ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী ॥ শেখ কামাল বেঁচে থাকলে দেশকে অনেক কিছু দিতে পারত

8
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সি এর মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব্রু রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শহীদ শেখ কামালের ৭১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভায় শহীদ শেখ কামাল আলোকমুখী এক প্রাণ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান ও নিজের ভাই শহীদ শেখ কামালের বহুমুখী প্রতিভা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবদানের কথা স্মরণ করে বলেছেন, শেখ কামাল যদি আজকে বেঁচে থাকত তবে দেশ ও সমাজকে অনেক কিছু দিতে পারত। কারণ তার যে বহুমুখী প্রতিভা বিকশিত হয়ে দেশের সকল অঙ্গনে অবদান রাখতে পারত এবং রেখেও গেছে সে চিহ্ন। তার নতুন নতুন চিন্তাভাবনা ছিল। তাই আজকে যদি বেঁচে থাকত হয়তো দেশকে অনেক কিছু দিতে পারত।
বুধবার বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ কামালের ৭১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আয়োজিত আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৫ আগষ্টের মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বার বার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পিঠাপিঠি ছোট ভাই শেখ কামালের কথা বলতে গিয়েও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তিনি। বেদনার্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি যে সব একদিনে এভাবে হারাব, এটা কখনই চিন্তা করতে পারিনি, কল্পনাও করতে পারিনি।’
১৫ আগষ্টের হত্যাকারীদের বিচার করতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আপনারা সবাই একবার চিন্তা করে দেখুন। দেশে একটা মৃত্যু হলে তার বিচার দাবি করেন আমার কাছে। আর আমি কিন্তু বিচার পাইনি। আমরা বিদেশে ছিলাম। আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। আমাদের দেশে ফিরতে বাধা দিয়েছে। এরপর আমি যখন ফিরলাম, আমি মামলা করতে পারিনি। কারণ মামলা করার কোন অধিকার আমার ছিল না। আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, এই মামলা আমি করতে পারব না। ২১ বছর বিচার পাইনি। ২১ বছর পর সরকারে এসে তারপর মামলা করে সেই বিচার (বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড) করি।’ দেশ সেবার সুযোগ করে দিয়ে দেশের জনগণ অন্যায়, অবিচারের প্রতিকার ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করার সুযোগ দিয়েছে বলে দেশের জনগণের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা।
আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কি নির্মমভাবে এই হত্যাকান্ড ১৫ আগষ্ট ঘটেছে। আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন! দেশ শুধু স্বাধীনই করেননি আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু), তিনি এই সেনাবাহিনীও গড়ে তুলেছিলেন। যারা আমাদের বাড়িতে রীতিমত আসা যাওয়া করত, আমাদের বাড়িতে নাস্তা-ভাত খায়নি এই রকম কেউ নেই। আর তারাই যখন সরাসরি কামালের সামনে এসে কামালকে গুলি করে বা জামালকে গুলি করে বা বাড়িতে এভাবে গুলি করল। একটা মৃত্যু হলেই তার বিচার দাবি করেন আমার কাছে, আর আমি কিন্তু বিচার পাইনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যেই সামরিক কর্মকর্তারা কোনদিন মেজরের ওপরে উঠেতে পারেননি, তারা মেজর জেনারেল হয়েছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হচ্ছে, জেনারেল হচ্ছে। এটা কেন হতে পারল? দেশ স্বাধীন করার ফলেই এটা হতে পেরেছে এবং নিজের হাতেই তো তিনি (বঙ্গবন্ধু) প্রমোশন দিয়ে গেছেন। ওই মেজর জিয়াকে (জিয়াউর রহমান) মেজর থেকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত সেই প্রমোশনটা তো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, শেখ কামাল একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার ছিল। শেখ জামাল সেও একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সেনাবাহিনীর একজন কমিশন্ডপ্রাপ্ত অফিসার। আমার পরিবারের সদস্য শেখ আবু নাসের, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাত সবাই মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক ছিলেন। সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। আর যার হাতে গড়া তাকেই (বঙ্গবন্ধু) হত্যা করে দিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ঠিক যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই চেতনাটাই নষ্ট করতে চেয়েছিল। কত নির্মমভাবে হত্যা করল! শেখ রাসেল একটা ছোট ১০ বছরের শিশু, তার কী অপরাধ? আরিফ সেও সমবয়সী। সুকান্তর বয়স ছিল মাত্র ৪ বছর, তাকেও হত্যা করা হয়েছে। একটা স্বাধীন দেশ, সেই স্বাধীন দেশেই হত্যাকান্ড হয়েছিল। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং কিছু সময় নিশ্চুপ হয়ে পড়েন।
শৈশবের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোন ছিলাম। একসঙ্গে উঠাবসা, খেলাধূলা, এক সঙ্গে চলাফেরা, ঝগড়াঝাটি সবই আমরা করতাম। এক সঙ্গে সাইকেল চালানো, এক সঙ্গে ক্রিকেট খেলা, ব্যাডমিন্টন খেলা সবই করতাম। যেহেতু আমরা দুই ভাইবোন কাছাকাছি। আমার পুতুল খেলাতেও কামাল যেমন আমার সঙ্গে থাকত, ওর সঙ্গে ছোটবেলা থেকে বাকি সব খেলায় আমিও ওর সঙ্গে এক সঙ্গে খেলতাম।’
