কাজিবাজার ডেস্ক :
ফের হার্ডলাইনে আওয়ামী লীগ। সুবিধাবাদী-প্রতারক- অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই শুদ্ধি অভিযানে নামছে ক্ষমতাসীন এই দল। বিভিন্ন সময়ে দলে অনুপ্রবেশকারী এসব বিতর্কিত ব্যক্তিই শুধু নয়, এদের দলে অনুপ্রবেশে সুযোগ দেয়া নেতাদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। দলের শীর্ষস্থানীয় ফোরামের একাধিক নেতা এই তথ্য জানিয়েছেন।
টানা ১১ বছর ক্ষমতায় থাকায় প্রচুর আগাছা ও সুবিধাবাদী ঠাঁই নিয়েছে আওয়ামী লীগে। নানা ফাঁকফোকর দিয়ে এরা দলে ঢুকে পড়ে। কিছুদিন পর এদের চরিত্র প্রকাশিত হয়। চরম বিতর্কিত মোহাম্মদ সাহেদের মতো অনুপ্রবেশকারীরাই নানা অপকর্ম করে সরকারকে বদনামের মুখোমুখি করছে। এ কারণেই দ্রুত অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে নির্দেশ নিয়েছেন দলটির হাইকমান্ড।
বিএনপি-জামায়াতের জমানায় হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত গ্রেফতার হওয়া রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িত হওয়ার ঘটনায় বর্তমানে তোলপাড় চলছে দলটিতে। কোন কোন নেতার হাত ধরে সাহেদের মতো বিতর্কিতরা দলের মিথ্যা পদ-পদবি ব্যবহার করে দীর্ঘদিন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকতে পেরেছে, তা নিয়েও দলটিতে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এমন বাস্তবতায় দলে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযানের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সাহেদের মতো দলে অনুপ্রবেশকারীদের দ্রুত তালিকা প্রস্তুত করতে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
যে কোন দল সরকার গঠন করলেই ভোল পাল্টিয়ে ক্ষমতাসীন দলে ভিড়ে যায় অনেক সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ, টাউট-বাটপার ও মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা বড় বড় নেতাকে ভুল বুঝিয়ে ক্ষমতাসীন দলটিতে অনুপ্রবেশ করে বাগিয়ে নেয় বিভিন্ন পদ-পদবি। এর পর তারা সুযোগ-সুবিধা শিকারে মত্ত হয়, আর বদনাম হয় সরকারের। এ কারণে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর পরই অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড-চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী প্রায় ৫শ’ জনের একটি তালিকা তৈরি করে জমা দিলে এসব বিতর্কিতদের দল থেকে বাদ দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেই শুদ্ধি অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টিকারী নানা অপকর্মে জড়িত সাহেদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ ও বিতর্কিত কর্মকান্ড ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় দলে শুদ্ধি অভিযান শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়েছে দলের হাইকমান্ড থেকে।
এক সময়ের হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদের হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্তা-ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, দলের বিভিন্ন পদ-পদবির নাম ভাঙ্গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পরই টনক নড়ে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের। ক্ষমতাসীন দলের ভুয়া পরিচয় দিয়ে এই সাহেদ নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান।
দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কৌশলে ছবি তুলে তা ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের শক্তিধর ব্যক্তি বনে যাওয়া এই বিতর্কিত ব্যক্তির নানা অপকর্ম একে একে ফাঁস হয়ে পড়ায় তোলপাড় চলছে দলটিতে। কীভাবে এত বড় এক চরম বিতর্কিত ব্যক্তি আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে এতদিন চলল, কেন এতদিন কেউ তা ধরতে পারল না কিংবা ব্যবস্থা নেয়া হলো না- এ নিয়েও দলটির প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের ভুয়া পরিচয় এবং সরকারের বড় বড় শীর্ষ মন্ত্রী-নেতার সঙ্গে কৌশলে ছবি তুলে নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতেন এই সাহেদ। নিজের ফেসবুক পেজে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য হিসেবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদসহ কমিটির অন্য সদস্যরা জানিয়েছেন, মোহাম্মদ সাহেদ নামে এমন কেউ কোন উপকমিটিতে নেই।
