাহত রাখা হয়। এছাড়া চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ প্রাঙ্গণসহ নগরীর কয়েকটি পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।