ড. মোঃ হাসিবুল আলম প্রধান
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ঢাকা-১৮ আসনের এমপি এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন গত ৯ জুলাই বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২৫ মিনিটে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। গত ১১ জুলাই জানাযা শেষে বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরে তাকে দাফন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এক বর্ষীয়ান, সৎ ও ত্যাগী রাজনীতিকের চিরবিদায় হলো, বাংলাদেশ হারাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলীয়ান এক আলোকিত বাতিঘরকে।
অকৃতদার সাহারা খাতুনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলায়। শিক্ষাজীবনে তিনি বিএ এবং এলএলবি ডিগ্রী অর্জনের পর বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা গঠিত হলে তাতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং আইভি রহমানের নেতৃত্বে সারা ঢাকা শহরের মহিলাদের সংগঠিত করতে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রথমে নগর আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা নিযুক্ত হন, পরে মহিলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং একই সঙ্গে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন সম্পাদিকা নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে এই নিবেদিত রাজনীতিবিদ তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে গত কয়েক মেয়াদ ধরেই আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। এছাড়া বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক মহিলা আইনজীবী সমিতি ও আন্তর্জাতিক মহিলা জোটের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, দেশ স্বাধীনের আন্দোলন, ’৭৫’র ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর সকল অগণতান্ত্রিক ও সৈ¦রশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং খালেদা জিয়া সরকারের সকল নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাহারা আপা সর্বদা সক্রিয় আন্দোলন করেছেন রাজপথে। তিনি ছিলেন কল্যাণমূলক রাজনীতির অগ্রদূত ও ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার খুব প্রিয়।
১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসের দিকের কথা, তখনও মাস্টার্সের রেজাল্ট হয়নি, আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু এবং সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকার কারণে ঢাকায় আগমন। যেহেতু ছাত্র জীবনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পত্রিকা দৈনিক আজকের কাগজের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি এবং আইনের ছাত্র ও বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্ত আইনজীবী, তাই আজকের কাগজ কর্তৃপক্ষ আমাকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানির ওপর রিপোর্টিং করার জন্য ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসের ২৭ তারিখ থেকে আদালত প্রতিবেদক হিসেবে নিয়োগ দিল। আজকের কাগজের আদালত প্রতিবেদক হিসেবে আমি যোগদানের আগে থেকে আজকের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার শহীদুজ্জামান ভাই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানির ওপর রিপোর্টিং করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পূর্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পত্রিকা দৈনিক আজকের কাগজের আদালত প্রতিবেদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানিতে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন খবরাদি পত্রিকায় প্রকাশ আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা এবং আবেগঘন মুহূর্ত। নিরাপত্তার খাতিরে তখন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার জন্য ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের আদালত/ বিশেষ এজলাস স্থাপিত হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দ্বিতল লাল ভবনে। প্রথম ২৯ অক্টোবর যেদিন আদালতে অনেক নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে আদালতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম যেখানে পলাতকরা বাদে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আটককৃত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের আত্মস্বীকৃত খুনি লে: কর্ণেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্ণেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, লে. কর্ণেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), তাহেরউদ্দীন ঠাকুর প্রমুখকে দেখে হৃদয়ে তীব্র ঘৃণার সঞ্চারিত হলো এবং সেই ঘৃণার চোখ দিয়ে ঘাতকদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম এই কুলাঙ্গার নিষ্ঠুর ঘাতকরা বাঙালি জাতির পিতা ইতিহাসের অবিসংবাদিত মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল আদালতে আসলে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সরকার পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সিরাজুল হকসহ অন্যান্য কৌঁসুলি ও আইনজীবী, আসামি পক্ষের আইনজীবী এবং সাংবাদিকসহ পুরো আদালত ভরা। প্রথম দিন যেদিন আদালতে যাই সেদিন দেখা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সরকার পক্ষের কৌঁসুলি এডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজনের (বর্তমানে রেলমন্ত্রী) সঙ্গে যিনি পূর্ব থেকেই আমাকে চিনতেন এবং অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তার মাধ্যমেই শুনানি চলাকালে প্রথম এডভোকেট সাহারা খাতুন (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) আপার