অথচ আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিয়ে এই শাহেদ বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতে দিনের পর দিন অংশ নিতেন, দিতেন নানা পরামর্শ। নিজে প্রতারণার জাল ফেলে কীভাবে মানুষকে এভাবে নসিহতের বাণী শোনাতেন তা নিয়ে বড় বিস্ময় মানুষের মাঝে। দিনের পর দিন এমন মিথ্যা পরিচয় দিয়ে টকশোসহ দলের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নিলেও আওয়ামী লীগের কোন পর্যায় থেকে কেউ তার ব্যাপারে কোন আপত্তি বা প্রতিবাদ না জানানোর কারণেই দিনের পর দিন নির্বিঘ্নে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে এই মোহাম্মদ সাহেদ। করোনার মিথ্যা সার্টিফিকেট বিক্রি করে শুধু সরকারকেই নয়, সারাবিশ্বেই বাংলাদেশী প্রবাসীদের চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
শুধু আওয়ামী লীগের সময়ই নয়, গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও চরম প্রতারক ও বিতর্কিত সাহেদ ছিল হাওয়া ভবনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ওই সময়ও বিএনপির বড় বড় নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে গেছে। বিএনপি সরকারের সময় হাওয়া ভবনের কর্ণধার তারেক রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এ কারণে ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় সাহেদ গ্রেফতার হয়ে দুই বছর জেলে ছিলেন বলেও তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন। এর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রতারণা ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সরকারী দলের নেতা পরিচয় নিয়ে নানা বিতর্কিত কাজকর্ম চালিয়ে যায় এই সাহেদ।
আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতাদের মতে, তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর পরই আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড ও পরগাছাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দলটির সভাপতি দলে অনুপ্রবেশকারীদের একটি তালিকাও দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের হাতে তুলে দেন। তালিকায় থাকা এসব অনুপ্রবেশকারী যাতে তৃণমূলের কোন কমিটিতে কোন পদ না পায়, দল থেকে বের করে দেয়া হয়- সেজন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশও দেয়া হয়। এরপর দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় এসব অনুপ্রবেশকারীকে আওয়ামী লীগ থেকে বের করে দেয়ারও প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু করোনার কারণে এ পদক্ষেপও বন্ধ হয়ে যায়।
জানা গেছে, যেসব বিবেচনা করে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিএনপি-জামায়াত-শিবির থেকে যারা এসেছে, চিহ্নিত টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, যাদের ভাবমূর্তির সঙ্কট আছে, নেতিবাচক রাজনীতির জন্য যারা জনবিচ্ছিন্ন এবং খুন-ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। সবশেষ সাহেদ কেলেঙ্কারির পর পুনরায় দলে শুদ্ধি অভিযানে নামতে যাচ্ছে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। তবে এবার শুধু অনুপ্রবেশকারীরাই নন, যাদের হাত ধরে এসব বিতর্কিতের দলে অনুপ্রবেশ ঘটেছে তাদেরও তালিকা তৈরি করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।
দলের তৃণমূল নেতাদের মতে, আওয়ামী লীগের ইমেজ ক্ষুণ্নকারী এই অনুপ্রবেশকারী ও হাইব্রিডরাই। এদের কিছু দলে অনুপ্রবেশ করেছে স্বার্থ হাসিলের মতলবে, আবার কেউ কেউ নিজের দোষ ঢাকতে এবং অতীত অপকর্মের শাস্তি থেকে নিজেদের বাঁচাতে। আর দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের মূল কারণও এসব অনুপ্রবেশকারী। ত্যাগী ও দীর্ঘ সময় দলকে সেবা দেয়া নেতাদের বঞ্চিত করে অনুপ্রবেশকারীদের দলীয় পদ ও বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধা দিয়েছেন অনেক মন্ত্রী-এমপি ও বড় বড় নেতাও। যার কারণেই সাহেদের মতো বিতর্কিতরা দল ও সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১১ বছরে হাজার হাজার অনুপ্রবেশকারী ক্ষমতার মধু আহরণে আওয়ামী লীগে নানা কৌশলে ঢুকে পড়েছে। কেন্দ্রের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের হাত ধরে সন্ত্রাসী দল হিসেবে স্বীকৃত স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর আমির থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কিছু নেতা আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। একইভাবে অগ্নিসন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী ও সন্ত্রাসীও আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতে ফুলের মালা দিয়ে নৌকায় উঠেছেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে নাশকতা, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী হত্যা, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ মাদক মামলা। মূলত মামলা থেকে বাঁচতেই তাদের আওয়ামী লীগে যোগদান। এসব পরগাছা ও হাইব্রিডকে এবার শুধু বিদায়ই নয়, তদন্ত করে এদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।