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শেখ কামালের সাহসী রাজনৈতিক ভূমিকার কথা স্মরণ করে তার বড় বোন শেখ হাসিনা বলেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে তার (শেখ কামাল) যেই সাহসী ভূমিকা ছিল, কারণ ছয় দফা দেয়ার পর থেকে যে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরে দেশে যেভাবে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল- প্রতিটি সংগ্রামে শেখ কামালের অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে।
এ সময় তিনি প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামালের সক্রিয় অংশগ্রহণের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ঢাকা কলেজে পড়ার সময় সে (শেখ কামাল) মিছিল নিয়ে চলে আসত বটতলায়, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সেই সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে কামাল সক্রিয় ভূমিকা রেখে গেছে। এমনকি ২৫ মার্চে রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড দেয়। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। মুক্তিযুদ্ধের একটা সময় সরকারের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে সব বাহিনীর প্রধান কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে শেখ কামাল। প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে।
খেলাধুলার প্রতি ভাইয়ের আকর্ষণের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই আমি আর রেহানা (ছোট বোন শেখ রেহানা) বাংলাদেশ থেকে জার্মানির উদ্দেশে রওনা হই। তখন বিয়ে হয়েছে, নতুন বউ। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাদের জন্য কি নিয়ে আসব? কামাল একটা ডায়েরিতে লিখে দিল ‘এডিডাস বুট’ নিয়ে আসবা আপা প্লেয়ারদের জন্য। সেই লেখাটা রয়ে গেছে। নিজের জন্য সে (শেখ কামাল) কোনদিন কিছু চাইত না।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনের অধিকাংশ সময়ই কারাগারে কাটানোর কথা উল্লেখ করে তার জ্যেষ্ঠ কন্যা বলেন, ‘কামালের জন্ম হবার পর থেকে তো বেশিরভাগ সময়ই আব্বা (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু) জেলখানায়। কামাল তো আব্বাকে আব্বা বলে ডাকারও সুয়োগ পায়নি। আমরা একসঙ্গে যখন খেলতাম আমি আব্বা বলে ডাকতাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করত, হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুব ছোট বেলা থেকেই কামাল শুধু যে খেলা অঙ্গনে তা না, সাংসারিক কাজেও আমার মায়ের সঙ্গে সব রকমের সহযোগিতা করত। ওই ছোট বয়স থেকেই সে খুব দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করত। কামাল আমার থেকে দুই বছরের ছোট। কিন্তু শেখ কামালের বুদ্ধি, তার জ্ঞান, তার সব কিছুতেই একটা পরিমিতিবোধ ছিল।
শেখ কামালের বহুমুখী প্রতিভার কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, শেখ কামাল স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে, ঢাকা থিয়েটার যখন হয় সেখানেও তার অবদান ছিল। সে নিজে অভিনয় করত, গান গাইত, সেতার বাজাত। খেলাধুলার মাঠে তার সব থেকে বড় অবদান। ধানমন্ডি এলাকায় ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলার ব্যবস্থা ছিল না। শেখ কামালই উদ্যোগ নেয়; ওই অঞ্চলের সবাইকে নিয়ে আবাহনী গড়ে তোলে এবং মুক্তিযুদ্ধের পরে এই আবাহনীকে আরও শক্তিশালী করে। আবাহনী ক্লাব ও স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আজকে কামাল আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আজকে তার সৃষ্টি আবাহনী ক্লাব এখনও আছে। স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর অনেকেই মারা গেছে, নতুনভাবে আবার স্পন্দন গড়ে তোলা হয়েছে। ফিরোজ শাহীর ছেলেসহ যারা উদ্যোগ নিয়েছে, তাদের ধন্যবাদ জানাই।
ভাই শেখ কামালের শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেখ কামাল শাহীন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। সেখানে অনার্স পাস করে মাস্টার্স পরীক্ষাও দেয়। পরীক্ষা শেষ হয়েছিল, তারপরেই ঘটে ১৫ আগষ্ট। তার রেজাল্ট যেটা পেয়েছি, সেটা হচ্ছে মাস্টার্স ডিগ্রীও পাস করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার সঙ্গে সুলতানা কামালও একইসঙ্গে মাস্টার্স ডিগ্রী করেন এবং তারা দু’জনেই পাস করেছে। সুলতানা কামাল ভাইবা দিতে পারেনি। একদিকে ভাইভা যখন হয় তার আগেই তারা আমাদের ছেড়ে চলে যায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ওইদিন ঘাতকের বুলেটে নির্মমভাবে নিহতদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, সবই একদিনে হারাব- এটা কখনই আমরা চিন্তা করতে পারিনি, কল্পনাও করতে পারিনি। যাদের সঙ্গে কাজ করেছে, যাদের সঙ্গে একসঙ্গে ছিল, এমনকি ওসমানী সাহেবের (কর্নেল এমএজি ওসমানি) এডিসি আরেকজন আর্মি অফিসার সেও একসঙ্গে কাজ করেছে- আর তাদের হাতেই নিহত হতে হলো শেখ কামালসহ আমাদের পরিবারের সকল সদস্যকে!
প্রধানমন্ত্রী দেশের সেবার সুযোগ করে দিয়ে দেশের জনগণ অন্যায়, অবিচারের প্রতিকার ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করার সুযোগ দেয়ায় দেশের জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতাও জানান।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এ আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। অনুষ্ঠানে শহীদ শেখ কামাল ‘আলোমুখী এক প্রাণ’ শীর্ষক স্মারক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও শহীদ শেখ কামালের বন্ধু সালমান এফ রহমান, সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, একাত্তর টেলিভিশনের এডিটর ইন চীফ মোজাম্মেল বাবু বক্তব্য রাখেন। আলোচনা শেষে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।