সঙ্গে পরিচয় হয় যিনি মামলার শুরু থেকেই সরকার পক্ষের আইনজীবী হিসেবে মামলার শুনানি, পরিচালনা ও সমন্বয় নিয়ে দিন রাত কাজ করছিলেন। পরবর্তীতে এডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সরকার পক্ষের কৌঁসুলি স্পেশাল পিপি রমজান আলী খান, পিপি আলতাফ হোসেন, অতিরিক্ত পিপি এডভোকেট কামরুল ইসলাম (সাবেক খাদ্যমন্ত্রী), স্পেশাল পিপি এডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন, স্পেশাল পিপি এডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল, এডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম বাহার, এডভোকেট মমতাজ উদ্দিন মেহেদী, এডভোকেট মোখলেসুর রহমান বাদল ও এডভোকেট নাজমা আক্তার প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং শুনানির দিন তাদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। সাংবাদিক হিসেবে যতদূর মনে পড়ে প্রণব সাহা, জ ই মামুন ও মাইদুল ইসলাম রাজু ভাই প্রমুখ প্রতিদিন শুনানিতে উপস্থিত থাকতেন এবং তাদের সঙ্গে আমার সখ্য ছিল বেশি। পরিচয় হওয়ার পর প্রায়ই শুনানির দিন এডভোকেট সাহারা খাতুন আপার সঙ্গে দেখা হতো, মাঝে মাঝে তার সঙ্গেই গাড়িতে কয়েকদিন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি শেষে ফিরেছি। এই মামলা নিয়ে আপা সার্বক্ষণিক চিন্তা করতেন যেন খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাহারা খাতুনের অবদান সম্পর্কে সম্প্রতি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মুষরে পড়েন এবং বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত ওনাকে এই মামলায় বিচারের উদ্দেশে কাজ করতে দেখেছি।’ ইতোপূর্বে ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে অনার্স পরীক্ষার পরপরই আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছি। সাহারা আপা তখন আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ নিয়ে কাজ করছিলেন, আপা বললেন তোকে সদস্য হতে হবে, আমার সঙ্গে গাড়িতে উঠ। তখন আপা লাল রঙের একটি ইন্ডিয়ান জীপে চড়ে বেড়াতেন। আপার সঙ্গে গাড়িতে উঠে তার চেম্বারে গেলাম এবং আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য হলাম। একজন অসামান্য ত্যাগী ও সৎ রাজনীতিক হিসেবে তখন থেকেই অগাধ শ্রদ্ধা ছিল সাহারা আপার প্রতি।
আমার পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবার পর ১৯৯৮ সালের ২ আগষ্ট আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। এরপর অনেকদিন আপার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু দুঃসময়ে সাহারা আপা জ্বলে উঠেছেন আপন মহিমায়। আগুনের মতো নিজস্ব একটা দীপ্তিতে জ্বলে উঠেছেন অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। সরকারবিরোধী প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে পুলিশের লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস উপেক্ষা করে আপা চলেছেন নিজস্ব শক্তি আর সততার আদর্শে বলীয়ান হয়ে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটশাসিত সরকার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের প্রতি নেমে এসেছিল বিভীষিকাময় এক নির্যাতন। আমরা দেখলাম ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট কিভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে একটি জনসভায় চালানো হয় গ্রেনেড হামলা, হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীকে। ওয়ান ইলেভেনের পর জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই দুর্দিনের দুঃসময়ে যে কয়জন নেতা-নেত্রী সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের একজন সাহারা আপা। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যখন জননেত্রী শেখ হাসিনা জেলে, আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতা যখন মাইনাস ফর্মূলাকে সমর্থন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে লিয়াজো চালিয়েছিল, সেদিনও সাহারা আপা ছিলেন নেত্রীর মুক্তির দাবিতে রাজপথের এক লড়াকু সৈনিক। শুধু তাই নয় সেই দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের বহুসংখ্যক নেতাকর্মীর মামলায় বিনা পয়সায় লড়েছেন। সে কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ কর্তৃক সরকার গঠিত হলে সাহারা আপাকে দেয়া হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং পরবর্তীতে নেয়া হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য পদে। আপা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবস্থায় একদিন দেখা করতে গিয়েছিলাম দেখি আপার সামান্যতম পরিবর্তন নেই, সেই ১৯৯৭ সালের অক্টোবরের দিকে প্রথম পরিচয়ে আপাকে যেমন একজন সহজ সরল সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখেছিলাম, মন্ত্রী হবার পরও আপার সেই সরলতা ও সহজ জীবন যাপনের অভ্যস্ততায় কোন পরিবর্তন হয়নি।
সাহারা আপা চলে গেছেন না ফেরার দেশে কিন্তু তিনি রাজনীতিতে রেখে গেছেন ত্যাগ আর সততার এক অনন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। রাজনীতির জন্য বিয়ে, সংসার কোন কিছুই না করে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সততার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এরকম একজন মহান নেতার চির বিদায়ে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলো। সাহারা আপা আপনি বেঁচে থাকবেন আওয়ামী লীগের ত্যাগ আর সততার রাজনীতিতে, আপনি বেঁচে থাকবেন আওয়ামী লীগের হাজার হাজার পরীক্ষিত কর্মীদের মননে। কবি গুরুর ন্যায় বলতে হয়- নয়নের সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই।
লেখক : প্রফেসর, আইন বিভাগ ও পরিচালক, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।